মাতৃভাষায় চর্চা : কী করতে হবে

মোহীত উল আলম »

সকালে এক বন্ধু একটি ভিডিও পাঠালো মেসেন্জারে। খুলে দেখলাম রাধারমন দত্তের বিখ্যাত গান “ভ্রমর কইও গিয়া”-র একটি চমৎকার সংস্করণ। তাজাকিস্তানের ভাষায় গাইছে সে দেশেরই এক তরুণী শিল্পী নোজিয়া কারামাতুল্লাহ। আমি এ লেখাটা লিখছি ৩০ জানুয়ারির সকালে। একদিন পর থেকেই অমর ভাষার মাস শুরু। তখন দেখলাম বাংলা সংস্কৃতিতো বিশ্বের বহু দেশে পরিচিত হয়ে উঠেছে, যেমন তাজাকিস্তানে। অমর একুশের বিরাট অবদান এখানে যে একটি অঞ্চলভিত্তিক ভাষার বিশ্বপর্যটন চলছে। একটি অঞ্চলভিত্তিক সংস্কৃতিরও বিশ্ব পর্যটন চলছে।
পাঠকের মনে একটি প্রশ্ন উদিত হতে পারে। ওপরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তার হিসেবে নোজিয়া কারামাতুল্লাহ্র যে উদাহরণ দিলাম, তাতে তো ভাষার তর্জমাকৃত রূপই পেলাম, মূল ভাষাটাতো পেলাম না। অর্থাৎ তিনিতো গানটি কাজাকিস্তানের ভাষায়ই গেয়েছেন, মূল বাংলা ভাষায়তো গান নি। কারণ ইদানীং ফেইসবুক এবং মেসেন্জারে অনেক ভিডিও পাচ্ছি, যেখানে বিদেশী শিল্পীরা নিজেদের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান বাংলা ভাষায় পরিবেশন করছে স্বচ্ছন্দে। সে দিক থেকেতো নোজিয়ার উদাহরণ এক ধাপ পেছনে। আমার উত্তরটা আসবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
আমরা ১৯৫২ সালের ফেব্রয়ারিতে ভাষার অধিকারের আন্দোলনটা তুঙ্গে নিয়ে যাই বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে অধিষ্ঠিত করার জন্য। সালাম, রফিক, বরকত, শফি এঁরা পুলিশের গুলিতে নিহত হবার পর শুধু শহীদ হন নি, বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী মর্যাদা নিয়ে এসেছেন যে আজকে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সে যাই হোক, ‘৫২ সালের আন্দোলনটা ব্যাপকভাবে উর্দু ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে হবার কথা থাকলেও হয়েছিল ইংরেজির বিরুদ্ধে। কারণ জিন্নাহ গুরুতর বাস্তবতা অস্বীকার করে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানের দু’টি ব্যাপক বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত প্রদেশের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও ভাষাগত সংযুক্ততা রক্ষার্থে তিনি এ প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। কিন্তু এটি ছিল একটি তাত্ত্বিক চিন্তা, যার বাস্তব অনুসরণের জন্য প্রেক্ষাপট সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। কারণ কিছুমাত্র পশ্চিম-পাকিস্তানী ব্যবসায়ী ও তাদের দোকানপাট ও ব্যবসাকেন্দ্র ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনপদে কোনকালেই উর্দু ভাষার ব্যবহার ছিল না। কিন্তু সদ্য বিদায়ী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভাষা ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহার তখনও ছিল, এবং এই স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছর বয়সেও বলা যাবে না যে ইংরেজির ব্যবহার কমে গেছে বা বাংলা ভাষার দ্বারা এর ব্যবহার প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
ফলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন মূলত জিন্নাহ্ ঘোষিত উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা নিয়ে পরিচালিত হবার কথা থাকলেও, উর্দু ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের অনুপস্থিতির কারণে এবং অন্যদিকে, ইংরেজি ভাষার ব্যাপক উপস্থিতির কারণে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়। এবং এই রীতি চলতে থাকলে, অর্থাৎ প্রতি বছর অমর একুশে পালনের প্রাক্কালে ও সময়কালে যে জিনিষটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে সেটি হলো ইংরেজি সাইনবোর্ড নামিয়ে দিয়ে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া। বস্তুত, পাকিস্তানের শেষের দিকে আমরা যখন কৈশোরকালীন সময় পার করছি, তখনও বিপুল উৎসাহে আমরা যে কাজটি করতাম, সেটি হলো প্রচুর ক্ষোভ নিয়ে ইংরেজি ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ড, ব্যানার, নামফলক উপড়ে নেওয়া। ’৫২ সালের পর পাকিস্তান এখানে আরও ১৯ বছর টিকেছিল, এবং ঐ সময়ে আমরা মাতৃভাষা বাংলার সর্বস্তরে চালুর প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে মূলত ইংরেজি ভাষার ব্যবহারের বিরুদ্ধে কামান দাগতাম।
এই যে ‘সর্বস্তরে চালু’ কথাটা বললাম, এটাই আসলে আমার আজকের আলোচনার মূল বিষয়। অত্যন্ত হা হুতাশ করে বলতে হয়, বাংলা ভাষা এত যুগ পরেও সর্বস্তরে চালু হতে পারে নি। আমি বছর কয়েক আগে অনুরূপ একটা লেখায় বাংলাভাষা কেন সর্বস্তরে এ যাবৎ চালু হতে পারেনি, তার ব্যাখ্যায় ফরাসী দার্শনিক এবং ঐতিহাসিক আর্নেস্ট রেনানের বিখ্যাত প্রবন্ধ “ওয়াট ইজ আ নেইশন?”-র (১৮৮২) বক্তব্যের অনুসরণে বলেছিলাম যে একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনে ভাষা, ধর্ম, ভূগোল, ইতিহাস কিছুই মৌলিক উপাদান হিসেবে কাজ করে না। ভাষার ক্ষেত্রে বলেছিলাম যে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের যোগাযোগের ভাষা এক আরবি হলেও, তাতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপস্থিতি দেখা যায়। ধর্মের ক্ষেত্রেও মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত এবং নেপাল, কিংবা চীন, ভিয়েৎনাম, কোরিয়া ইত্যাদি দেশের উল্লেখ করে বলেছিলাম ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম যাই হোক না কেন, ধর্ম এক হলেও কিন্তু দেশ ভিন্ন। এ দিক থেকে পাকিস্তান ছিল বড় একটা উদাহরণ। দ্বি-জাতি তত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হবে, কিন্তু বাংলাদেশ জন্ম লাভ করার পর ঐ তত্ত্বের অসারতা প্রমাণিত হয়। সেরকম ভূগোল বা ইতিহাসও। ভারতবর্ষ বহু বছর ধরে একই ভূগোল এবং একই ইতিহাস শেয়ার করছে, কিন্তু রাষ্ট্র জন্মালো একাধিক। ভারতবর্ষ বা বৃহত্তর রাশিয়া আরেকটি দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এই দুটি দেশের মধ্যে অভ্যন্তরস্থ বহুজাতিক এবং বহু জাতীয় স্তরের ভাষা বিদ্যমান, কিন্তু দেশ একটিই। ভারতের জাতীয় ভাষাগুলি, যেমন বাংলা, পাঞ্জাবী, উর্দু, হিন্দী, মারাঠি ইত্যাদির মধ্যে কোন ভাষা সাহিত্যে এবং ব্যাপকতার দিক থেকে একটি আরেকটির চেয়ে কম নয়, কিন্তু ভারত টিকে আছে একটি দেশ হিসেবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রেনানের ব্যাখ্যাটা নেওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন যে একটি দেশ, বা তাঁর ভাষায় ’ন্যাশনালাইট’, ইংরেজিতে ‘নেইশানহুড’, টিকে থাকে একটি বৃহত্তর সম্মতি বা কনেসেন্ট-এর ওপর ভিত্তি করে। যেমন, আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি সবগুলিই বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে আলাদা, কিন্তু তারা এই মানসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের অন্তর্গত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয়তা বরণ করে টিকে থাকবে।
এই ‘সম্মতি’র আলোকে বলতে হয় একটি দেশের ভাষা বা একটি জাতির ভাষা সে দেশের অস্তিত্বের জন্য কোন আবশ্যকীয় উপাদান নয়। কথাটা শুনলে খারাপ লাগলেও, সত্যটা হলো সর্বস্তরে একটি মাতৃভাষা পুরোপুরি চালু হবে এ কথাটা যতোটা না সত্য তার চেয়ে বেশি মিথ। যদিও দেশে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালু করার ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ আমরা বলতে পারি যে পশ্চিমা এককালীন সাম্রাজ্যিক, প্রশাসনিক ও কিছুটা সামাজিক ভাষা ইংরেজি বাংলাভাষা সর্বস্তরে চালু করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়, কিংবা উত্তরাধুনিক যুগে ধর্মীয় চেতনার বিশ্বব্যাপী নতুনভাবে উদ্বোধনের পর আরবি ভাষাও মোটামুটিভাবে মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে ব্যাপকভাবে চর্চিত হবার উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছে, এবং কোথাও কোথাও এই ভাষা ব্যবহারের মধ্যে সামান্যতম হলেও মৌলবাদী চেতনার বিকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে, কেন না যেখানে আগে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় সুন্দর বাংলা শব্দ প্রয়োগ করে আমরা যোগাযোগ স্থাপন করতাম সে জায়গায় অনাবশ্যকভাবে বহু বিজাতীয় শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা সকল স্তরে লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে গেছে।
তাই বলে কি বাংলা ভাষা ব্যবহারের পরিমাণ বা মাত্রা কমে যাবে? ধরুন হিমালয় পর্বতের চূড়াগুলিতে বরফ গলা শুরু হয়েছে। তাই বলে কি এ পর্বতগুলি মানবসমাজের দৃশ্যমান জীবিৎকালে গলতে গলতে পামীর মালভূমি হয়ে যাবে? বা আরেক দিক থেকে বলি, আমরা কি রবীন্দ্রনাথকে কখনও কিয়দংশও ব্যবহার না করে পারবো?
যেটা আমাদের চেতনায় আনতে হবে সেটা হলো প্রযুক্তিগত যুগে বাংলাভাষার ‘সর্বস্তরে চালু’ করার বাসনা বাদ দিয়ে বাংলাভাষাকে সর্বভূক একটি ভাষায় পরিণত করতে হবে। ইংরেজি যেমন পৃথিবীর বহু ভাষাকে আত্মস্থ করে নিজের পরিক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করছে, ঠিক তেমনি বাংলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রেও এই জাতীয় প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনার জায়গা দিয়ে কৌলীন্যপ্রথাকে সর্বোত পরিত্যাগ করে একেবারে তাৎক্ষণিক এবং সার্বক্ষণিক প্রয়োজন মেটায় সে রকমের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তৈরি করতে হবে।
শুধু যে বিদেশী ভাষা এবং প্রকরণ অকাতরে গৃহীত হবে তা নয়, আঞ্চলিক ভাষাও যে একটি জাতীয় ভাষাকে সমানে পরিপুষ্ট করতে পারে তারও হাজার হাজার নজীর আমাদের ভাষাতেই বিদ্যমান।
রাষ্ট্র চলে একটি জঙ্গম পন্থায়, এবং সে জায়গায় রাষ্ট্রের ভাষার মধ্যেও জঙ্গমতা বা চলিষ্ণুতা থাকতে হবে সর্বোচ্চ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে বাংলাভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, বা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও দিয়ে থাকেন, সেদিক থেকে বাংলাভাষার মর্যাদা বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থানে সংরক্ষিত, কিংবা অমর একুশে যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, সেটিও আমাদের বিরাট প্রাপ্তি। এগুলিকে পাথেয় করে আমরা ঐতিহাসিক চেতনায় ঋদ্ধ হতে পারি, কিন্তু আমি যে কথাটি বলতে চেয়েছি, সেটি হলো কোনরকমের আত্মশ্লাঘাতে না ভুগে স্পেডকে স্পেড বলাই ভালো।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা, ইংরেজি কিংবা আরবি কোনটিতেই কেমনভাবে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষিত হচ্ছে সেটি আমার জানা নেই, কিন্তু এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি যে বাংলাদেশ যেহেতু সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে, সে জন্য নীচের দিকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাষা শিক্ষার সহজ, আধুনিক, ও প্রায়োগিক দিকসমূহ সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষকসমাজকে তৈরি করা হবে, কিংবা হচ্ছে।