মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার : আফগানিস্তান কি গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে!

রূপন কান্তি সেনগুপ্ত »

১৯৭১ সালে আমাদের স¦াধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আফগান রাজতন্ত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এদেশের সাধারণ মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ের যোগান দিয়েছিল। আফগানিস্তানের পিপল্স ডেমোক্রেটিক পার্টি নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশকে দ্রুত স¦ীকৃতি দেয়। কিন্তু ২০১০ সালে আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশ সৈন্য না পাঠিয়ে ঐ সময় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন বিশেষ দূত রিচার্ড হোলব্রুকের অনুরোধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের আপামর জনগণ তথা সরকার একমত ছিল যে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট ছাড়া আফগানিস্তানে বাংলাদেশের সৈন্য পাঠাবে না। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত দেশ পুনর্বাসনে সহায়তা প্রদান করবে। যুদ্ধপরবর্তী আফগানিস্তান পুনর্গঠনে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। ব্র্র্যাকসহ ১৭০ টি বেসরকারি সংস্থা আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে চলেছে। আফগানদের শিক্ষার উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাহায্য করেছিল। তৎকালীন আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই নিজেও বাংলাদেশের এই অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগান আক্রমণ, ১৯৯২ সালে মুজাহিদিনরা কাবুল সহ অন্যান্য বড় শহর দখল নিলে দেশজুড়ে শুরু হয় ব্যপক গৃহযুদ্ধ। অতঃপর ১৯৯৬ সালে তালিবানি শাসন। অশান্ত এই জনপদের সাধারণ মানুষ জীবন বাঁচাতে শরণার্থী হিসেবে পাশর্^বর্তী দেশ পাকিস্তানে ও ইরানে আশ্রিত ছিল। আফগানি শিখ এবং আফগানি হিন্দুদের মতো জাতিগত সংখ্যালঘুরা প্রায়ই ভারতে চলে যায়। আফগানিরা বর্তমানে সিরীয় শরণার্থীদের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শরণার্থী গোষ্ঠী। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর তেহরিক-ই-তালিবান গোষ্ঠী পাকিস্তানি তালেবান দ্বারা পেশওয়ারের একটি স্কুলে সন্ত্রাসী হামলা চালালে ১৪৫ জনের মৃত্যু হয়। যার বেশিরভাগই স্কুলশিশু। আক্রমণের শিকার হওয়ার পরে ২০১৫ সালের দিকে পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের বিরুদ্ধে মারাত্মক হেনস্থা, শত্রুতা এবং আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। পক্ষান্তরে ইরানে আফগান শরণার্থীদের ব্যাপারে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল ধর্মীয় সহানুভূতির। ধর্মীয় সহানুভূতি দ্বারা ‘খোলা দরজার নীতিতে’ পরিচালিত হতো শরণার্থী আশ্রয়দান প্রক্রিয়া। আফগানরা ইরানে গ্যাস, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যরক্ষায় ভর্তুকিসমেত যেকোন শহরে যাতায়াত, কাজ করার সুবিধা পেয়েছিল। এবং আফগানরা অস্থায়ী বাসিন্দা কার্ড পায়।
২০০১ সালের শেষের দিকে তালেবান শাসন ক্ষমতাচ্যুতির পর ৫০ লক্ষেরও বেশি আফগান জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার এর মাধ্যমে পাকিস্তান ও ইরান হতে নিজ দেশে ফিরতে শুরু করে। অনেকে আবার নিজ দেশে না ফিরে অবৈধ পথে পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি জমাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং কেউ কেউ সফলও হয়েছে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পুনর্গঠন, জনগণের পুনর্বাসন ও অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা নিশ্চিতে কাজ করে চলেছে আফগান প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ ভুক্ত দেশগুলো ছাড়া ভারত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতে আফগানিস্তানকে সহযোগিতা করছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবেগজড়িত ছোটগল্প কাবুলিওয়ালার কথা স্মরণ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে বাংলাদেশীদের জন্য নিরাপদ পথ তৈরি করে দেওয়ার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে ভারত ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশ, ভারত ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক চলে যায় অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ-ভারত ও আফগানিস্তান এ তিন দেশই পাকিস্তানকে জঙ্গিবাদে সমর্থন ও মদদ দেয়ার জন্য দায়ী করে আসছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এরূপ দোষারোপ করেছে তিন দেশ যারা পরবর্তীতে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে আয়োজিত সার্ক শীর্ষ সম্মোলনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
আফগানিস্তানে তালেবান ও অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছিল প্রায় ২০ বছর ধরে। এতদসত্ত্বেও অধিকাংশ আফগান ছিল সংস্কৃতিমনা। তারা সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় ব্যাপক পারদর্শিতার প্রমাণ দিয়ে চলেছে। আফগানিস্তানের গল্পগাথা বলার শিল্প এখনও সগৌরবে বিরাজমান। ব্যাপক নিরক্ষরতার কারণে এই শিল্পটি হারিয়ে যায়নি। সঙ্গীতের সাথে লোকগাথা বর্ণনা করার ঐতিহ্য আজও আদৃত। এই লোকগাথাগুলো বর্তমানের আফগানদেরকে অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। আফগান জীবনের সমস্ত দিক নিয়ে এই গাথাগুলো রচিত এবং এগুলোর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ, বিশ^াস ও আচরণ শিক্ষা দেওয়া হয়। আধুনিক আফগান সাহিত্যে আধুনিক বিশ্বের নানা ধারণা স্থান পেয়েছে। তবে গৃহযুদ্ধ ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর কারণে সংস্কৃতি চর্চা অনেকাংশেই ব্যাহত হয়। তালেবান আমলে দেশটিতে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া, সংস্কৃতি চর্চা, শিল্পচর্চায় অনেক নিষেধাজ্ঞা ছিল। তালেবান পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। কিন্তু দেশটির সরকার সম্প্রতি নির্দেশ দিল বয়স ১২ বছরের উর্ধ্বে গেলে কোন মেয়ে গান করতে পারবে না। প্রকাশ্যে কোন সংস্কৃতি চর্চা করতে পারবে না। দেশটির শিক্ষামন্ত্রী রঙ্গিনা হামিদি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আফগান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, একমাত্র শতভাগ নারীর সমাবেশে নারীদের গান গাওয়ার অনুমতি আছে। কিন্তু পুরুষদের সামনে কোনভাবে গান গাওয়া যাবে না। পুরুষ গানের শিক্ষকরাও স্কুলে বা অন্য কোথাও মেয়েদের গান শিখাতে পারবেন না।
আফগান প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে তালেবানের শান্তি বৈঠক চলছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরণের কড়া নিষেধাজ্ঞা ও পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে আফগান সরকার। তালেবানের প্রভাব ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে দেশটিতে। গান গাইলে শাস্তি। তালেবান আমলের সেই আইন আবার ফিরে এলো আফগানিস্তানে। যিনি এই নির্দেশটি জারি করেন সেই শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন একসময়ের নারী আন্দোলনের কর্মী। যার হাত ধরে নারীরা তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ঘটল উল্টোটা। আফগানিস্তানে বাইরের অপরিচিত মানুষের কাছে মেয়েরা তাদের নাম গোপন রাখতে বাধ্য হয় পরিবার তথা সমাজের চাপে। এমনকি ডাক্তারের কাছেও নাম বলা যাবেনা। একটি কন্যা সন্তান জন্মের বহুবছর পর্যন্ত তার কোন নামই থাকেনা। একটি মেয়ের যখন বিয়ে হয় বিয়ের আমন্ত্রণপত্রে কোথাও তার নাম উল্লেখ করার নিয়ম নেই। সে যখন মারা যায় তখন তার মৃত্যু সনদেও তার নাম লেখা হয়না। কবরের স্মৃতিফলকেও সে নামহীন থাকে। এই কাহিনীগুলো অবাক করার মত কিন্তু এটাই আফগানিস্তানের নারীদের স্বাভাবিক চিত্র। নারীদের সাধারণত পরিচয় দেয়া হয় পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষদের সাথে তার সম্পর্কের সূত্র ধরে। যেমন : অমুকের মা, অমুকের বোন বা অমুকের স্ত্রী। আফগান আইন অনুযায়ী শিশুর জন্ম সনদে শুধু বাবার নাম নথিভুক্ত করার বিধান আছে।
আফগানিস্তানের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের পরিচিতিকে স¦ীকৃতি না দেওয়ার প্রধান কারণ হলো পুরুষরা তাদের ‘সম্মান রক্ষায়’ নারীদের সারা শরীর ঢেকে রাখতেই শুধু বাধ্য করেন না তারা চান ‘মেয়েদের নামও ঢেকে রাখতে’। প্রায় দুই দশক আগে তালেবান গোষ্ঠীর পতনের পর থেকে আফগানিস্তানের নারীদের প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা হয়েছে দেশের ভেতর এবং বাইরে থেকে। কিছুটা সফলতার মুখও দেখেছিল আফগান সংস্কৃতি কর্মী, নারী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীরা। নিজের নাম লেখার অধিকারের জন্য “হোয়ার ইজ মাই নেইম?” নামে আন্দোলনে নেমেছেন কিছু নারীবাদী সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পোস্টারে এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছেন আন্দোলনকারী নারীরা। গত দুই দশকে নারী অধিকারসহ নানা বিষয়ে বেশ কিছু সফলতা এসেছে। আফগান রক্ষণশীল সমাজের নারীরা এখন সেনাবাহিনী, পুলিশ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, সাক্ষরতার হার বেড়েছে, দারিদ্রের হার কমেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সব সূচকে নি¤œগতি পরিলক্ষিত হয়। নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি, আন্তর্জাতিক সহায়তা কম আসা এবং তালেবানদের সাথে আপোষ এসব অন্যতম কারণ বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
এরই মধ্যে ঘোষণা এলো আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের। এই ঘোষণায় স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে, আফগানিস্তান কি আবার তালেবান শাসনে ফিরে যাচ্ছে? আফগানিস্তানে নারী অধিকার আবার কি হোঁচট খাচ্ছে? নারী সেনা, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে? আবার কি আফগান নারীরা উপেক্ষিত, নিষ্পেষিত এবং অবহেলিত হবে?
আফগানিস্তানের বর্তমান শাসন কর্তৃপক্ষ ও তালেবানদের মধ্যে শান্তি আলোচনার ফলাফল আফগান সমাজে কি পরিবর্তন আনে তা দেখার বিষয়। আফগান নারীরা কি আবার ঘরবন্দি হবে, সাহিত্য ও সঙ্গীতের সৃজনশীলতা হারিয়ে দেশটি কি রুক্ষ, কঠিন, প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক আবহাওয়ায় নিক্ষিপ্ত হবে? আফগান কর্তৃপক্ষ ও তালেবানদের শান্তি আলোচনায় জাতিসংঘের ভূমিকা থাকা চাই।
লেখক : কলামিস্ট, সমাজকর্মী