মহালয়ার সুর

অরূপ পালিত »

শেফালীর আনন্দহীন জীবনে শরতের স্নিগ্ধতা অনেকটাই অধরা। ওর ভাগ্যটা সব সময় যেন পেছনেই টানে। ভোরের আলো ফোটার আগে দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের শব্দ। জানান দিচ্ছে পূজা আসছে।

আজকে শরতের আকাশ, নদী, ফুল সবই শান্ত। কয়েকদিন পরে নিশুতিরাত একটু গড়ালে নস্টালজিক ঢাকের শব্দগুলো হৃদয় ভাঙে। মেয়েদের কাছে ও আনন্দ নেই। ওরা তো জানে নতুন জামা দেয়ার লোকও নেই।

গত দুর্গাপূজার সময়ে ষষ্ঠীপূজার দিন শ্বশুর ফোন করে বলেছিল মেয়ে দুটোকে নিয়ে বাড়িতে আসতে। শেফালি না বলাতে শ্বশুর রাগ করেছিলেন। না বলার কারণও শ্বশুর জানতেন। টানাটানির সংসারে যে পয়সা খরচ করে বাড়িতে যাবে সেই পয়সাগুলো দিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে কিছুদিন চলেযাবে।

শ্বশুর শেফালিকে বলেন মারে, আমার শরীরের যে অবস্থা। সামনের বছর হয়তো আমি আর থাকবো না। আমার নাতনিদের নিয়ে অঞ্জলি নিতে পারবো না। তোদেরকে বাড়িতে আসার জন্য আর কেউ বলারও থাকবে না। তখন তোরা আসতে চাইলেও মন বাড়িতে টানবে না। একবার ঘুরে যা না মা। শেফালি শ্বশুরের কথা কোনদিন অমান্য করেনি। কারণ উনি এই বয়সে পুত্র শোকে মুহ্যমান।

আজ সত্যি হলো শ্বশুরের কথা। এই বছরে শেফালির বাড়ি যাবার তাড়া নেই। কাশফুলের কোমল শুভ্রতায় হেসে উঠবে না মেয়ে দুইটা। গত ফ্রেব্রয়ারিতে শ্বশুর না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

শেফালিরা গত বছর পূজাতে বাড়ি যেতে পারেনি। পুজোর দিনে সব্যসাচীর চিতায় আর বাতি জ্বলেনি। এই বছরও অন্ধকারে কাটাবে সব্যসাচীর আড়াই হাত মাটির নিচে।

শ্বশুরের কথায় গত বছর সপ্তমী পূজার দিন মেয়ে দুটোকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল শেফালি। অর্ধেক পথে গিয়ে শুনতে পায় শেফালির ভাসুর অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। তাঁকে গ্রাম থেকে শহরে আনা হচ্ছে। সবাই ধরে নিয়েছেন মৃত। কারণ পৌরসভার মেডিকেল বলে দিয়েছে আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।

প্রতি বছর পূজা আসলে সব্যসাচীর একটাই কাজ ছিল শেফালির জন্য লাল গরদের শাড়ি কেনা। সাথে আলতা আর লালরঙের কাচের চুড়ি। সারাদিন সাজতো বলে শ্বশুর গ্রামের হাট থেকে লালফিতে এনে দিতেন। আজকে লালসিঁদুরের সাথে লালরংটা বুকের মধ্যে ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শেফালির কাছে নিজের রুমটাতে গেলে বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। সব্যসাচীর সাথে এই রুমে বসে কত খুনসুটি করতো। সে বড় দুষ্ট ছিল। পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরতো। এই ঘরে মনে হয় সব্যসাচীর হাঁটার শব্দ আসে। সেই শব্দে হৃদয়ের পাঁজর ভেঙে যায়। দুচোখ বেয়ে নেমে আসা জলে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। সব্যসাচীর অনুপস্থিতিতে সপ্তমীতে শিউলিফুলের সুবাস আসে না নাকের ডগায়।

অষ্টমী পূজায় আর অঞ্জলি নেয়া হয় না। অষ্টমীর উপবাসে কষ্ট হচ্ছে কিনা বলার মতো লোক যে ছেড়ে চলে গেছে। নবমীর দিন সকাল থেকে তাগাদা দিতো শেফালিকে সন্ধ্যায় সব্যসাচীর ধুনুচি নাচ দেখতে হবে। আলতা আর লালশাড়ি পরে তৈরি থাকবে। আজকে পূজাতে যেতে হবে! বলবার লোক নেই। প্রতিবছর সব্যসাচী ধুনুচি নাচে পাড়ার ক্লাবে প্রথম হতো।

এখন দশমীতে যখন মাকে বিসর্জন দিতে যায় শেফালির বুকের মধ্যে যেন আগুন জ্বলে। লোকচক্ষুর আড়ালে এসে আয়নার সামনে নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখে, কপাল খালি। বড় করে দেওয়া টকটকে লালসিঁদুর আর পরতে পারবে না। হাতের ধবধবে সাদা শাঁখা নিয়ে গেছেন দেবী দুর্গা মা। সেই বছর দশমীতে মাকে বিসর্জন দিতে গিয়ে সব্যসাচী যে আর ফেরেনি। সব্যসাচী মায়ের বুকের নিচে চাপা পড়ে শেফালি এবং দু-সন্তানকে ফেলে রেখে মার সাথে চলে গেছে। মা কি মনে-মনে এই চেয়েছিলেন? সেইদিন মা’র চলে যাবার সাথে শেফালির শাঁখা-সিঁদুরও নিয়ে গেছেন। শেফালি কি পাপ করেছিল? দশমীতে মাকে বিদায় দেবার আগে সিঁদুর ও তৈল দিয়ে ধরাধাম থেকে  কৈলাসে পাঠিয়েছিল। যাতে সামনের বছরে আবার মা‘র সাথে সিঁদুর দিয়ে খেলতে পারে।

আজকে খালি কপালে মায়ের সামনে যাবে কী করে? সিঁদুরের সাথে নিজের মনকেও যে বিসর্জন দিয়েছে।