বেড়িবাঁধ : বানানো হয় ভেঙে যাওয়ার জন্য

বর্ষা ও অতি জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়া যেন স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে উঠেছে। জলোচ্ছ্বাস ও অতি জোয়ারে বাঁধ ভাঙবে না এটি উপকূলবাসী কল্পনাও করতে পারে না। অথচ প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা খরচ হয় বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের পেছনে।
সীতাকু-ের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বোয়ালিয়াকূল, আকিলপুর, জমাদারপাড়া, সত্যপাড়া গ্রামের সাগর উপকূলের সোয়া ২ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধটি দেড় যুগ ধরে ভাঙতে ভাঙতে সাগরে বিলীন হয়ে যায়। এসব এলাকার শত শত একর ফসলি জমিতে নোনাপানি ঢুকে ফসল উৎপাদন বন্ধসহ জোয়ারের সময় বাড়িঘরে পানি ঢুকে যেত। ফলে বাঁধ সংস্কারের দাবিতে মহাসড়কে মানববন্ধন, মিছিল-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করে এলাকার ভুক্তভোগীরা। এভাবে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এখানে স্থায়ী ও মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। ২ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধের কাজ ২০১৯ সালে শেষ হয়।
৪০ কোটি টাকা বরাদ্দে নির্মিত বেড়িবাঁধটি বছর না ফুরোতেই ধসে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় নির্মিত বাঁধটি টেকসই হয়নি বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। বাঁধের ব্লক ধসে যাওয়ায় জোয়ারের পানিতে ৫টি গ্রামের বাড়িঘর প্লাবিত হবার ঝুঁকিতে পড়েছে। বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বোয়ালিয়াকুল এলাকার ৩ স্থানে এবং আকিলপুর এলাকার ৭ স্থানে মোট ১০ স্থানে বাঁধের ব্লক নিচের দিকে দেবে গেছে। স্থানীয় এলাকাবাসী বেড়িবাঁধের সংস্কারে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। নি¤œমানের নুড়িপাথর, সিমেন্ট ও বালু দিয়ে নির্মিত সিসি ব্লকগুলো বাঁধরক্ষায় স্থাপন করা হয়েছিল। ব্লকের নিচ থেকে বালু ও নুড়িপাথর সরে গিয়ে বাঁধ ভেঙে যেতে শুরু করেছে। ফলে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের বাঁধটি টেকসই হয়নি বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
এই অবস্থা শুধু সীতাকু-ে নয়, বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকু-, সন্দ্বীপ, পতেঙ্গা, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলা জেলাসহ সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার বা মেরামতের কাজ চলেছে একের পর এক। কিন্তু কাজের মান নিয়ে উপযুক্ত তদারকি, যাচাই, কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কোনো বালাই না থাকায় মানসম্মত কাজ হয় না কোথাও। অধিকাংশ জায়গায় বেড়িবাঁধ টেকে না।
এতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় না।। মূল সমস্যা, দাবি তথা বেড়িবাঁধের অভাব যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আজও রয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজের পেছনে সীমাহীন দুর্নীতি, কারচুপি এবং এর মাধ্যমে সরকারি বরাদ্দ বাবদ শত শত কোটি টাকা লুটপাটকারী চক্রকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে সাজা দেয়ার দাবি উঠলেও তা কখনও আমলে নেয়া হয়নি। এতে যথেচ্ছ নি¤œমানের কাজ গছিয়ে দিয়ে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেও পার পাওয়া খুবই সহজ হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালযের পানি উন্নয়ন বোর্ডে যে বিপুল অনিয়ম হয় তা ওপেন সিক্রেট হলেও অতীতে কারো বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় দেশের টেকনাফ-সেন্টমার্টিন-শাহপরীর দ্বীপ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সীতাকু-, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, সাতক্ষীরা, দুবলারচরসহ দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলভাগ, চর ও দ্বীপাঞ্চলসমূহ স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে আজো অরক্ষিত অবস্থায় রয়ে গেছে। বর্ষা এলে ভাঙে। এটাই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।