শেকড়সংলগ্ন রাজনীতিবিদ ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক

সুভাষ দে »

এ.কে ফজলুল হক ছিলেন শেকড়সন্ধানী। এটি তাঁর চিন্তার আদর্শের দিক থেকে নয় কেবল, বরং রাজনীতি, সমাজসেবা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এসব বিষয়ে তিনি তৃণমূলের মানুষের জীবনযাপনের চালচিত্র থেকে তাঁর চিন্তা ও আদর্শকে শাণিত করেছেন। রাজনীতি ও সমাজসেবাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়ে তিনি গ্রামেই থেকেছেন। গ্রামীণ জনপদে তাঁর রাজনীতির মূল শিকড় প্রোথিত। তবে তাঁর কাজের এই যে শেকড় সংলগ্নতা, তার ঢেউ কেবল চট্টগ্রাম জেলায় নয়, সারা দেশেই কাঁপন তুলেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে সাময়িকী জাগরণের ‘জনপদের জননায়ক’ সংখ্যায়।
সাময়িকীতে নানা জনের লেখা থেকে এ.কে ফজলুল হকের জীবন ও কর্মের এক বিশাল ক্যানভাস ধরা পড়েছে। যা অনেকের অজানা। আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধু, জাতীয় ৪ নেতা ও তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্থানিক ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াও দেশের বিদগ্ধজন, লেখক, সংগীত শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব-তাঁদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো; এঁদের মধ্যে আছেন ড. আহমদ শরীফ, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. আনিসুজ্জামান, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, সংবাদ এর সম্পাদক বজলুর রহমান (খেলাঘর এর ভাইয়া), কামাল লোহানী, সন্তোষ গুপ্ত, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, বিচারপতি কে.এম সোবহান, ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, সঙ্গীতজ্ঞ কলিম শরাফী, সংস্কৃতিজন ওয়াহিদুল হক, মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম, অধ্যাপক শওকত ওসমান ও মমতাজ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। রাজনীতির বাইরে একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিলো।
এঁরা সবাই বাংলাদেশ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পজগতের আলোকিত নক্ষত্র। এ.কে ফজলুল হক এঁদের জীবনের উজ্জ্বল দ্যুতি নিয়ে নিজের জীবনকেও আলোকিত করেছেন। বলা যেতে পারে, রাজনীতির যে প্রথম পাঠ-শিক্ষা ও সংস্কৃতি, সেটি এ.কে ফজলুল আয়ত্ত করেছেন ধী ও প্রজ্ঞার সাহায্যে, অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠকের সাথে তাঁর পার্থক্য এখানে।
কবি ও ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোঁপাধ্যায় তাঁর লেখায় এ.কে ফজলুল হকের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ, তাঁর আতিথেয়তা ও ব্যক্তিত্বের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুনীলের সাথে।
সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নুরুদ্দিন খান, চট্টগ্রামের জিওসি থাকার সময় এ.কে ফজলুল হক তাঁকে তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ জানালে তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং তাঁর আপ্যায়নে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর ছোট স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন, চট্টগ্রামে বাাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর যে কজন পরীক্ষিত নেতা ছিলেন, এ.কে ফজলুল হক তাঁর অন্যতম।
বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী ঐ সাময়িকীতে স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধুর বাসায় এ.কে ফজলুল হকের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘আমার গুপ্তচর’ উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে দলের সংগঠকের খবরাদি তাঁর কাছ থেকে জানতেন। হয়তো আরো কারো কাছেও। গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নানা গ্রুপিংকে ‘হক’ সাহেব ঐক্যবদ্ধ করতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন। এ থেকে তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা, দলীয় আদর্শের প্রতি অবিচলতা প্রকাশ পায়।
এ.কে ফজলুল হক চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি, পারমাণবিক অস্ত্রের বিভীষিকা, উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নানা ধারা-সশস্ত্র, বিপ্লবী, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দেখেছেন, দেখেছেন সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্য শিল্পকলা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময়। তাঁর সময়ে প্যান-ইসলামিক ধারাও প্রবল ছিলো। ফজলুল হক এ সবের ভেতর দিয়ে জীবন চলার পথটি খুঁজেছেন। জাতিসত্তার অন্বেষণে নিবিষ্ট পাঠ নিয়েছেন। সেটি সেই সময়ের অনেক রাজনীতিক নিতে পারেননি। তাঁর সহযোদ্ধা ও ১৯৭০ এর এমএনএ, আওয়ামী লীগ নেতা আবু সালেহ বলেছেন, ‘সাহিত্যে শিল্পে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশেল ও বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তাকে সাধারণ ঘরানার রাজনীতিবিদদের পরিমণ্ডল অতিক্রম করে মহত্ত্বের জগতে বিচরণের অমিয় শক্তি এনে দেয়।’
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিন পর পূর্ব বাংলার তরুণদের পাকিস্তান মোহ ছুটে যায়। এই সময়ের পূর্বাপর বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পূর্ব বাংলার যে তরঙ্গাভিঘাত শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে, ফজলুল হকের তাতে যুক্ত হতে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি। ভাষা আন্দোলনে যুক্ততা নিয়ে ড. শহীদুল্লাহর পুত্র চিত্রশিল্পী মূর্তজা বশীর ফজলুল হক এর বন্ধুত্বের স্মৃতির কথা বলেছেন (শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, সাময়িকীর ১৪ পৃষ্ঠা)। উল্লেখ্য, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে ফজলুল হকের বাবা ওছমান আলী মাস্টারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। মূর্তজা বশীর বলেছেন, ‘১৯৫০ সালে আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ফজলু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। একসাথে থাকি-খাই-আড্ডায় সময় কাটে। সে সময় হাজং বিদ্রোহ চলাকালে আমারই আঁকা পোস্টার ছিঁড়ে যাওয়ায় জোড়া লাগাতে গিয়ে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হলাম। চরম নির্যাতন ভোগ করি। আমার বন্ধুও গ্রেফতার। বিনাদোষে সে কারাভোগ করলো আমার সাথে। এটি এখনো আমাকে কষ্ট দেয়। দু’বন্ধু ভাষা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ বরকতসহ অন্য সহযোদ্ধাদের সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের অনেক বন্ধুর মধ্যে ফজলুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’
ভাষাসৈনিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর স্মৃতিচারণে জানা যায়, ‘১৯৫০ সালে আণবিক বোমা নিষিদ্ধকরণের দাবিতে গঠিত বিশ^শান্তি পরিষদের চট্টগ্রাম শাখায় তাঁদের সাথে ফজলুল হক ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সংস্কৃতি সম্মেলনে তিনি অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক। ফজলুল হক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও বিরামহীন কাজ করেছেন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সংস্কৃতি সম্মেলনে মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনিও যোগ দেন।’
সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান-এর বয়ানে আমরা জানতে পারি, ‘১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকালে এ.কে ফজলুল হকের সাথে আমার পরিচয়। পরবর্তীতে সখ্যতা। সেই সখ্যতা আরো প্রগাঢ় হয় ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে যোগদানের মধ্য দিয়ে।’
শওকত হাফিজ খান রুশ্নি তাঁর লেখায় ফজলুল হকের জীবনের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন ‘জাগরণে’, তাঁর প্রবন্ধ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক’ শীর্ষক নিবন্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাউজানে বেশ কয়েকটি শেল্টার হাউস ও সেন্টার হাউস গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বাড়িটাও ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শেল্টার হাউস। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাউজানের ভেতরে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।
এ.কে ফজলুল হক ছিলেন রাউজান থানা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, পশ্চিম গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, রাউজান থানা সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, যুদ্ধকালীন রাউজান থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান, স্বনামধন্য শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন এ.কে ফজলুল হক। প্রান্তিক জনপদ থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে অতি প্রিয় ছিলেন তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠ সংগঠক হওয়ার কারণে। বিগত শতকের পঞ্চাশ ও ষাট দশকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আমাদের দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচির সমন্বয়ে যে সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিলো, এ.কে ফজলুল হক ছিলেন তার সার্থক প্রতিনিধি। আমাদের দেশে বর্তমানে শিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ পেশাজীবী, কর্মজীবী ও ছাত্র যুবকদের সমন্বয়ে নানাবিধ সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন যারা ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যাবেন; এক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা, জনসেবক, বিনয়ী ও ত্যাগী রাজনীতিক এ.কে ফজলুল হক আদর্শ হবেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে সম্মান দেওয়া আজ সময়ের দাবি।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।