বিশ্বদরবারে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী

রায়হান আহমেদ তপাদার »

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে পাঠানো ভিডিও বার্তায় পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য, ভাষা নিয়ে সহাবস্থানে এক আধুনিক নাগরিকের দেশ বাংলাদেশ, যার আরেকটি পরিচয় সোনার বাংলা। এই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে শুভেচ্ছায় সিক্ত করছেন; বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রাকে অভিনন্দিত করছেন। উন্নয়নের বিস্ময়, বিস্ময়ের বাংলাদেশ স্বচক্ষে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করছেন যা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে মহিমান্বিত করছে।একাত্তরে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, আর তারই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে তুলতে চলেছি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বিস্ময়ের বাংলাদেশ মহান স্বাধীনতার এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি শহীদ,বীর মুক্তিযোদ্ধা,বীরাঙ্গনা, শরণার্থীসহ মুক্তিকামী সব মানুষকে। যাদের আত্মত্যাগ ও স্বজন হারানোর বেদনার মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও সংগঠকদের।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেসব ভারতীয় সেনা এই মাটিতে জীবন দিয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, তাদের প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধা। যাদের সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে আজকের দিনে আরেকবার শপথ নিতে চাই, বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে রাখবই। স্বীকার করতে হবে, পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের জনপ্রত্যাশা বিপরীত মুখে হেঁটেছিল। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, জাতির জনকের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা ষড়যন্ত্র এমনকি ৭৫ সালের হত্যাকা-ের বিচার আইন করে বন্ধ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক সাম্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আমাদের যৌথ স্বপ্ন ছিঁড়ে দিয়েছিল মুষ্টিমেয় স্বাধীনতাবিরোধী গুটিকতক উচ্চভিলাষী সেনা কর্মকর্তার নৃশংসতা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির জনকের অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বৈষম্যহীনতার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তাও আজ হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন চলমান আছে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে।
মুজিব চিরন্তন শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করার জন্য বিশ্বের অনেক দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশ সফর করছেন। গত ১৭ মার্চ বাংলাদেশে এসেছিলেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সালেহ; ১৯ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেছেন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দ্র রাজাপাকসে; ২২ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেছেন নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারী; ২৪শে মার্চ বাংলাদেশ সফর করেছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ড. লোটে শেরিং এবং সর্বশেষ ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সফরে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভিডিও বার্তায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও অন্যান্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ আল খলিফায় ঘণ্টাব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রদর্শন ও আলোকসজ্জার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বৃটেনের রানী এলিজাবেথ উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন। এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শুভেচ্ছা বার্তায় বাইডেন বলেন, ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে মানবতা ও উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এদিকে মহামারি করোনাকালীন সময়েও বিশ্বের সব দেশে যখন প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৮.২ শতাংশ।এর সাথে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অর্জিত হতে পারে। করোনাকালীন কঠিন সময়েও বাংলাদেশে গত ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ ১৭৮ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছি; যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ঘটনা। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.২ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে বেড়েছে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যাও। স্বাধীনতার পর রপ্তানি আয়ের সত্তর ভাগ ছিল পাটের দখলে। বর্তমানে মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের দখলে।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা ভিশন ২০২১ দিয়েছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন যার মধ্য দিয়ে আমরা উন্নয়নশীল দেশ উন্নীত হয়েছি এবং ভিশন ২০৪১ এর মাধ্যমে আমরা আধুনিক এবং উন্নত দেশে পরিণত হব। বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, বড় বড় ফ্লাইওভার করা হয়েছে, মেট্রোরেল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল ও সম্ভাবনার অপার বিস্ময়কর একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় আমরা এগিয়ে রয়েছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়েই তা প্রমাণ করেছি।
স্বাধীনতা অর্জনের কারণেই বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থা গত কয়েক দশকের চেয়ে যে শীর্ষে অবস্থান করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন নয় সত্যি। তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ, প্রসার, ব্যবহারে দেশ অনেকদূর এগিয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশে ওড়ছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার অভাবনীয় সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত হিসেবে বিভাজন করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচকের ভিত্তিতে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদ-, অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থাৎ ১৬১০ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দমমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ।
এমনকি ২০১৮ ও ২১ সালের মূল্যায়নে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচকেই মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে সিডিপি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই দ্বারপ্রান্তে এসে সত্যিই বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য অর্জন! এ ছাড়া বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উঠে আসে জন্মের ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ দ্রুতগতি সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখাতে পেরেছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই ক্ষণে সম্মিলিতভাবে কাজ করার মাধ্যমেই সমৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রেখে এক দিন বিশ্বের বুকে উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের প্রাণের এই বাংলাদেশ।
তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের সবার অঙ্গীকার হোক সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা শুরু করেছিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সে বছর ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হই। বিশ্বের বুকে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপন করে। রক্তে অর্জিত আমাদের সেই স্বাধীনতারই আজ ৫০ বছর পূর্তি! জাতির জন্য এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স