শেকড়সন্ধানী কবি আসাদ চৌধুরী

রতন কুমার তুরী »

কবিতায় সৌন্দর্যের পূজারি আসাদ চৌধুরী। তিনি কবিতাকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় মশগুল ছিলেন। জহুরির মতো সন্ধানী চোখ আসাদ চৌধুরীর। তাই তিনি সৃষ্টি করে গেছেন কিছু অসম্ভব জনপ্রিয় কবিতা।
আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান কবিদের অন্যতম। তাঁর আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি আর টেলিভিশনে জনপ্রিয় সব অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও উপস্থাপনার জন্যও তিনি বাংলাদেশে বেশ পরিচিত। এ কবি সব সময় মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করতেন। তাই তিনি প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াতেন পথে-প্রান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে। অনেক সময় টেলিভিশনের পর্দায় তুলে ধরতেন অজপাড়া গাঁয়ের কোনো চারণকবিকে। আবার কখনও দেশের বিদগ্ধ কবিদের সাথে আলোচনায় বিমোহিত করতেন দর্শক-শ্রোতাদের। তিনি ভরাটকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করেও মানুষের মন জয় করেছেন। মৌলিক কবিতা ছাড়াও শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী এবং অনুবাদকর্মে তাঁর অবদান প্রণিধানযোগ্য।
প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’ (১৯৭৫) দিয়ে কবি হিশেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন আসাদ চৌধুরী। তিনি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫), অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭), অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬), বঙ্গবন্ধু সম্মাননা (১৪১৮), একুশে পদক (২০১৩) ইত্যাদিতে ভূষিত হন। ১৯৮৩ সালে তাঁর রচিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ নামের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এছাড়া একই বছর তিনি সম্পাদনা করেন বঙ্গবন্ধুর জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’।
কাঁধের বামপাশে একটি কাপড়ের ঝোলা আর গায়ে পাঞ্জাবি ছাড়া তেমন একটা দেখা যায়নি মাটি ও মানুষের কবি, প্রেম ও প্রতিবাদের কবি আসাদ চৌধুরীকে। কথা বলতেন শুদ্ধ বাংলায়। সহজ-সরল মেদহীন অকৃত্রিম ভাব ও ভাষা ছিল কণ্ঠে। তবে কখনোই ভাষায় বরিশালের আঞ্চলিকতাকে উপেক্ষা করতে দেখা যায়নি তাঁকে।
মানুষের জন্য নির্মোহ ভালোবাসা ছিল কবির। কবিতাকে তিনি ভেবেছেন সুন্দরের মিনার ও মন্দির। সৌন্দর্যের টানে ছুটেছেন দেশ-দেশান্তর। যাপন করেছেন শত-সহস্র কবিতাময় আচ্ছন্ন প্রহর। তাঁর কবিতায় আছে নতুন সুর। দেশ, দেশের ঐতিহ্য, লোকায়ত জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, সহজিয়াভাব তাঁর কবিতার উজ্জ্বলতা। আধুনিকতার নামে অকারণ দুর্বোধ্যতা তিনি পরিহার করেছেন। নিরন্তর পান চিবাতে পছন্দ করা এ মানুষটির মুখে আঠার মতো একঝলক হাসি লেগে থাকত। প্রথম কাব্য ‘তবক দেওয়া পান’-এর ‘সত্য ফেরারী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন :
কোথায় পালাল সত্য?
সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে
কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে
ইনজেকশনে, দাদের মলমে
ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে
ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রন সেফে
সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!
মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা বহু স্মৃতি কবিতায় তুলে ধরেছেন আসাদ চৌধুরী। যুদ্ধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কলমযুদ্ধ করেছেন তিনি। কবিতার ভেতর দিয়ে নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছেন ইতিহাস। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে দুঃখ ও হতাশার মিশেলে কবি লিখেছেন :
তোমাদের যা বলার ছিল/ বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষকথাটি সুখের ছিল/ ঘৃণার ছিল
নাকি ক্রোধের, প্রতিশোধের/ কোনটা ছিল?
‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ কবিতায় লিখেছেন :
‘নদীর জলে আগুন ছিল/ আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টিতে
আগুন ছিল গানের সুরে/ আগুন ছিল কাব্যে
মরার চোখে আগুন ছিল/ এ কথা কে ভাববে?
আগুন ছিল মুক্তিসেনার স্বপ্নঢলের বন্যায়
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে কাঁপছিল সব অন্যায়
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/ এখন আছি অল্প।
১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আসাদ চৌধুরী বাকেরগঞ্জের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় একটি সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম আরিফ চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়া আর মাতার নাম সৈয়দা মাহমুদা বেগম। আসাদ চৌধুরী ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যয়ন করেন। সেখান থেকে ১৯৬৩ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে ঢাকায় স্থিত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন খবরের কাগজে সাংবাদিকতা করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভয়েস অব জার্মানির বাংলাদেশ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘকাল চাকরির পর তিনি এর পরিচালক হিশেবে অবসর গ্রহণ করেন।
তাঁর অন্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩), মধ্যমাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫), আমার কবিতা (১৯৮৫), ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৫), প্রেমের কবিতা (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭), বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮), বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কবিতাসমগ্র (২০০২), কিছু ফুল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)।
সব সময় পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা আর সদা হাস্যোজ্জ্বল এ কবিকে আর কখনও টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাবে না। তুমুল জনপ্রিয় এই কবি ৮০ বছর বয়সে ৫ অকটোবর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে কানাডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরপারে পাড়ি জমান।