সমাজবাস্তবতার অনন্যসাধারণ রূপকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

অমল বড়ুয়া »

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) বাংলা সাহিত্যের একজন প্রভাবশালী, সব্যসাচী লেখক। তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার। তিনি একজন স্বল্পপ্রজ লেখক। সমাজবাস্তবতার অনন্যসাধারণ রূপকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলা বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। বাস্তবতার সুনিপুণ বয়ান, জীবনের চালচিত্রের রূপায়ণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম রসবোধ তাঁর রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী অবয়ব ও অনিন্দ্য মনোহারিত্য।
ষাটের দশকের অন্যতম বিশিষ্ট গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরে সর্বাধিক প্রশংসিত ও নন্দিত বাংলাদেশি লেখক। তাঁর রচিত সর্বজন প্রশংসিত দুইটি উপন্যাস, গোটা পাঁচেক গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন বাংলা সাহিত্যকে উর্বর ও ঋদ্ধ করেছে। সাহিত্যে নতুন রীতি ও কৌশল সৃষ্টিতেÑÑ ভাষায়, বাক্য ও শব্দগঠনে কিংবা শৈলী ও ভঙ্গিতে, বিষয়ের সংবীক্ষণ ও উপস্থাপনায়, সর্বোপরি আত্মমগ্ন চেতনার স্বাক্ষর পরাবাস্তবতার প্রকাশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
সাহিত্যরচনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বরণ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ। তিনি মফিজউদ্দিন জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়া, গোপনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় তিনি ছিলেন অবিচল। তাঁর দেশপ্রেম ও মানবতাবাদ তাঁকে মহত্তম আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর লেখায় ঘুরেফিরে দেশের কথা, মানুষের কথা ওঠে এসেছে। তাঁর লেখা ‘প্রতিশোধ’, ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’, ‘খোঁয়ারি’, ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, ‘অপঘাত’, ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’, ‘রেইনকোট’ প্রভৃতি গল্পে তিনি সুনিপূণতা ও দক্ষতার সাথে তুলে এনেছেন উনিশ শ একাত্তর সালের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা। তাঁর রচিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উপন্যাস : ‘চিলেকোঠার সেপাই’ (১৯৮৬), ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬); ছোটগল্প সংকলন ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’ (১৯৭৬), ‘খোঁয়ারি’ (১৯৮২), ‘দুধভাতে উৎপাত’ (১৯৮৫), ‘দোজখের ওম’ (১৯৮৯), ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ (১৯৯৭), প্রবন্ধ সংকলন ‘সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেত’ু (১৯৯৮) ইত্যাদি। অপ্রকাশিত লেখা ‘করতোয়া মাহাত্ম্য’। তাঁর সাবলীল লেখায় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ওঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের কঠিন বাস্তবতা। ষাটের দশকে লেখালেখি শুরু করে আমৃত্যু তিনি লিখেছেন আপনমনে। ঋদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্য। নিজের মেধা-মননকে ব্যবহার করে সমাজের নিচু থেকে ওপরতলা পর্যন্ত মানুষের জীবনধারাকে লেখনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন অনিন্দ্য বয়ানে।
মানুষের অন্তর্জীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, যন্ত্রণাগুলো পরাবাস্তবতার ভাব আশ্রয় করে তিনি গল্পে অভিনবত্বের ধারা সৃষ্টি করেন। আর এসব কিছুই কথাসাহিত্যিক ইলিয়াসের মৌলিক সাহিত্যপ্রতিভার নিদর্শন। তিনি একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন মূলত তাঁর ব্যতিক্রমী সৃজনশীল মনীষার কারণে। তিনি ছিলেন সমাজ, ঐতিহ্য ও ইতিহাস সচেতন লেখক। অনাহার, অভাব, দারিদ্র্য ও শোষণের শিকার হয়ে যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে সেসব অবহেলিত মানুষের জীবন ও জীবিকার সরলচিত্র তাঁর গল্প ও উপন্যাসে উজ্জ্বলভাবে অংকিত হয়েছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শ্রেষ্ঠরচনা মহাকাব্যোচিত উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’য় গ্রামবাংলার নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবনব্যবস্থাসহ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, আসামের ভূমিকম্প, তেভাগা আন্দোলন, ১৯৪৩-এর মন্বন্তর, পাকিস্তান আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি ঐতিহাসিক ঘটনা নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। ‘খোয়াবনামা’য় ইতিহাসের বিচিত্র উপকরণ ও ঘটনা স্থান পেয়েছে। ব্রিটিশ আমলের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাÑÑ পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহি বিদ্রোহ, দেশভাগ, ফকির বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের ঘটনা উপন্যাসে স্থান পেয়েছে।
‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসটি একটি দলিল, যা রাজনীতির ইতিহাস, শোষিত-শোষকশ্রেণির ইশতেহারসহ গ্রামীণ অর্থনীতির পূর্ণ বৃত্তান্ত। এই ‘খোয়াবনামা’কে আখতারুজ্জামানের ইলিয়াসের শ্রেষ্ঠকীর্তি বলা হলেও তাঁর ছোটগল্পগুলোও সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর রচনাগুলো বিশ্লেষণধর্মী। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর রচনাবলিতে রাজনীতির স্বাদ পাওয়া যায়। তিনি নিজের লেখার মাধ্যমে সমষ্টি ও ব্যক্তিকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন । নিঃসন্দেহে ‘খোয়াবনামা’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আলোড়ন সৃষ্টিকারী অনন্য উপন্যাস। ১৯৮৭ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসকে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উপন্যাসটির মধ্যে ঊনসত্তরের বিক্ষুব্ধ সমাজ ও রাজনৈতিক ঘটনপ্রবাহ রূপায়িত হয়েছে দারুণভাবে। তবে ঔপন্যাসিকের বক্তব্য বিশেষ কালপরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রাণসঞ্চারী ভূমিকাস্বরূপ নিপুণ দক্ষতায় উন্মোচিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কে বলেছেন, ‘কী পশ্চিম বাংলা কী বাংলাদেশ, সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘ইলিয়াস-এর পায়ের নখের তুল্য কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম।’ আর ইমদাদুল হক মিলনের অভিমত হলো, ‘গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে তাঁর এ দুটি উপন্যাস বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।’ তাঁর লেখায় সমাজবাস্তবতা ও কালচেতনা গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষত, তাঁর রচনাশৈলীর ক্ষেত্রে যে স্বকীয় বর্ণনারীতি ও সংলাপে কথ্যভাষার ব্যবহার লক্ষণীয়, তা সমগ্র বাংলা কথাশিল্পে অনন্যসাধারণ। বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র ভাষারীতির প্রবক্তা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর নিপুণ সাহিত্যকর্মের কারণে অমর হয়ে থাকবেন।
সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাতেখড়ি হয়েছিল কবিতার মধ্য দিয়ে। মূলত তিনি শখের বশেই কবিতা লিখতেন। এরপর ধীরে-ধীরে কথাসাহিত্যে চলে এলেন। প্রথম গল্পগ্রন্থেই ওঠে এলেন আলোচনায়। হাসান আজিজুল হক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’ পড়ে বলেছিলেন, ‘এটি তীরের মতো ঋজু, ধানিলঙ্কার মতো বদমেজাজি, পরনারীর মতো আকর্ষণীয়।’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সৃষ্টি করতে চেয়েছেন পুরোপুরি বিশুদ্ধ ধারা। তাই তিনি ছিলেন ভীষণ নিরীক্ষাধর্মী। ফলে তাঁর ভাষারীতির সঙ্গেও পাওয়া যায় না কারো মিল। আহমাদ ইশতিয়াক-এর মতে, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যকে বলা যায় নারকেলের খোলস। বাইরে শক্ত আবরণ, খোসা ছাড়ালেই নিঃসৃত রস। বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তাঁর সৃষ্ট কথাসাহিত্যকে দিয়েছে এক ব্যতিক্রমী সুষমা।’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তরুণ লেখককের সব সময় প্রাধান্য দিতেন। নানাভাবে পরামর্শ যেমন দিতেন, তেমনই উদ্দীপ্ত করতেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে, তিনি ছিলেন নির্মোহ সাহিত্য সমালোচক। কারো লেখা যদি তাঁর ভালো না লাগত, যত পছন্দসই মানুষই হোন না কেন তিনি, তাঁর লেখার প্রশংসা করতেন না।
তাঁর কিছু কাজ অন্যভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং কিছু কাজের অনুবাদ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাঁঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প ‘রেইনকোট’ অবলম্বনে ‘মেঘমল্লার’ (২০১৪) চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। এছাড়া ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাস থেকে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর প্রাপ্ত পুরষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৩), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৬), সা’দত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬), কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), একুশে পদক (মরণোত্তর) (১৯৯৮) প্রভৃতি।
১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম নেন আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস। তাঁর পিতা পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি বদিউজ্জামান মুহম্মদ ইলিয়াস এবং মাতা বেগম মরিয়ম ইলিয়াস। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া শহরের নিকটবর্তী চেলো পাড়ায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বগুড়া জিলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। ওই স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতার মাধ্যমে আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াসের কর্মজীবন শুরু হয়। প্রথমে তিনি জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি প্রাইমারি শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক পদে দায়িত্ব পান। এছাড়াও তিনি ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিষ্ঠার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। প্রথিতযশা কথাসহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেশ কিছু সময়ের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’- এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ১৯৮৪ সালে ‘সাহিত্য শিবির’ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংঠনের সাথে যুক্ত হন। এই কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।