শিক্ষকের বিরুদ্ধে ‘যৌন হয়রানির’ অভিযোগ

কাপাসগোলা বালিকাবিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

নিজস্ব প্রতিবেদক »
বছরের প্রথম দিন গতকাল সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেরও প্রায় সব স্কুলের শিক্ষার্থীরা মেতেছিলো বই উৎসবে। কিন্তু সেই উৎসব হয়নি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) কাপাসগোলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে এসেছিলো সকাল ১০টায়। এসেছিলেন তাদের অভিভাবকও। কিন্তু তাদের পথে নেমে আন্দোলন করতে হয়েছে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। ‘যৌন হয়রানির’ অভিযোগে শিক্ষক আলাউদ্দিনকে বহিষ্কারের দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয় স্থানীয় কাউন্সিলর ও পুলিশ।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে মো. আলাউদ্দিন প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ছাত্রীদের বিভিন্ন কৌশলে যৌন নিপীড়ন করতেন। শিক্ষার্থীদের নানা কৌশলে চাপ দিয়ে ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করতেন। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের তিনি প্রায় সময় অফিস রুমে ডেকে নিয়ে নানাভাবে বাজে প্রস্তাব দিতেন। কেউ তার কথায় রাজি না হলে ফেল করিয়ে দেওয়াসহ বহিষ্কারের হুমকি দিতেন। এমনকি নারী অভিভাবকরাও রেহাই পেতেন না তার লোলুপ দৃষ্টি থেকে। স্কুলের প্রতিটি সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্ট করে তিনি চেষ্টা করতেন এসব অপকর্ম ঢাকার। এসব অভিযোগ চসিকের সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে জানিয়েও কোনো ফল না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে নেমেছে আন্দোলনে।
স্কুলটির এক ছাত্রী বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন সহ্য করেছি। স্যারের (প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন) কথা না শুনলে ফেল করিয়ে দিত। ওনার কুপ্রস্তাবে রাজি না হলে যে কাজই করি না কেন, খুঁত বের করতেন। অনেক অভিযোগ করেছি, বিষয়টি সবাই জানেন। কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলতেন না। এমনকি স্কুলের ম্যাডামরাও কেউ তার রুমে একা যেতেন না। আমরা আর কত সহ্য করব।’
আন্দোলনে আসা এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিভাবক বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে এখানে পড়ত। বড় মেয়েকে সদরঘাটের ওখানে একটি কলেজে ভর্তি করিয়েছি। আমার বাসা কাপাসগোলায়। কিন্তু ওই শিক্ষকের ভয়ে এখানে ভর্তি করানোর সাহস করিনি। মানসম্মানের ভয়ে কাউকে কিছু বলার সাহস করিনি এতদিন। আজ যখন মেয়েরা দাঁড়িয়েছে, তাই আমরাও তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছি।’
এ শিক্ষকটির বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনকে কোনো অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা জেনেছি, ২০১৩ সালে ৯ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে যৌন হয়রানির অভিযোগে শিক্ষক আলাউদ্দিনকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু চসিক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ২০১৯ সালে তিনি আবার স্বপদে ফিরে এসেছেন। এরপরও আমরা অভিযোগ করেছি। অভিযোগের পর তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালীদের সঙ্গে তার তোলা ছবি দেখিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। তাকে কলেজের এক শিক্ষকও সঙ্গ দিয়েছেন। তাই আমরা তাকে বহিষ্কার করাসহ পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।
এ নিয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘আপত্তিকর’ কথোপকথনের স্ক্রিনশটের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ আমাকে সালাম দিলে আমি কি তার উত্তর দেব না?’ এরপর তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি।
গতকাল সকাল আনুমানিক ১০টা থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দেড়টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন গাড়ি পুলিশ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু স্কুলে আসেন। তারা এসে আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পরবর্তীতে অভিযুক্ত শিক্ষক আলাউদ্দিনকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে স্কুল থেকে নিয়ে আসা হয়।
জানা যায়, সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অভিযোগ পত্রে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও অসদাচরণের কথা উল্লেখ করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করতে কথা বলা হয় চসিকের সচিব খালেদ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এর আগের ঘটনা জানা নেই। তবে আজকের ঘটনার পর প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ চলছে। কাগজপত্র মেয়রের কাছে পাঠানো হয়েছে, উনি যে ব্যবস্থা নেন সেটাই হবে।’
এদিকে গতকাল হালিশহর আহমেদ মিয়া সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোমা বড়ুয়াকে কাপাসগোলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে। একই আদেশে মো. আলাউদ্দিনকে দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার স্বাক্ষরিত এ আদেশ পেয়ে তার মন্তব্য জানতে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।