বাংলাদেশের বন্ধু, ‘তুমি রবে নিরবে’

মোতাহার হোসেন »
ভারতের সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জী নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিম-লে তাঁর বিচরণ,অবস্থান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়,মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের পরতে পরতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলন তিনি। বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধুর অবদান বাংলাদেশ,বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণে রাখবে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন এই অকৃত্রিম বন্ধুর নাম আমাদের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। তিন সপ্তাহ দিল্লির হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ৩১ আগস্ট সোমবার বিকেলে মৃত্যু হয় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের। তিনি ছিলেন দেশটির প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সংকটে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি পরিণত বয়সে অর্থাৎ ৮৪ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের পাশে থেকেছেন।
কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, লোকসভার কংগ্রেস দলনেতাও হয়েছেন। এমন ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিরল, যিনি প্রধানমন্ত্রীর পদটি ছাড়া কার্যত প্রায় সব শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তবু তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বাংলাদেশের পরম মিত্র। সেই পরম মিত্র কিছুটা আকস্মিকভাবেই বিদায় নিলেন।
স্মরণে আছে, প্রথম বাঙালি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন প্রণব মুখার্জী। প্রথম শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোনটি করেছেন আর একজন বাঙালি, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সালটা ছিল ১৯৯৫। প্রণব মুখার্জী সব সময় বলতেন, বাংলাদেশ আর ভারতের সম্পর্কটা নিছক দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক নয়। দুটি দেশের তো আসলে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা সব নিয়ে নাড়ির বন্ধন,অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তারপর ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর মুখার্জী ঢাকা আসেন ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ত্রাণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে হয়েছিল সে ঘূর্ণিঝড়। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। সেদিন তিনি এত খুশি হয়েছে যা আগে হয়নি। প্রণব মুখার্জী বলেন, ‘‘শেখ হাসিনা আমার পারিবারিক বন্ধু। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কার্যকলাপ করলে তাঁকে অভিভাবকের মতো ধমক দিতেন। বলতেন, এমন করবেন না। তিনি কত কষ্ট করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।’’
দীর্ঘ পাঁচ দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী প্রণব মুখার্জীর মৃত্যুতে ভারতের পাশাপাশি উপমহাদেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ভারত সরকার সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে তার প্রতি বিরল শ্রদ্ধা জানিয়েছে। বাংলাদেশ একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে এই অকৃত্রিম বন্ধুর স্মরণে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটে বলেছেন, ভারতরতœ প্রণব মুখার্জীর প্রয়াণে ভারত আজ শোকগ্রস্ত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ রাজনীতিকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তারা প্রণব মুখার্জীকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও পরম সুহৃদ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রণব মুখার্জীর মৃত্যুতে ২ সেপ্টেম্বর বুধবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করে বাংলাদেশ। এদিন দেশের সব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
প্রণব মুখার্জী দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন। ১০ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তির পর ধরা পড়ে তিনি করোনাভাইরাসেও আক্রান্ত হয়েছেন। সে অবস্থাতেই ওই দিন রাতে দীর্ঘ অস্ত্রোপচার হয়। তার পর থেকে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের আগে নিজের করোনা সংক্রমিত হওয়ার খবর টুইট করে জানিয়েছিলেন তিনিই। সেটাই ছিল তাঁর শেষ টুইট। পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় কংগ্রেসে কাটানো প্রণবের পদধূলি নেওয়ার ছবি শেয়ার করে বিপরীত রাজনৈতিক দর্শনের দল বিজেপির নেতা মোদি লিখেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের গতিপ্রকৃতিতে তিনি এক অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছেন। একজন অসাধারণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এক গৌরবময় রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতির সব মহল আর সমাজের সব শ্রেণিতে তিনি শ্রদ্ধা পেয়েছেন।’ একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসভার সদস্য থাকাকালে তখনকার কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জী যেমন মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনি তিনি বন্ধু ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েও। তার স্ত্রী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী শুভ্রা মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের নড়াইলের মেয়ে। প্রণব-শুভ্রা দম্পতির দুই ছেলে ইন্দ্রজিৎ মুখার্জী ও অভিজিৎ মুখার্জী ছাড়াও একমাত্র মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জী নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে অভিজিৎ মুখার্জী পশ্চিমবঙ্গের জাঙ্গিপুর আসন থেকে দু’বার কংগ্রেসের মনোনয়নে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া শর্মিষ্ঠা একজন কত্থক নৃত্যশিল্পী। কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন তিনিও। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধু হিসেবে ২০১৩ সালের ৪ মার্চ প্রণবের হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের তখনকার রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত দুটো পৃথক শোকবাণির অংশ বিশেষ এখানে বিবৃত করছি। রাষ্ট্রপতি শোকবার্তায় বলেছেন, ‘‘প্রণব মুখার্জীর মৃত্যু ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি। প্রণব মুখার্জী ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত তৈরিতে তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’।
প্রণব মুখার্জীর মৃত্যুতে শোকে কাতার ও স্মৃতিকাতর হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও শেখ হাসিনার নিজের বহু স্মৃতি প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন। শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জীর অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়। আমি সব সময় মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।’’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জী আমাদের সব সময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজ-খবর রাখতেন, যে কোনো প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশে ফেরার পরও প্রণব মুখার্জী সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যে কোনো সংকটে তিনি সাহস জুগিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, প্রণব মুখার্জীর মৃত্যুতে ভারত হারাল একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারাল একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।’’
প্রণব মুখার্জী রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরে শেকড় থেকে ক্ষমতার চূড়ায় পৌঁছেছেন। স্বাধীনতার পর যেসব বাঙালি নেতা-নেত্রী দিল্লির রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন, তাদের মধ্যে সফলতম এবং উজ্জ্বলতম নাম প্রণব মুখার্জী। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সক্রিয় রাজনীতিতে প্রণবের ভূমিকায় ইতি পড়েছিল। কিন্তু কংগ্রেসের রাজনীতির সংকটের নানা মুহূর্তে বারবারই তার অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ চলে এসেছে আলোচনায়। এটা প্রমাণ করে, তার সাফল্য সংকীর্ণ বাঙালি পরিচয়ের সীমা ছাড়িয়ে আসলে আরও কতদূর বিস্তৃত হতে পেরেছিল।
১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরের মিরিটি গ্রামে প্রণব মুখার্জীর জন্ম। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা-সংগ্রামী এবং কংগ্রেস নেতা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি, এআইসিসি সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদেরও সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্বের পরে মন দিয়েছিলেন আইনের ডিগ্রি পাওয়ার জন্য। তবে আইনজীবীর পোশাকে তাকে কখনোই দেখা যায়নি। ডাক ও তার বিভাগে করণিক এবং হাওড়ার বাঁকড়া স্কুলে শিক্ষকতার পর ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার আমতলার অদূরে বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে বিদ্যানগর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ মজুমদারের হাত ধরে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অভিযাত্রা প্রণবকে টেনে নিয়ে যায় অনেক দূরের অন্য ঠিকানায়,অনন্য উচ্চতায়। সংসদীয় রাজনীতির ইনিংস শুরু করার পরই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়েন প্রণব। তারপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭১ সালে প্যারিসে ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভায় যে ভারতীয় প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ^ জনমত সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রেখিছেলেন ৩৬ বছরের প্রণব ।
১৯৭৫ সালে কংগ্রেসের টিকিটে দ্বিতীয়বার রাজ্যসভার সদস্য হন প্রণব মুখার্জী। এর আগে ১৯৭৩ সালে শিল্প প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় জায়গা পান। ১৯৮০ সালের লোকসভা ভোটে দেশজুড়ে প্রবল ইন্দিরা হাওয়ার মধ্যেও বোলপুর কেন্দ্রে সিপিএমের কাছে হেরেছিলেন তিনি। তবে ১৯৮২ সালে ফের তার উত্থান হয়। এবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্রণব হলেন ইন্দিরা ক্যাবিনেটের ‘নাম্বার টু’ একাত্তরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহচর, তখনকার কংগ্রেস নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসভার সদস্য প্রণব যেমন বাংলাদেশের মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনি তিনি বন্ধু ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েও। তাঁর স্ত্রী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শুভ্রা মুখার্জী ছিলেন এই বাংলাদেশের নড়াইলের মেয়ে। প্রণব-শুভ্রা দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে। রামনাথ কোবিন্দ এক টুইটে বলেছেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীও মৃত্যুর খবরে আমি শোকাহত। তাঁর মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান হলো।’ নরেন্দ্র মোদি এক টুইটে বলেছেন, ‘ভারতরতœ প্রণব মুখার্জীর প্রয়াণে ভারত আজ শোকগ্রস্ত।’ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় কংগ্রেসে কাটানো প্রণবের পদধূলি নেওয়ার ছবি টুইটে শেয়ার করে বিজেপি নেতা মোদি লিখেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের গতি-প্রকৃতিতে তিনি এক অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছেন। একজন অসাধারণ প-িত, এক গৌরবময় রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতির সব মহল আর সমাজের সব শ্রেণিতে তিনি শ্রদ্ধা পেয়েছেন।’
প্রণব মুখার্জীর জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটিতে। তাঁর বাবা কামদা কিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত কামদা কিঙ্কর ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম রাজলক্ষ্মী মুখোপাধ্যায়। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া প্রণব শিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। ১৯৬৩ সালে কলকাতার কাছে ছোট একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরুর মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ওই সময়ে তিনি ‘দেশের ডাক’ নামের একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেন।
১৯৬৯ সালে প্রথমবার তিনি রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন আলাদা দল বাংলা কংগ্রেস থেকে। পরে দলটি কংগ্রেসের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। পরে আরো চার মেয়াদে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৪ সালে তা ছেড়ে দেন। ওই বছরই তিনি লোকসভা (পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ) নির্বাচনে জয় পান। টানা নির্বাচিত হয়ে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে তিনি দেশটির ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একাধিক দফায় ভারতের বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন।
সংসদীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েই ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্থ সৈনিকে পরিণত হয়েছিলেন প্রণব। ১৯৮৫ সালে প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি হন তিনি। ১৯৯৮-৯৯ সালে সোনিয়া গান্ধী কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে সাধারণ সম্পাদক হন প্রণব। রাজনৈতিক জীবনের ৩৭ বছর কাটিয়েছেন পার্লামেন্টে। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও কখনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি তাঁকে। দিল্লিতে বাঙালির অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত এই বাঙালি রাজনীতিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরসেও ছিলেন।
প্রণব মুখার্জী ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভাষায় ছিলেন ‘আ ম্যান অব অল সিজনস’। ২০০৮ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মবিভূষণ’ ছাড়াও ২০১৯ সালে পেয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরতœ’। এ ছাড়া আইভোরি কোস্ট ও সাইপ্রাস থেকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। দেশ-বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি পাওয়ার পাশাপাশি প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় অর্থনীতি ও দেশ গঠন ইস্যুতে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। প্রত্যাশা থাকবে এই রাজনীতির মহীরূহ এর পদাঙ্ক অনুসরন করে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হবে রাজনীতি। পাশাপাশি এই পরম বন্ধুকে বাংলাদেশের মানুষ সব সময় স্মরণ করবেন কৃতজ্ঞতার সাথে।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম