শঙ্কা বাড়ছে পরিবেশের

ভূঁইয়া নজরুল »

শঙ্কায় এবার জলজ প্রাণী। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড মিশ্রিত পানি নালা ও খালের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশছে। শুধু পানি নয়, ওই এলাকার বাতাসে গুণগত মান নিয়েও শঙ্কায় পরিবেশ অধিদপ্তর। ইতিমধ্যে পানি ও বায়ুর নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার কাজও করছে পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত সরকারের এই সংস্থাটি।

শঙ্কার কথা জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মফিদুল আলম বলেন, ‘ইতিমধ্যে পানির গুণগত মান পরীক্ষা করেছি। পানির সকল উপাদান সাধারণ মানমাত্রার চেয়ে বেশি রয়েছে। যদিও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নালা ও খালের মুখে বাঁধ দেয়া হয়েছে। তারপরও বাঁধ দেয়ার আগে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড মিশ্রিত কি পরিমাণ পানি গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে তা ভাবনার বিষয়। এখন তা বিশ্লেষণ করছি।’
একইভাবে বায়ুর গুণগত মানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বায়ুর মান পরীক্ষণের জন্য ইউনিট কাজ করছে। মাঠ পর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করার পর বলা যাবে ওই এলাকার কি অবস্থা।

এদিকে গতকাল দুপুরে বিএম কনটেইনার ডিপো এলাকায় যাওয়ার সময় দেখা যায়, ভাটিয়ারি থেকে মাদামবিবির হাট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকার বাতাসে এক ধরনের গন্ধ রয়েছে। একইসাথে চোখও জ্বালাপোড়া করে। পরবর্তীতে কনটেইনার ডিপোর ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, সেখানে তখনো (বিকাল ৫টা) আগুন জ্বলছে। পুরো এলাকা দিয়ে বের হচ্ছে ধোঁয়া। কিন্তু পানি দিয়ে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আগুন নেভানোর সময় পানি গড়িয়ে নালা ও খাল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছিল। বিএম কনটেইনার ডিপোর সিকিউরিটি বিধান দাশ বলেন, ‘এসব পানি যাতে বাইরে বের হতে না পারে সেজন্য নালা ও খালের মধ্যে রোববার দুপুরে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এখন আর পানি সাগরের দিকে যেতে পারে না। বাঁধ উপচে পানি একটি মাঠের মধ্যে গিয়ে পড়ছে।’

পানি সাগরে গেলে সমস্যা কোথায়?

এই কনটেইনার ডিপোতে সৃষ্ট অগ্নিকা- এবং কনটেইনার বিস্ফোরণের ঘটনার কারণে প্রায় অর্ধশত লোকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক। ২৬টি কনটেইনারের মধ্যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকায় পানির সংস্পর্শে আসার পর সেগুলোর তাপমাত্রা বেড়ে গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয়। পরবর্তীতে তা বিস্ফোরণ হয়। আর বিস্ফোরণে লোহার তৈরি কনটেইনারগুলোর পাত চারদিকে প্রবলবেগে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হয়। এখন সেই হাইড্রোজেন পার অক্সাইডগুলোর কিছু গ্যাসীয় অবস্থায় বাতাসে মিশ্রিত হয়েছে এবং কিছু আগুন নেভানোর পানির সাথে নালা ও খাল হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। কারণ রোববার রাত ৯টার দিকে আগুন লাগার পর রাত ১১টার দিকে বিস্ফোরিত হয় কনটেইনার। তারপর আরো কনটেইনার বিস্ফোরিত হতে থাকে এবং বাড়তে থাকে মৃত্যু ও আহতদের সংখ্যা।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড মিশ্রিত পানি যাতে বঙ্গোপসাগরে মিশ্রিত হতে না পারে সেজন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নালা ও খালের মধ্যে বাঁধ দেয়া হয়। এসব পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশ্রিত হলে কি সমস্যা হতে পারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মফিদুল আলম বলেন,‘ এসব পানি বঙ্গোপসাগরে মিশ্রিত হলে মৎস্য ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি হতে পারে। তাই পানি আটকে দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো বাঁধ দেয়ার আগে কি পরিমাণ পানি গিয়ে মিশেছে।’

পরিবেশের রিপোর্টে কি পাওয়া গেছে?

পরিবেশ অধিদপ্তরের টিম সড়কের পাশের নালা ও পাশের ছোটো খাল থেকে বাঁধের ভেতরের অংশ থেকে পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষণ করেছে। সেই পরীক্ষণে দেখা গেছে, পানির সব উপাদান ই বেশি। শিল্প এলাকার প্রতি লিটার পানিতে ২১০০ গ্রামের কম বা সমান টোটাল ডিজলব অক্সিজেন থাকার কথা থাকলেও নমুনায় তিন হাজারের বেশিও পাওয়া গেছে। একইভাবে পানিতে দ্রবীভূত ক্ষুদ্রাকার কণা, কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিজলব (সিওডি) প্রতি লিটারে ২০০ গ্রাম থাকার কথা থাকলেও এখানে তিন হাজারের বেশিও রেকর্ড হয়েছে। প্রতি লিটার পানিতে ডিজলব অক্সিজেন (ডিও) ৪ দশমিক ৫ থেকে ৮ গ্রামের মধ্যে থাকার কথা থাকলে তা ২০ এর বেশি পাওয়া গেছে।

এতে কি পরিবেশের সমস্যা হবে?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাঈল হোসেন বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বাতাসে মিশ্রিত হওয়ার কারণে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। অনেকে বলছে বৃষ্টি হলে তা পানির মাধ্যমে নিচে নেমে আসবে। তাই মোটেই সঠিক নয়। একইসাথে আগুন নেভানোর সময় খুবই কম পরিমাণ পানি নালা ও খালের মাধ্যমে গিয়ে বিশাল আয়তনের বঙ্গোপসাগরে মিশ্রিত হওয়ার কথা। সেখানে গিয়ে তা খুবই নগণ্য হয়ে যাবে। তাই এতে বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

একই মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের অধ্যাপক প্রফেসর সাইদুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সীতাকু- এলাকার শিল্প কারখানাগুলো থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর রাসায়নিক পদার্থ গিয়ে সাগরে মিশ্রিত হচ্ছে। তাই আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহৃত পানি হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের সাথে খুব কম পরিমাণেই যাবে। এতে সাগরের পানির গুণাগুণে কোনো সমস্যা হবে না।’

প্রয়োজন পরিবেশগত সমীক্ষা

এদিকে পানি ও বায়ু দূষণও শুধু নয়, ওই এলাকার মাটি ও সামগ্রিক পরিবেশগত কি প্রভাব দেখা দিতে পারে তা নিয়ে একটি গবেষণা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন প্রফেসর সাইদুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বিশাল এই দুর্ঘটনায় পুরো এলাকার পরিবেশ নিয়ে সমীক্ষা করা প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এই সমীক্ষার উদ্যোগ নিতে পারে।’

উল্লেখ্য, শনিবার রাতে সীতাকু-ের শীতলপুরে অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকা- ঘটে। আগুন নেভানের জন্য ফায়ার সার্ভিসের টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে পানি দেয়ার পর প্রায় দুই ঘণ্টা পর কনটেইনার বিস্ফোরণ হয়। পরবর্তীতে একের পর এক কনটেইনার বিস্ফোরণ হতে থাকে। কনটেইনারগুলোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকায় এই বিস্ফোরণ। সোমবার দিনভরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি।