বে-টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু হবে ২০২৬ সালে

জাহাজের বার্থিং উদ্বোধনে নৌ প্রতিমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক »

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে সর্বপ্রথম ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ বার্থিংয়ের উদ্বোধন আনন্দের ও গর্বের। আজকে চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে বড় জাহাজ ভেড়ানোর সময় আমরা উপস্থিত। এত বড় জাহাজের বার্থ নিশ্চিত করতে আমরা সমর্থ হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়াতে সাড়ে ৩ হাজার মিটারের বে-টার্মিনালের কাজ করা হচ্ছে। ডিপিপি কার্যক্রম শেষ হলেই বে-টার্মিনালের কাজ শুরু হবে। আশা করছি ২০২৬ সালে বে-টার্মিনাল অপারেশনে যাবে। পাশাপাশি ২০২৬ সালের শেষে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরও চালু হবে।’

গতকাল সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের চিটাগং কনটেইনার টার্মিনালের (সিসিটি) এক নম্বর জেটিতে ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ বার্থিং ও বন্দরের ভান্ডার ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক অন্যরকম। স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু যখন জেল থেকে বের হন তখন তাকে কিছু অপশন দেয়া হয়েছিল। তখন তিনি যুক্তরাজ্যকে বেছে নিয়েছিলেন। সেই থেকে ৫০ বছরের বাংলাদেশে আমরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছি। আগামীতে এ সম্পর্ক আরও ভালো হবে। দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এমনকি যে চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির চাকা হিসেবে খ্যাত, সে চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসেও যুক্তরাজ্যের ভূমিকা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ভেড়ানোর কাজে যে কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা করেছেন তারাও যুক্তরাজ্যের। চট্টগ্রাম বন্দর থেমে গেলে দেশ থেমে যায়। মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মাসেতুতে চট্টগ্রাম বন্দরের অবদান আছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন প্রসঙ্গ ও যুক্তরাজ্যের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৪ বছর বাংলাদেশের অগ্রগতির কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দরের উন্নয়ন নিয়ে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নয়, বন্দরের সকল অংশীজনদের দাবি সরকার গুরুত্ব দেয়। আপনারা বন্দরের উন্নয়ন নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইলে, কোনো উপদেশ দিতে চাইলে আমাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন। আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে না। এ বন্দরে উন্নয়নে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থা এইচআর ওয়েলিংফোর্ড কাজ করেছে। বর্তমানে বন্দরের ১৯টি জেটির মধ্যে ১৭টি চালু আছে। কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য ১৮টি গ্যান্ট্রি ক্রেন সচল আছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে পিসিটি (পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল) চালু হবে। আশা করছি, মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নিয়ে বে-টার্মিনালও আগামী ২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬ সালের শুরুর দিকে চালু করতে সক্ষম হবো।’

দেশের উন্নয়ন নিয়ে তিনি বলেন, ‘এক সময় বাংলাদেশের বাজেট প্রস্তাব করার আগে বিদেশি সংস্থার পেছনে পেছনে ঘুরতে হতো। এখন আর তা করতে হয় না। এখন দাতা গোষ্ঠী আমাদের পেছনে ঘুরে। বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এগিয়ে যেতে হবে। তলাবিহীন ঝুড়ি যারা বলেছে তারা এখন শুধরে নিচ্ছে। পদ্মা সেতু থেকে সরে গিয়ে বিশ্বব্যাংক এখন আফসোস করছে। বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। আমি বিশ্বাস করি, আগামী নির্বাচনে আরও বেশি জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে।’

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহানের সভাপতিত্বে এতে আরও বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের অতিথি ব্রিটিশ হাইকমিশনার এইচ আর রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন, বিশেষ অতিথি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল, চট্টগ্রাম চেম্বারের অব সভাপতি মাহবুবুল আলম, যুক্তরাজ্যভিত্তিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থা এইচআর ওয়েলিংফোর্ডের প্রতিনিধি ড. মনজুরুল কাদেও ও বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মো. আরিফ।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, ‘বহির্নোঙরে যে কার্গো লাইটারিং হয় সেই জাহাজগুলোকে এ সুবিধা দিলে ৪০-৪৫ হাজার টন পণ্য আনতে পারবে। গুপ্ত খাল খনন করা হলে আরও বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে আমাদের যে চুক্তি করতে হয় তার আর প্রয়োজন হবে না। বড় জাহাজের পাশাপাশি ছোট ফিডার জাহাজ বার্থিংয়ের সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে। কনটেইনার জাহাজের পাশাপাশি বাল্ক জাহাজকেও সুবিধা দিতে হবে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থা এইচআর ওয়েলিংফোর্ডের প্রতিনিধি ড. মনজুরুল কাদের বলেন, ‘আমাদের এ গবেষণাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। কেননা করোনার সময় এ গবেষণা কাজ করতে হয়েছিল। ২০২০ সালের নভেম্বরে গবেষণার জন্য বন্দরের সাথে চুক্তি হয়। আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে দুই বছর সময় লেগেছে। তবে আজ আমরা সবাই মিলে সফল হয়েছি। এটাই ভাল লাগছে। আমাদের গবেষণায় চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ভেড়ানোর কথা বলেছিলাম। আজ বড় জাহাজ ভিড়েছে এটিই বাস্তবতা।’

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর নব্বই দশকের আগে অনেক দুঃসময় কাটিয়েছিল। গত ১৪ বছর একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি এ বন্দর। করোনাকালেও এ বন্দর এক ঘণ্টার জন্যও বন্ধ ছিল না। এনসিটি তৈরির পর চার বছর কাজ হয়নি। এখন তা সচল আছে। এছাড়া কর্ণফুলী নদী বন্দরের প্রাণ। এ বন্দর সচল রাখতে কর্ণফুলী ড্রেজিং চালু রাখতে হবে। ঠিকভাবে ডেজিং হওয়ায় আজ বড় জাহাজ ভিড়ছে। এখন চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের প্রভাবশালী বন্দরের মধ্যে থ্রি মিলিয়ন ক্লাবের সদস্য। আশা করি, চট্টগ্রাম বন্দর চার মিলিয়ন কনটেইনার ক্লাবে যাবে। পিসিটি তৈরি আছে, যত তাড়াতাড়ি চালু হয় তত মঙ্গল। আর বে-টার্মিনাল হলে বাংলাদেশকে ৫০ বছর বন্দর নিয়ে ভাবতে হবে না।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘করোনাকালে চট্টগ্রাম বন্দরের ৫৪ জন লোক মারা গেছেন। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর এক ঘণ্টার জন্যও বন্ধ হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ঠিক রাখতে জন্য তারা প্রাণ দিয়েছেন। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আমাদের সবার একটা সফট হার্ট আছে। এটি সরকারের শেষ বছর। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় আছে সরকারের। দেশ স্মার্ট হলে পোর্টও স্মার্ট হবে। এজন্য প্রয়োজন স্মার্ট টিম। মাতারবাড়ি, বে টার্মিনাল, চট্টগ্রাম বন্দর একসঙ্গে অপারেশন করলে জাতীয় আয় অনেক বেড়ে যাবে।’

ব্রিটিশ হাইকমিশনার এইচ আর রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, ‘এটি চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন। ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বড় জাহাজ ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বড় জাহাজ ভিড়লে অনেক বেশি কনটেইনার আসবে। এর ফলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিতে আরও গতি আসবে। এতে বিনিয়োগও বাড়বে। আমার দেশের একটি কনসালটেন্ট গবেষণা কাজে জড়িত ছিল তাই আমি গর্বিত। চট্টগ্রাম বন্দরের এমন অর্জনে আমি সত্যিই আনন্দিত।’

সভাপতির বক্তব্যে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘আজ বন্দরের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ২০০ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ‘কমন অ্যাটলাস’ ভিড়েছে। বন্দর ব্যবহারকারী ও দেশকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে আমরা সচেষ্ট। বাংলাদেশের জাহাজ মালিকরা বড় বড় জাহাজ নিয়ে আসছেন। এজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’