রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও রাজনীতির বাঁকবদল

আবদুল মান্নান :

 

এক সময় প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহিদ দিবস বা রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে দেশের ছাত্র জনতা পালন করতো । দিনটি বেশ ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে পালিত হতো । হাতে লেখা পোস্টারে লেখা থাকতো ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’, তেমনটি আজ আর দেখা যায় না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল সেই রাষ্ট্রটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র । বিশ্বে এমন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আর কোন রাষ্ট্র পাওয়া যাবে না । ১৯৯৯ সালে দিনটিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যদিও তা অন্য দেশে তেমন একটা পালিত হয় বলে মনে হয় না । কিছুটা ব্যতিক্রম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা।

বাংলাদেশে দিনটি শুধু মাতৃভাষা দিবসে সীমাবদ্ধ রাখলে অন্যায় হবে, এই দিনটিকে দেখতে হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকবদলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে । বলা যেতে পারে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা যা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল ১৯৭১ সালে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে ক’জন ব্যক্তি এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দেশ ও জাতির সাথে পথ চলেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । আজকের এই দিনটিতে সেই মহান ব্যক্তির প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা । এই সাথে শ্রদ্ধা জানাই বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য যাঁরা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই সব ভাষাশহিদদের ।

বাংলা ভাগ হয়ে পাকিস্তানের একটি অংশের সৃষ্টি হলো যার নাম শুরুতে পূর্ব বাংলা, তারপর পূর্ব পাকিস্তান । কিন্তু যাঁরা মনে করেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পূর্ব বাংলার শোষিতদের ভাগ্য বদলাবে তাদের সেই ভুল ভাঙতে বেশি দিন সময় লাগেনি । একবছরের কম সময়ে তারা,  বিশেষ করে এই দেশের শিক্ষিত যুব সমাজ ও পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য যে সকল বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ লড়াই-সংগ্রাম করেছিলেন তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী ভাষাকে শোষণ ও শাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ।

একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা । আমাদের পাশের দেশ ভারতের কোন রাষ্ট্রভাষা নেই, আছে দুটি দাপ্তরিক ভাষা-হিন্দি আর ইংরেজি (ভারতের সংবিধানের ৩৪৩ ধারা কর্তৃক তা নির্ধারিত)  । এর বাইরে তাদের কমপক্ষে তেইশটি আঞ্চলিক ভাষা আছে এবং প্রত্যেক রাজ্য তাদের দাপ্তরিক কর্ম চাইলে ওই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা দ্বারা পরিচালনা করতে পারে । ইউরোপের প্রায় কোন দেশেই রাষ্ট্রভাষা নেই আছে দাপ্তরিক ভাষা আর কোন কোন দেশে তার সংখ্যা একাধিক।

১৯৩৭ সালে জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন । কিন্তু বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাঙালি প্রতিনিধিদের বিরোধিতার মুখে জিন্নাহর সেই উদ্যোগ সফল হয়নি ।  ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পুনঃব্যক্ত করেন। একই সময় বাঙালি বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ শিরোনামে লেখা এক প্রবন্ধে ড. জিয়াউদ্দিনের বক্তব্য খ-ন করে বাংলা ভাষার পক্ষে যৌক্তিক ও জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন । এই প্রসঙ্গে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পদক আবুল হাসিমও পূর্ববঙ্গের জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন । এই ভাষা বিতর্ক নিয়েই পাকিস্তানের জন্ম আর পরবর্তীকালে এই ভাষা বিতর্ক নিয়ে সৃষ্ট পূর্ব বাংলার রাজনীতিই পাকিস্তানকে ভেঙে স্বাধীন ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিল ।

 

সেদিন যারা জিন্নাহর এই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের বেশিরভাগই ছিল ঢাকার তরুণ সমাজ ।  অনেকে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ।   ২৪ মার্চ জিন্নাহর জন্য ঢাকা বিশ্বদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কার্জন হলে এক বিশেষ সমাবর্তনের আয়োজন করে। ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আগে হতে ঠিক করে রাখেন জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে রেসকোর্সের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলে তাঁরা তার তীব্র প্রতিবাদ করবেন ।  ছাত্ররা ঠিক তাই করেছিলেন, যাদের মধ্যে তরুণ শেখ মুজিবও ছিলেন । এতে জিন্নাহ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে সভাস্থল ত্যাগ করেন । তিনি বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ধারণাই করতে পারেননি পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরের কম সময়ের মধ্যে দেশটির প্রতিষ্ঠাতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিন্থিতির মুখোমুখি হতে হবে ।

বলতে গেলে জিন্নাহর এই অপরিণামদর্শী বক্তব্য পাকিস্তানের কফিনে প্রথম পেরেকটা ঠুকে দেয় ।

তরুণ শেখ মুজিব জানতেন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে চাই জনগণের সংগঠন । ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ । পরবর্তীকালে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয় । বাস্তবে ছাত্রলীগই ছিল নব্যসৃষ্ট পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল । ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যত আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে সামনের কাতারে থেকে তার নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ । তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো । ১৯৪৯ সালে তরুণ শেখ মুজিব ও অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ । ‘আওয়ামী’ শব্দটির অর্থ জনগণ । মুসলিম লীগ ছিল উচ্চবিত্তদের সংগঠন । সেখানে জনগণের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না । সুতরাং মুসলিম লীগের বিপরীতে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করানোর অর্থ হচ্ছে এবার একটি জনগণের সংগঠন তৈরি হলো, যারা জনগণের কথা বলবেন । সৃষ্টির পর হতে আওয়ামী লীগ তাই করে আসছে বা চেষ্টা করছে  । পরে প্রতিষ্ঠার পর ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ হতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয় যাতে সংগঠনটি একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।  আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটিতে শেখ মুজিবকে করা হয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক । তখন তিনি কারাগারে।

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এক পর্যায়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলি, গুলিতে ছাত্র হত্যার পরই পাকিস্তানের রাজনীতির বাঁক আবার পরিবর্তন হয় । ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন । এই নির্বাচন ছিল পূর্ব বাংলার বাঙালিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । একদিকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম লীগ আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সহ বাঙালিদের ছোট ছোট দল । প্রথম দিকে মুসলিম লীগকে মোকাবেলা করতে তেমন একটা সমন্বিত উদ্যোগ না থাকলেও ছাত্রদের প্রচেষ্টায় পূর্ব বাংলার সকল রাজনৈতিক দল মিলে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট । এর নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী । অনদিকে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ । যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ এই নির্বাচনে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করে মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী কত রকমের ষড়যন্ত্র করছে । তাঁদের সাথে ছিলেন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব । যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল ইস্যু ছিল ‘রাষ্ট্র ভাষা’ আর ‘পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’।

১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনই ছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা রাজনৈতিক দল জিন্নাহর মুসলিম লীগের পরিসমাপ্তি । সেই যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন তা হতে দেশটি আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সেখান হতেই শুরু বাঙালির একটির পর একটি রাজনৈতিক বিজয়গাথা লেখার ইতিহাস যার নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব, যিনি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা । তাদের সাথে কখনো কখনো যোগ দিয়েছে এই দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ ।

১৯৫২ এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এসেছে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন যার নেতৃত্বে ছিল যথারীতি এই দেশের ছাত্র সমাজ । শিক্ষা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান সরকার শরীফ কমিশন শিক্ষা নীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল । এর পর ১৯৬৮ সালে সূচিত হয় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন । তখন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে কারাগারে । সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় এই দেশের ছাত্র সমাজ। এক সময় সেই আন্দোলনের তোড়ে ভেসে গেল পাকিস্তানের লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খান । এটি ছিল জিন্নাহর পাকিস্তানের শেষ বাঁক পরিবর্তন ।  আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়লেন আর এক সেনা শাসক জেনালের ইয়াহিয়া খানের কাছে ।

তারপর সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয় । এত কিছুর পরও পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালিদের চিনতে ভুল করেছিল । পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি । তারপর আমাদের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় । বাঙালির ইতিহাসের যে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, তার পরিসমাপ্তি ১৯৭১ সালে । ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১ এই নয়টি পর্বে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন হয়েছে । প্রত্যেকটা বাঁক পার হওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি । তাকাতে হয়েছে সামনের দিকে নূতন গন্তব্যে আর অতিক্রম করতে হয়েছে বাঁক । আর এই দীর্ঘ যাত্রায় সব সময় জনগণের সাথে থেকেছে এই দেশের ছাত্র জনতা যার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ । আজ বিভিন্ন কারণে বা অজুহাতে অনেকে আন্দোলনের কথা বলেন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আওয়ামী লীগ বিহীন এই দেশে ১৯৪৭ পরবর্তীকালে কোন আন্দোলন সফল হয়েছে তারতো কোন নজির নেই ।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক