ভারতের রাজনীতিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

আবদুল মান্নান »

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিম বঙ্গে রাজ্যবিধান সভার নির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচন শেষ হবে এই মাসের ২৯ তারিখ। বর্তমানে এই রাজ্যে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন। পশ্চিম বঙ্গে তিনি সর্বাধিক পরিচিত দিদি অথবা পিসি হিসেবে। বাংলাদেশেও তিনি বেশ পরিচিত। শেখ হাসিনা তাঁকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করেন। তৃণমূল হতে ২০১১ সালে নির্বাচিত হয়ে তিনি পশ্চিম বঙ্গে বাম ফ্রন্টের দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের শাসনের অবসান ঘটান। চলমান নির্বাচনে তৃণমূলকে পরাজিত করতে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি আপ্রাণ চেষ্টা করছে । বলতে গেলে একটি রাজ্যবিধান সভার নির্বাচনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে শুরু করে কেন্দ্রিয় মন্ত্রিসভার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গ চষে বেড়াচ্ছেন। এদের মধ্যে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও আছেন। ২০১৪ সাল হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি বিজেপি’র সভাপতিও ছিলেন ।
এই নির্বাচনে রাজ্যের ভোটাররা যাকে যোগ্য মনে করবে তাকে নির্বাচিত করবে। নির্বাচন এলে রাজনীতিবিদরা অনেক কথা বলে যার কোন কোনটা আবার লাগামহীন ও অশোভন হয়ে যায় যা দলের তৃতীয় সারির নেতা কর্মীরা বললে মেনে নেয়া যায় । কিন্তু যখন উপরের সারির নেতা নেত্রী বলেন তা তখন হয় চরম শিষ্টাচার বহির্ভূত আর বক্তব্যটা যখন অন্য আর একটি দেশকে নিয়ে হয় তখন তা দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্ক নষ্ট করে । গত কয়েক বছর ধরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কারণে, অকারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে সব অবান্তব, অসত্য, লাগামহীন কথাবার্তা বলে আসছেন তা মোটেও কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কথা হতে পারে না । শুধু অমিত শাহ নয় ভারতের আরো কিছু ছোটখাট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন, তারা সুযোগ পেলেই এই কাজটি করেন এবং তা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের চরম অজ্ঞতার পরিচয় দেন, বাংলাদেশকে অপমান করেন । তাদের কথা শুনে মনে হয় তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করেন না বা তারা কখনো বাংলাদেশে আসেননি। বাংলাদেশ সম্পর্কে বাংলাদেশের মিডিয়া বা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ বা দুই দেশের গবেষকরা কি বলেন, কি লেখেন তার খোঁজ খবর রাখলেও এই সব ব্যক্তিরা বাংলাদেশ নিয়ে এমন সব বেপরোয়া লাগামহীন কথা বলতেন না । আন্তর্জাতিক সংস্থা বা মিডিয়াকেও বাদ দিলাম, নিজ দেশের নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের বক্তৃতা বিবৃতি শুনলে বা পড়লেও তারা উপকৃত হতেন ।
পশ্চিম বঙ্গে নির্বাচনী প্রচার করতে গিয়ে অমিত শাহ বাংলাদেশ সম্পর্কে সম্প্রতি তার পূর্বের কিছু বক্তব্যের অপ্রাসঙ্গিকভাবে পুনরাবৃত্তি করেছেন । বলেছেন বাংলাদেশে খেতে না পেয়ে দলে দলে সেই দেশের মানুষ পশ্চিম বঙ্গ ও অন্যান্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করছে। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের হটিয়ে শরণার্থী-উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে । এর আগে তিনি বলেছিলেন, এই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা উই পোকার মতো । এমন বক্তব্য শুধু উস্কানিমূলক, অসত্য বক্তব্যই নয় বরং চরম সাম্প্রদায়িকও বটে । আর এই ধরণের সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের রেশ বাংলাদেশে এসে যে লাগতে পারে তা কি অমিত শাহ বা তার অনুসারীরা বুঝতে পারেন ? এর আগে ২০২০ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী জি কে রেড্ডি বলেছিলেন, সুযোগ দিলে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করবেন কারণ তারা নিজ দেশ খেতে পায় না ।
এর পূর্বে বাংলাদেশ নিয়ে এমন ধরণের কথা বলায় তার সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার প্রয়াত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী । তিনি বলেছিলেন অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বাঙালিরা সাঁতার কেটে ইউরোপ যাবেন কিন্তু ভারতে যাবেন না । দারিদ্র্যতা বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে একটি সমস্যা যেমন সমস্যা ভারতে । তারপরও বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (এষড়নধষ ঐঁহমবৎ ওহফবী) ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম আর ভারতের ৯৪তম । এই সূচক জার্মানি ভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতি বছর প্রস্তুত করে এটা দেখানোর জন্য, কোন দেশের মানুষ কি পরিমাণের ও মানসম্মত খাদ্য কিরূপ পায়। অর্থাৎ সোজা কথায় বললে বলা যায় কত সংখ্যক মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায় । এই যদি ভারতের অবস্থা হয় তা হলে কোন দূঃখে বাংলাদেশের মানুষ পেটে অন্ন দেয়ার জন্য ভারতে যাবে ? কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের পরিসংখ্যানে বলেছে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে আঠারো ডলার বেশি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশের লাগোয়ো ভারতের সাতটি রাজ্যের মাথাপিছু আয়ের সূচক প্রকাশ করেছে যার সূত্র ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও রির্জাভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া । দেখা গেছে এই সব রাজ্যের মাথা পিছু আয় কোনটাই বাংলাদেশের ধারেকাছে নেই। যে রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে এত হট্টগোল সেই পশ্চিম বঙ্গের মানুষের মাথা পিছু আয় ১,৫৬৬ ডলার আর বাংলাদেশের ১৯০৫ ডলার । এই হিসাব ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের(দৈনিক বণিক বার্তা, ১৬ এপ্রিল) । বর্তমানে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় ২০৬৪ ডলার আর পশ্চিম বঙ্গের ১৬০০ ডলার । বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে এখন তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে । মাছ, সব্জি, ডিম, দুধ, আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ । পশ্চিম বঙ্গের হতদরিদ্র মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষ রাস্তার পাশে ঘর সংসার পাতেনি । তারা বস্তিতে থাকে ঠিকই কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার মান মোটামুটি কিছুটা উন্নত । তাদের প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে । অনেকের বাড়িতে টিভি ফ্রিজও আছে । তারা বেশ পরিশ্রম করে । তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠায় কারণ বাংলাদেশ সরকার সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অনেক রকমের প্রণোদনা দিয়ে থাকে যা ভারতে অনেকাংশে অনুপস্থিত। বিশ্ব ব্যাংকসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ সামাজিক সূচকে ভারতের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে । কি দুঃখে বাংলাদেশিরা ভারতে অনুপ্রবেশ করবে ?
যারা একটা রাজ্যের বিধান সভার নির্বাচন নিয়ে এমন সব সস্তা কথা বলেন তারা কি জানেন, বাংলাদেশ ভারতের অর্থনীতিতে কতভাবে অবদান রাখছে? ভারতে প্রতি বছর প্রায় বাইশ লক্ষ পর্যটকের আগমন ঘটে যার মধ্যে প্রতি পাঁচজনের একজন বাংলাদেশী। ভারতের হাই কমিশনের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর বাংলাদেশ হতে পনের লক্ষ বাংলাদেশীকে ভারতে যাওয়ার ভিসা ইস্যু করা হয় । এদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যায় পর্যটন ও বাজার করতে। চিকিৎসার জন্য যায় তার সংখ্যা ও কম নয় । প্রতিজন যদি কমপক্ষে পাঁচহাজার ডলার ভারতে ব্যয় করে কত হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ হতে ভারতে যাচ্ছে তার কি কোন হিসাব আছে এই সব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের? সামনে ঈদ । প্রতি ঈদে প্রায় দেড় লক্ষ বাংলাদেশী শুধু কোলকাতায় যায় ঈদের বাজার করতে অথবা ছুটি কাটাতে। করোনা কালে তাতো বন্ধ থাকবে । তখন বিশেষ করে কোলকাতার নিউ মার্কেট এলাকার দোকানপাট, হোটেল রেস্তোরার কি হাল হয় তা বুঝা যাবে ।
বাংলাদেশে কত ভারতীয় বৈধ বা অবৈধ ভাবে কাজ করে তার কোন সঠিক হিসাব পাওয়া মুস্কিল । ২০১৯ সালে জবংবধৎপয ধহফ গরমৎধঃরড়হ গরমৎধঃড়ৎু গড়াবসবহঃ জবংবধৎপয টহরঃ (জগগজট) নামক ঢাকা ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ বলে হিসাব করেছে এবং এও বলেছে, তারা বছরে বাংলাদেশ হতে কমপক্ষে চার বিলিয়ন ডলার নিজ দেশে প্রেরণ করে । ভারতের বর্তমান সরকারের আমলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক কয়েকগুণ বেড়েছে। উভয় দেশ দুই দেশের মধ্যে সংযোগ (পড়হহবপঃরারঃু) বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ তার সমুদ্র বন্দরগুলো ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে ব্যবহার করতে দিয়েছে। বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে নদীপথে ভারতের পণ্য আসা যাওয়া করছে । রেল যোগাযোগ বেড়েছে । সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে । পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র তৎপরতা বন্ধ হয়েছে । এর চেয়ে ভারতের পাওনা আর কি হতে পারে? ভারতের রাজনীতি নিয়ে, তাও একটি রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের কোন মাথাব্যাথা নেই, থাকারও কথা নয় । সুতরাং ভারতের দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদগণ দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা না বললে দু’দেশের সম্পর্ক আরো জোরদার হবে । ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যা করেছে তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ তাদের কাছে সবসময় ঋণী । সেই জন্যই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক নিরন্তর উন্নত হওয়া জরুরি । বাংলাদেশ হতে অনেকে ভারতে বেআইনি পথে যায়। তার কারণ নানাবিধ। কেউ ব্যাংক হতে টাকা মেরে সেখানে আশ্রয় নেয়। কেউ আবার বড় কোন ফৌজদারি অপরাধ করে সেখানে আশ্রয় নেয় । আবার বেশ কিছু পরিবার আছে যারা ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর আর বাংলা ভাগ হওয়ার সময় পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকেই মনে করে তারা আবার পশ্চিম বঙ্গে গিয়ে তাদের পরিবারের সাথে এক সাথে থাকতে পারলে একটু ভাল থাকবেন । বাস্তবে তা সব সময় সঠিক হয় না । যে দেশ এগারো লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে পারে সেই দেশের মানুষ অন্য দেশে খাদ্যের সন্ধানে যাবে তা কেউ বিশ্বাস করবে না । দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের কথাবার্তা আরো সংযত হওয়া ভাল । বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব অটুট থাকুক, লাগামহীন কথাবার্তা বন্ধ হোক ।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক