বৃষ্টি ও ছাতা

রেবা হাবিব

পুরান ঢাকায় সাওদাদের একতলা বাড়ির ছাদটা একেবারে জরাজীর্ণ। অনেক জায়গাতেই প্লাস্টার খসে পড়েছে। এই পুরোনো বাড়ি সংস্কার করা খুবই বিপজ্জনক। এছাড়া সংস্কার করতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা জোগাড় করা তার সামর্থ্যরে বাইরে। সাওদা ছোটখাটো একটা চাকরি করে। সংসারে বাবা-মা আর একটি মাত্র ভাই আর তার বউ। সাওদার এখনও বিয়ে হয়নি। মা-বাবার সংসার ছাড়া সেসব চিন্তাভাবনা ছেড়ে দিয়েছে।
এই ভাঙাচোরা, ইট বের হওয়া ছাদটা কিন্তু কিছুটা সুশ্রী হয়েছে সাওদার শখ আর হাতের স্পর্শে। ছাদে সারি সারি টবে ফুলের গাছ। এখন নানা রঙের মৌসুমী ফুল ফুটে আছে টবের গাছগুলোতে। অফিসে কাজের চাপ থাকায় কিছুদিন এই বাগানটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখার সুযোগ পায়নি। আজ ছাদে এসে দেখছে। পায়চারি করতে তার খুব ভালো লাগছে। লাল, হলুদ, বেগুনি ফুলগুলো যেন চোখের মধ্যে ঢুকে মনের ভেতর একটা কোমল স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ চমকে ওঠে সে। পাশের বাড়ির ছাদের এক কোণে থাকা ছেলেটি তাকে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে রেলিং ঘেঁষে। কাছে এসে দেখে। সাওদার বাগানে গাঢ় সবুজপাতার মধ্যে ফুটে আছে একটা হলুদ ফুল। ফুলটাকে দেখে সাওদার মনে হলো, পুরান ঢাকার এই ছাদে অস্বস্তি নেমে এসেছে। অফিসের তাড়া থাকায় সে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এলো।

সাওদা সবে কাজ শেষ করে অফিস থেকে বেরোতেই হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। বাসস্টপ অনেক দূরে, ভাবলো ভিজতেও মজা। সে আনন্দ নিয়ে হাঁটছে। বৃষ্টিতে ভিজে মাটির মিষ্টি গন্ধ, ঠান্ডা ঝরনা থেকে শরীরে মিষ্টি কাঁপুনি, সবকিছুই বেশ আনন্দ দিচ্ছে। তেত্রিশ বছরের জীবনে একবারও সে এমন অনুভব করেনি। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকলো, ঘুরে দেখলো একজন সুদর্শন যুবক তাকে বলছে- শুনুন, আপনার ওড়নাটা ফেলে গেছেন। একটু খেয়াল রাখবেন।
সাওদা পেছনে তাকিয়ে দেখল ওড়না মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে ধন্যবাদ বলে ওড়না তুলে নিল।
যুবক বলল, আমার নাম আবিদ। আপনি চাইলে আমার ছাতার নিচে আসতে পারেন।
সাওদা বলল, দরকার নেই। ধন্যবাদ।
আবিদ আবার বলল, আপনি চাইলে ছাতাটা নিয়ে নিন।
তারপর একটু সংকোচ নিয়েই সাওদা আবিদের সঙ্গে ছাতায় যোগ দিল। সে খুব ভদ্র ছেলে, তার ব্যাংকের পাশের বিল্ডিংয়ে তার অফিস। দুজনের বাড়িও পাশাপাশি। হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। সাওদা রুমাল দিয়ে মুখ মুছে দেখে আবিদ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দুজনেই দ্বিধা নিয়ে হাঁটতে লাগলো।
বাস স্টপ এলে সাওদা স্টপের ভেতরে গিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ছাতার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে ঢেকেও লক্ষ তার স্পর্শ ছুঁয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত মিষ্টি কাঁপুনি তার হাতে, কী মুগ্ধতা চোখে! যেন কিছু উন্মাদনা সাওদার গায়ে ঢেলে দিতে থাকে। বাস এলো, সে বাসে উঠল, কিন্তু তার মনে হলো সে কোথাও হারিয়ে গেছে। সাওদা শুরু থেকেই নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রেখেছে। নিজে বিয়ে না করে ভাইকে বিয়ে দিয়েছে। ওর পড়াশোনা, বৃদ্ধ মা-বাবার দেখাশোনা সবই ঠিকঠাক করছে। কখনও নিজেকে নিয়ে এভাবে ভাবেনি, কিন্তু আজ আবিদের দিকে তাকিয়ে কী হচ্ছে!
পরদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে আবার দেখা হয় তাদের। কোনো ভূমিকা ছাড়াই আবিদ বলল, তোমাকে আমার ভালো লাগে। দুই বছর ধরে তোমাকে শুধু দেখে যাচ্ছি। কিছু বলব সুযোগ পাচ্ছিলাম না।
সাওদার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল। সে চোখ ঘুরিয়ে নিজেকে মনে মনে বকে নিল। মন ভুলতে পারেনি কালকের বৃষ্টির রোমাঞ্চ। সন্ধ্যাবেলা বাসায় এসে দেখে আবিদ মায়ের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছে। আড়ালে মাকে ডেকে নিল সাওদা। খুব রেগে গিয়ে মাকে বলল, লোকে কি ভাববে?
মা বললেন, ছেলেটি খুব বুদ্ধিমান। তোর ভাগ্য ভালো এমন ছেলে পেয়েছিস। বিয়েতে হ্যাঁ বলে দে।
সাওদা কিছু বলল না। আরও কয়েকদিন শুধু ভাবনায় কেটে গেল।
আজ আবার আবিদ তার সামনে ছাতা নিয়ে হাজির। হঠাৎ বৃষ্টির তীব্রতা বেড়ে গেল। সাওদার মন বলল, আমাকে ভিজিয়ে দাও, দুই আকাশ বৃষ্টি হচ্ছে, ভালোবাসার বৃষ্টি, জলের বৃষ্টি। সে কিছু না ভেবে আবিদের হাত থেকে ছাতাটা ছুঁড়ে মারলো।
আবিদ হেসে তার হাত দুটো ধরে রাখলো। ভিজতে লাগলো।