ভ্রাম্যমাণ খাবারে স্বাস্থ্যঝুঁকি

হুমাইরা তাজরিন »

বাঙালি ভোজন রসিক সেকথা কে না জানে। কিন্তু স¦াস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ভোজনের প্রবণতা বাড়ার কারণকে উস্কে দিচ্ছে নগরীর ফুটপাত দখল করে বসা ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানগুলো।মুখরোচক কিন্তু অস্বাস্থ্যকর এসব খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে রমরমা এসব ব্যবসা।

ভ্রাম্যমাণ এসব দোকানউন্মুক্ত স্থানে হওয়ায় এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। রেস্তোরাঁগুলোতে এ ধরনের খাবারেরব্যবস্থা থাকলেও দাম বেশি হওয়ার কারণেঅনেকে বাধ্য হয়েই এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানে যান। কেবল খোলা স্থানেই নয়, নগরীর নালা নর্দমাঘেঁষেও বসেছে এসব ভ্রাম্যমাণ দোকান। নগরীর মুরাদপুর থেকে জিইসি মোড় অব্দি ফুটপাতে থাকা ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো সরেজমিনে প্রদর্শন করে দেখা যায় প্রায় সবগুলো দোকানই নালার কোল ঘেঁষে রয়েছে। সারাদিনই সেখানে বিকিকিনি চলে। মধ্যবিত্ত হতে শুরু করে নি¤œবিত্ত মানুষ কাজের ফাঁকে এসব দোকান হতে খাবার কিনে খাচ্ছে। সারাদিনই নালার পাশে রাখা উন্মুক্ত ড্রামের পানিতেই ধোয় হচ্ছে কাপ-পিরিচ।ভালোভাবে না ধোয়ার কারণে কেবল খাবার নয়, পরিবেশন পাত্র থেকেও মারাত্মক রোগ জীবাণু ছড়ানোর ঝুঁকি থাকছে।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপারেন্টটেন্ড ইনসাফি হান্না বলেন, ‘প্রতিদিনই ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত অনেক রোগী ভর্তি হয়। গত বছরে চমেকে কেবল ডায়রিয়ার ৪৪৩জন রোগী ভর্তি হয়েছে।চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৮ তারিখ অব্দি ১৫৮জন ভর্তি হয়েছে।যা গত বছরের মোট রোগীর প্রায় ১তৃতীয়াংশ।

স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে জেনেও কেন এসব খাবার খাচ্ছে মানুষ,এ প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ মামুন নামের এক ক্রেতা বলেন,‘খুব মজা লাগে এজন্য ডেবারপাড় থেকে এখানে এসেছি খেতে। স্বাস্থ্যসম¥ত না জানি, তারপরও কি করার; কম দামে মজাদার খাবার তো পাওয়া যায় না রেস্তোঁরায়। তাছাড়া প্রতিদিন তো খাইনা, হঠাৎ কখনও ইচ্ছে হলে খাই।’
পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার রেদওয়ান পুরি সালাদ খেতে খেতে বলেন, ‘প্রথম কথা মুখরোচক।সবজায়গার সবকিছু মজাদার হয়না। দ্বিতীয় কথা দামও হাতের নাগালে থাকেনা। তাই বাধ্য হয়ে এসব খেতে হয়।’

মুরাদপুর এলাকায় মেসি ও এপি মারমা দুই বান্ধবী মিলে মুড়ি ছোলা খাচ্ছিলেন। মেসি বলেন, ‘বিকেল বেলা একটু ঝাল খাবার খেতে মন চায়। এখানে মুড়ির সাথে ছোলা মাখিয়ে পরিবেশন করাটা বেশ মজার।’

জিইসি মোড় ফ্লাইওভারের নিচে ফুটপাত সংলগ্ন ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো সম্পর্কে শুভ্র নামের একজন বলেন,‘এখানে রোজ হাজার হাজার মানুষ এসব স্ট্রিটফুড খেতে আসে। এটি মূলত অফিস পাড়া। তাছাড়া এখানে বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টার রয়েছে,হাজার হাজার শিক্ষার্থী রোজ ক্লাস বা ক্লাসের ফাঁকে এখানের খাবার খেতে আসে। আশ পাশে আর তেমন কোথাও এতো কম দামে এসব মুখরোচক খাবার বিক্রি হয়না।তাই বাধ্য হয়েই নালার পাশে গড়ে উঠা এসব দোকান থেকে খাবার খেতে হয়। আরেকজন বিক্রেতা বলেন, ‘আমি আমার ভ্রাম্যমাণ দোকানটার ভাড়া দেই মাসে ১৫ হাজার টাকা। এখানে যেভাবে কাস্টমার পাই সেভাবে আর কোথাও দোকান নিয়ে বসলেও পাবোনা।’

এসব খাবার সম্পর্কে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. অনুপম বড়–য়া বলেন ,‘বাইরের খাবারে বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের ঝুঁকি থাকে। পানিবাহিতরোগগুলো যেমন ডায়রিয়া,টাইফয়েড,আমাশয় এসব রোগ তো হচ্ছেই। তবে একই তেলে বারবার ভাজার প্রক্রিয়াটা সবচেয়ে ভয়াবহ।একই তেল বার বার ব্যবহার করলে ক্ষতিকারক ট্রান্সফ্যাট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একই তেল বার বার গরম করলে ফ্যাট মলিকিউল ভাঙতে শুরু করে। এতে করে বাজে দুর্গন্ধও ছড়ায়।কড়া ভাজার কারণে দূষিত হয়ে যাওয়ার ফলে এমনটা হয়। সেই দূষিত উপাদানগুলো দেহের মাঝে ছড়ায় এবং রোগ-ব্যাধি হতে পারে। এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় যার ফলে শিরা উপশিরা ব্লক হয়ে যায়। রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এসব তেলের খাবার খেলে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ে,হৃদরোগ দেখা দেয়, আল ঝেইমার্স (স্মৃতিভ্রম),কিডনি জনিত সমস্যাওদেখা দিতে পারে। তাছাড়া আলসার, এসিডিটি তো আছেই।

চট্টগ্রাম ডায়বেটিক হাসপাতালের পুষ্টি কর্মকর্তা পুষ্টিবিদ মো.ইকবাল হোসেন বলেন,‘রাস্তার পাশে বলেন আর ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট বলেন সবখানেই কমবেশি এ ধরনের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। তাদের পরিবেশন যতই সুন্দর হোক না কেন, রান্নাঘরের পরিবেশটা ততোটা স্বাস্থ্যকর নয়। এজন্য বিভিন্ন অভিযানে তাদের জরিমানা করা হয়। এসব খাবার গ্রহণ করার ফলে কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হয়। তাদের ব্যবহার করা সল্টের(লবণ ) কারণে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বাড়তে পারে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর চট্টগ্রামে কর্তব্যরত এক কর্মকর্তা জানান, ‘এসব বিষয়ে তদারকির জন্য চট্টগ্রামেরদায়িত্বে আছেন ৩জন কর্মকর্তা। কিভাবে সম্ভব বলেন?এরকম কোনো অভিযোগথাকলে আপনি মেইলে জানান,গুরুত্বর্পূণ মনে করলে আমরা উদ্যোগ নেবো।’

মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন,‘আমি ইতোমধ্যে আগ্রাবাদ নয়াবাজার ইপিজেড থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত অবৈধভাবে রাস্তা ফুটপাত দখল করে বসা অনেক দোকানপাঠ উচ্ছেদ করার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু দেখা যায়, ৮-১০দিন পর পুনরায় এরা ফিরে আসে। আমি শীঘ্রই নালার পাশে ফুটপাত দখল করে গড়ে উঠা এসব ভ্রাম্যমাণ দোকান উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিচ্ছি।’