প্রবাসী মায়ের ঘর

জাকির হোসেন »

অবশেষে আছিয়া খাতুন নতুন বাড়িতে উঠল। তবে স্বামীর বাড়ি কিংবা বাপের বাড়িতে নয়। নিজের বাড়িতে। যে বাড়িতে তার বাবুই পাখির মতো বাসা বানানোর সুখ আছে। যে বাড়িতে আছিয়া তার সরল চোখের মতো একটি পুশকুনি কেটেছে। যে বাড়িতে তার দুঃখ-সুখের গল্প করার জন্য একটি উঠান আছে। আছিয়া খাতুন বাড়ির চারপাশে ফলজ-বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করেছে। একটি টিউবওয়েল বসিয়েছে। একটি দোচালা রান্নাঘর বেঁধেছে। আরো বেঁধেছে আছিয়া ও তার আবিয়াতি ছেলের জন্য একটি চারচালা টিনের ঘর।
সুমনের তখন দশ বছর বয়স। বাপ তার বউ-ছেলেকে রেখে চট্টগ্রাম শহরে আরেকটি বিয়ে করে। সংসারে সময় দেয় না। খরচাপাতি দেয় না। ছুটিতে বাড়ি আসা বন্ধ করে দেয়। যেদিন বাড়িতে আসতো সেদিন মায়ের সাথে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো। এক পর্যায়ে বাপে মায়ের গায়ে হাত তুলতো। রান্নাঘর থেকে লাঠি এনে পেটাত।
শ্বশুর-শাশুড়িহীন সংসারে আছিয়া খাতুন ও সুমন নিঃসঙ্গ প্রায়। বড্ড অসহায়। খড়কুটা ধরে টিকে থাকার অবস্থাটুকুও যেন অবশিষ্ট নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি পরলোকে যাওয়ার আগে তাদের তিন ছেলেকে জুদা করে দিয়ে যায়। সুমনের বাপ ছিল মেজো ছেলে। বাপের দ্বিতীয় বিয়ের পর সুমন ও তার মায়ের সঙ্কট সময়ে চাচা-জেঠারা তাদেরকে আত্মীয়ের আশ্রয়ে রেখেছে বলে পাড়া-পড়শিরা মনে করে না। যদি রাখতো তবে সুমনের মায়ের এই দুর্গতি রচিত হতো না। অথচ সুমনের জেঠা বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী আর চাচা দুইটা ট্রাকটরের মালিক। সুমনের বাবারও অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের অফ ডকে একটি ডিপোতে লেভার হ্যান্ডেলিং-এর কাজ করতেন। চাচা-জেঠারা বলার মতো কোনো উদ্যোগ নিলে সুমন ও তার মা কোনোমতে রয়ে-সয়ে থেকে যেতে পারতো। কিন্তু তারা সেই কাজটি করেননি। কেন করেননি তা সুমনের বাপ আন্দাজ করতে না পারলেও সুমনের মা ঠিকই আন্দাজ করেছে। আর এই আন্দাজে সুমনের মায়ের ভবিষ্যত বাণী ছিল ঠিক এমন, একদিন দেবর-ভাসুররাই তার স্বামীর সকল সম্পত্তি ভোগদখল করে খাবে। কারণ সুমনের বাপ এমনিতেই স্বসম্পত্তির প্রতি উদাসীন। দ্বিতীয় বিয়ের পর আরো উদাসীন হয়ে পড়ে। এমনকি এটাও জানে না যে তার কোথায়-কত কাঠা জমি আছে! বলে রাখা ভালো, সুমনের বাপের জমিজমাগুলো চাচা-জেঠারা দুই ভাগে বিভক্ত করে বর্গা করতো। বর্গার ফসলগুলো আছিয়া খাতুন বুঝে নিতো কিন্তু স্বামী বিয়ে করার পর থেকে দেবর-ভাসুররা ঠিকমতো হিসেব দিতো না। একসময় তো হিসেব দেয়াই বন্ধ করে দেয়। আছিয়া খাতুন হিসেব চাইলে বলতো, আঙ্গো ভাই বাইত আইয়ুক। হেতেরে বুজাই দিয়ুমনে।তুঁয়ারে বুজাই দিলে তুঁই হেতেরে উল্টাহাল্টা বুজাই দিবা আর হেতে আঙ্গোরে ভুল বুইজবো। হরেদি আঙ্গো ভাই আঙ্গোরে সন্দো কৈরবো।
দেবর-ভাসুরের কথায় আছিয়ার গা জ্বলে যায়। নিজেকে সম্বরণ করে বলে, এতদিন আঁরে বুজাই দেননোনি ? অন কাহিনী শুরু কৈচ্ছেন ক্যান ? মানে আঁর ভাত উডাই দিতে সান? হুনেন, এই বাড়িত্তুন আঁর স্বামীর ভাত মেলা আগে উডি গেছে। আন্নেগো ভাই আরেক্কান বিয়া কৈচ্ছে। আন্নেরা ডাক দেননো। আন্নেরা সান আঁই এই বাড়ি ছাড়ি চলি যায়। যাইয়ুম, এই বাড়ীত্তুন আঁই চলি যাইয়ুম। লুইচ্চা, হাঙ্গাইল্লা, চরিত্রহীন বেডার ভাত আঁই খাই না।
বাড়ি এলে ধান-চালের হিসেব না পাওয়ার নালিশটি স্বামীকে পেশ করলে স্বামী উল্টো আছিয়া খাতুনের ওপর চটে যায়। কারণ আছিয়া খাতুনের আগেই দেবর-ভাসুররা তার স্বামীর কানে কথা তুলে দেয়। ফলে আছিয়া খাতুনের কথা শেষ না হতেই স্বামী পেটাতে থাকে, চুতমারানি, আঁই বিয়া কৈচ্ছি তো কীয়া অইছে। আরো দোশগা করিয়ুম। তোর সমিস্যা কী লা মাগী ? তোর কোয়াল বালা। তোরে অনো ছাড়ি দি নো। কথাটি আছিয়া খাতুনের বুকে ক্রুশের মতো বিঁধে। প্রত্যাখ্যানের চেয়ে ইস্তাফা সম্মানের। কথাটি ভেবে রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে আছিয়া খাতুন পরদিন সুমনকে নিয়ে জামাইর বাড়ি ত্যাগ করে। আর ফিরে আসেনি। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। বাপ সুমনকে নিতে এসেছিল কিন্তু মা দেয়নি।
আছিয়া খাতুন বাপের বাড়িতে উঠেছে এক বছর হয়ে গেছে। বাপের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তি ভাইদের কাছ থেকে বুঝে নেয়। সেই সম্পত্তির বাড়ির ভেতরের অংশে একটা ঘর তুলে ছোটভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মা-ছেলে সেই ঘরটাতেই দিনযাপন করে। খোঁয়াড়ে নতুন মুরগি এলে পুরান মুরগিরা ঠোকরায়। ভাইয়ের বউরা পুরান মুরগির মতো আছিয়া খাতুনকে ঠোকরাতে শুরু করে। ননদিনীকে সহ্য করতে পারে না। আকারে-ইঙ্গিতে কটুকথা বলে। প্রায় সময় আরেকটা বিয়ের কথা বলে। বিয়ে করে ননদ চলে গেলে যদি বাড়িটা হালকা হয়! আছিয়া বিয়ে করে না। সুমনকে সম্বল করে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু এভাবে কতদিন? আছিয়া সুমনের সুন্দর
ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে। বাপের বাড়িতে থেকে নিজের রুটিরুজি নিয়ে ভাবে। স্বনির্ভর হতে চায়, কিন্তু কী কাজ সে করবে ? গ্রামে তো আয়ের তেমন উৎস নেই। নিরুপায় হয়ে গেরস্ত বাড়িতে কাজ নেয়। কিন্তু ভাইদের জন্য কাজ করতে পারে না। ভাইদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। তবে তারা আবার আত্মসম্মান সচেতন।
গত দুই বছর জীবিকানির্বাহ নিয়ে আছিয়া খাতুন যখন অকূল পাথারে, তখন একদিন আছিয়ার ছোটবোন হাজেরা এসে বলল, আঁর জামাইর বাড়ির ডাগে এক লোকে ভিশার বেবশা করে। হুইনছি হেতে না কী সৌদিআরবে নারীকর্মী হাডায়। আন্নে যদি কন হেতের লগে যোগাযোগ করি চাইতাম হারি। আছিয়া যেন এমন একটি প্রস্তাবের অপেক্ষায় ছিল। ভাবনাচিন্তা না করে বোনকে বলে দিল, এরে বইন তুই সা। আঁরে হোলা গা লই বাঁচন লাইগবো। ভাইগো উরে আর কদ্দিন খাইয়ুম? হেতেগো তো ঘর-সংসার আছে।
হাজেরা লোকটির সাথে যোগাযোগ করে। তিনি ভিসা দিতে পারবেন বলে জানান। বিদেশ যাওয়া নিয়ে আছিয়া দুই ভাইয়ের সাথে বসে। ভাইয়েরা সম্মতি দেয়। সৌদি যেতে আছিয়া খাতুনের চার লাখ টাকা লাগবে। এত টাকা সে কোথায় পাবে? টাকার কথা শুনে ভাইয়েরা নড়েচড়ে বসে। বোনের অসহায় চোখের পানি দেখে দুই ভাই পঞ্চাশ হাজার করে এক লাখ টাকা যোগান দেয়। হাজেরা তার স্বামী থেকে নিয়ে দেয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। আরো আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন। দুই বোনের বাপের বাড়ির সম্পত্তি চল্লিশ হাজার টাকায় কিনে নেয় বড় ভাইয়ের বউ। অথচ আছিয়া বড় ভাবির কাছে টাকা চাইলে বলেছিল- হুনো আঁর ননদের কথা। আঁই টিঁয়া কুনাই হাইয়ুম! তুঁয়ার ভাই আঁরে টিঁয়া-
হৈশা দেনি? নিজে কামাই করি নিজের কাছে রাই দে। আঁই দেক্কুম করি গুঞ্জাই রাখে। দুই বোনের বাপের বাড়ির সম্পত্তি কেনার পর বড় ভাবি আর ভাইয়ের কাছে দুই বোন একটা আবদার করে বসে। আবদারটি হল, আছিয়া খাতুন নতুন বাড়ি না বাঁধা পর্যন্ত সুমন এই বাড়িতেই তার মায়ের ঘরটিতে থাকবে। বড় ভাবি আবদারে সাড়া দিতে চায় না। দেবর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করায়। বাদবাকি দুই লক্ষ দশ হাজার টাকা সুদের ওপর ঋণ করে আছিয়া খাতুন বিদেশ যাওয়া নিশ্চিত করে।
সুমনকে প্রাইমারি পাস করিয়ে আছিয়া খাতুন বিদেশ যায়। বিদেশ যাওয়ার সময় ছেলেকে বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দেয় কিন্তু ছেলে মানুষ হয় না। বাজে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যায়। মাদক নিরাময় কেন্দ্রেও ছিল কিছুদিন। আছিয়া খাতুনের তিন বছর লেগে যায় ঋণ পরিশোধ করতে। প্রথমে ভিসার মেয়াদ ছিল দুই বছর। পরে আরো দুই বছর বাড়ানো হয়। শেষের এক বছরের টাকা সুমনের পেছনে চলে যায়। চার বছর শেষে আছিয়া খাতুন দেশে ফেরে। এই চার বছরে আছিয় াখাতুনের অর্জন বলতে বড় ভাইয়ের কাছে জমানো আশি হাজার টাকা।
কিশোর সুমনকে দেখে মা চিন্তায় পড়ে যায়। সুমনের চেহারাটা ওর বাপের মতো হয়ে উঠছে। আছিয়া খাতুন পরক্ষণে ভাবে, হোক চেহারা ওর বাপের মতো। বাপের ছেলে তো বাপের মতোই হবে। শুধু বাপের খায়-খাসলত না পেলেই হল। মা তার ছেলের মাথা কোলে টেনে নিয়ে হাত বোলাতে-বোলাতে বলে, বাবারে তোরে মানুশ করনের লাই আঁই তোরে তোর বাপের কাছে দিনো। তোরে মানুশ করনের লাই আঁই বিদেশ হরি রৈছি। তুই যদি মানুশের মতো মানুশ হস, তৈলে আঁর পরিশ্রম সার্থক। ছেলে সুবোধ বালকের মতো কথা দেয়। সে আর বাজে ছেলেদের সাথে মিশবে না। ঠিকমতো পড়াশুনা করবে। ছেলের কথা শুনে মায়ের মনে আশার প্রদীপ জ্বলে। ছমাসের মধ্যে আছিয়া খাতুন ফের ভিসার ব্যবস্থা করে বিদেশ গমন করে। কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় এবার আর চার লক্ষ টাকার প্রয়োজন হয়নি। দেড় লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে সর্বসাকল্যে। ভিসার ব্যবস্থা করেছে সৌদিতে পরিচিত আছিয়া খাতুনের স্বদেশী এক ভাই।
মা বিদেশ যাওয়ার এক বছর পর সুমন তার উন্মুক্ত জীবনে ফিরে যায়। মায়ের স্থলে মামারা সুমনকে হাই স্কুলের গণ্ডি পার করাতে পারেনি। ইতোমধ্যে সুমন স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের ছত্রছায়ায় দিনকে দিন ভয়ানক হয়ে উঠেছে। জোরপূর্বক মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাইক কিনে। বেপরোয়া গতিতে বাইক চালায়। হেলমেটে ঢাকা সুমনের মুখটি না দেখে যে কেউ বলে দিতে পারে। বাইকচালক আর কেউ নয়, নানার বাড়িতে বেড়ে ওঠা প্রবাসী মায়ের অবাধ্য সন্তান সুমন।
আইপিএলের জুয়া, মাদকসেবন, মেয়েদের পেছনে টাকা ওড়ানো, লক্ষ্মীপুর থেকে কখনো ঢাকা, কখনো কক্সবাজার গিয়ে ভাড়াটে রমণীর সাথে বিছানায় শোয়া। কিছুই বাদ যায় না ওর। কত কলগার্লের নাম্বার সুমনের মোবাইলে সেভ করা আছে। তা সে নিজেই জানে না। বন্ধুরা কেউ রাত কাটানোর গল্প শুনতে চাইলে সুমন সানন্দে গল্প বলতে থাকে- এরে হুন, গল্প আরম্ভের আগে একখান কথা তোগোরে কই- ওয়াশরুমে যায় স্বহস্তে নিজেরে ক্ষয় করনের চাইতে একখান মাইয়ার লগে রাইত কাডান হাজার গুণ ভালা। তোগো যদি নাম্বার লাগে আঁরতে লৈ যাইস। কত মাইয়ার নাম্বার লাইগবো ক? ঢাকা টু কক্সবাজার? কক্সবাজারের কথা শুনতেই এক বন্ধু বলে ওঠে, দোস্তো, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা খান যাইবোনি? টিভিত দেখছি রোহিঙ্গা মাইয়াগুন সেই মাল। ঠৌঁট বাঁকা করে সুমন বলে, ধুর, রোহিঙ্গা মাইয়াগুন ফর্সা ঠিকাছে। কিন্তু হেগুন মেরা। মেরা মাইয়া খায় মজা হাইতি ন। আবার কখনো বিরক্ত বোধ করে বলে, ওরে বাবুরে হত্যিকবার তোগোরে আঁই এইসব গোপন গল্প কৈতে হাইরতাম ন। আঁর কাছে আয় এসব কাহিনী হুইনতে চাস। আবার আঁর পিছ কিনারে যায় তোগো মা-বাপেরে কৈবি সুমন হোলাগা একছার বাজে। সুমন কথাটি ভুল বলেনি। কারণ ওর কয়েকজন কাছের বন্ধু ছড়িয়ে দিয়েছে- সুমন ঢাকা-কক্সবাজার গিয়ে হোটেলে রাত কাটায়।
ততদিনে মামাদের কানে সব কথা চলে এসেছে। মামারা ডাক দিলে সুমন তাদের তেড়ে আসে। একদিন তো ছোটমামার সাথে হাতাহাতি হয়ে গেছে। ভাগ্যিস বাড়ির অন্যরা এসে ফিরিয়েছিল বলে বড় ধরনের কিছু ঘটেনি। মামীরা বলেছিল সুমনকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। ওর জন্য তাদের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি। মেয়েরা বড় হয়েছে। কখন আবার ওই বদ ছেলেটার নজর মেয়েদের ওপর পড়ে। এই নিয়ে তাদের সতর্ক থাকতে হয়।
মামারা মাকে বিদেশে ফোন করে সুমন সম্পর্কে অবগত করে। মা সুমনের নষ্টামি শুনে কান্নার জন্য কথা বলতে পারে না। মামা-খালাদের পরামর্শে সুমনকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়। আর বড় মামাকে অনুরোধ করে বলে- আঁই দেশে আন পর্যন্ত আন্নেরা সুমনরে বাড়িততুন বাইর করিয়েন না।
আমাদের দেশে গার্মেন্টসে কর্মরত নারীকর্মী এবং প্রবাসে কর্মরত নারীকর্মী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে একটা নোংরা ধারণা প্রচলিত আছে। তারা ভাবে, গার্মেন্টস ও প্রবাসের নারীকর্মীরা বেশির ভাগই চরিত্রহীন হয়। এ সকল নারীদের সাথে পুরুষদের অহরহ সম্পর্ক বিদ্যমান। সাধারণ মানুষের মাঝে এমন নোংরা ধারণা জন্ম নেয়ার হয়তো নির্দিষ্ট যুক্তি আছে এবং সত্য হল, সেই যুক্তিতে বিদ্ধ নারীর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের যুক্তির আলোকে এ সকল নারীদের নিন্দার খাতায় লিপিবদ্ধ করা যাবে না। বরং বীরাঙ্গনাদের পরেই লিখতে হবে গার্মেন্টস এবং প্রবাসে কর্মরত সংগ্রামী নারীদের নাম।
সুমনের এক বন্ধু তার প্রবাসী চাচাতো ভাই সম্পর্কে সুমনকে বলেছিল- চাচাতো ভাই সৌদি থাকে। সেখানে গাড়ি চালায়। গৃহকর্মীর কাজ করে এক বাঙালি মেয়ের সাথে ভাইয়ের সখ্যতা হয়েছে। মেয়েটি চাচাতো ভাইকে বলেছিল- আরবের পুরুষরা একেবারে জালিম। তারা বউ রেখে অন্য মেয়ের সাথে সেক্স করে। মেয়েটিকে তার কফিল সেক্স করতে বলেছে কিন্তু সে রাজি না হওয়ায় পিটিয়ে জখম করেছে। একদিন দুইদিন তিনদিন। এরপর আর না করা যায় না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দৈহিক নির্যাতনের ভয়ে কফিলের সাথে সেক্স করতে হয়। তা না হলে চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুমকি দেয়। আর চাকরি চলে গেলে তো সর্বনাশ!
আবার সুমনের বন্ধু এটিও বলেছে- প্রবাসে কিছু মেয়ে আছে তারা ওইখানে সাগ্রহে বাঙালি ছেলেদের সাথে পরিচিত হয়। সম্ভব হলে যোগাযোগ করে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। বাঙালি ছেলেদের সাথে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখে। কারণ তাদের কফিল যদি পুনর্বার ভিসা না লাগায়। তবে তারা বাঙালি ভাইটি থেকে হেলপ পাবে। এমন একটি আশা তাদের মনের ভেতর জিইয়ে রাখে।
বন্ধুর কাছে শোনা কথাগুলো সুমনের মাথায় গেঁথে যায়। সে চাচ্ছে কথাগুলো ভুলে যেতে। কিন্তু কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না। সুমনের নেশাগ্রস্ত মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে, তার মা কী তবে কফিলের সাথে? তার মা কী তবে ভিসা পাওয়ার আশায়?
চার বছর পর আছিয়া খাতুন দেশে ফিরে। দেশে এসেই সুমনের জন্য এক লক্ষ টাকা জরিমানা গুনতে হয়। দক্ষিণ পাড়ার প্রবাসী জমিরের বউ সুমনকে ফাঁদে ফেলে ঘরে নিয়ে যায়। এলাকার ছেলেপেলেদের জমিরের বউ আগেই সব বলে রাখে। যদিও এই ফাঁদে ফেলার মূল কারণ ছিল দক্ষিণ পাড়ার ছেলেদের সাথে সুমনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ দক্ষিণ পাড়ার ছেলেরাই এই ঘটনার স্ক্রিপ্ট রাইটার। ধরা পড়ার পর জমিরের বউ কান্নাকাটি করে বলে- আঁর সংসার ভাঙি যায়বো। আঁই অন কিয়া করিয়ুম। সুমন আঁরে বিয়া ন কৈল্লে আঁর মরণ ছাড়া কোনো রাস্তা নাই। বোকা সুমন দুই বাচ্চার জননী জমিরের বউকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু মা আছিয়া খাতুনের জন্য পারে না। খবর পেয়ে আছিয়া খাতুন ছুটে আসে। ঘটনাটি রাষ্ট্র হওয়ার আগে এক লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে রাতের মধ্যেই দক্ষিণ পাড়ার অরুণ আলো বয়েজ ক্লাব থেকে সুমনকে ছাড়িয়ে আনে।
আট বছরের প্রবাস জীবন শেষে এই একটি বাড়িই আছিয়া খাতুনের বলার মতো অর্জন। লোকে অর্জনটিকে প্রবাসী আছিয়ার বাড়ি নামে চেনে। প্রবাসী পুরুষদের কত বাড়িই তো আছে আশেপাশে। কিন্তু প্রবাসী নারীর বাড়ি অনেকের মধ্যে কেবল একটিই। প্রতিষ্ঠিত হয়ে পুরুষশাসিত সমাজে নিজের নামে পরিচিতি পাওয়া একজন নারীর জন্যে গর্বের বটে। অথচ এই পুরুষরাই তাকে একসময় ঘর-সংসার করতে দেয়নি। আর এখন তার নাম ধরে সুনাম করে! তবুও যেন স্বস্তি ও সুখ আছিয়া খাতুনকে তুষ্ট করতে পারে না। একটা মাত্র ছেলের জন্য এত কিছু করা আর সেই ছেলেটাই মানুষ হল না। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শি সবাই একবাক্যে বলে- সুমনের চরিত্র তার বাপের মতো হৈছে। অথচ এই বাপের মতো চরিত্র হওয়া নিয়ে ছিল আছিয়া খাতুনের যত ভয়। আছিয়া খাতুন ভাবে, ছোটকালে সুমনকে ওর বাপ যখন নিয়ে যেতে চেয়েছিল তখন ছেলেটিকে দিয়ে দিলেই ভালো হতো। অন্তত মানুষের মুখে এই কথাটি শোনা থেকে বেঁচে যেতো- আছিয়া পোলাডারে মানুষ করতে পারল না।
মানুষ যেকোনো বয়সেই মানুষ হতে পারে। সুমনের তো মানুষ হওয়ার বয়স ফুরিয়ে যায়নি। একুশ বছরের ছেলেকে মানুষ করতে মা নিজেকে নিয়োজিত করে। ধীরগতিতে সুমনের কিছুটা উন্নতি হয়। নতুন বাড়িতে ওঠে সুমনের মনে উচ্ছ্বাস দেখা দেয়। সে পুকুরে মাছ ছাড়ে। পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে মাছের পোনা যেভাবে আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সুমনের পরিবর্তন দেখে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন মায়ের চোখে মাছের পোনার মতো ঘুরে বেড়ায়। আবার পোনা মাছগুলোর জন্য ভয় হয় কখন আবার মাছরাঙা অথবা পানকৌড়ি শিকার না করে ফেলে!
এমনই এক শঙ্কা নিয়ে আছিয়া খাতুন ঘুমিয়ে পড়ে। সুমনের রাত করে বাড়ি ফেরাটা আছিয়া খাতুন বন্ধ করতে পারেনি। তবে তিনি আশাবাদী রাত করে বাড়ি ফেরাটাও বন্ধ হয়ে যাবে। সুমনকে কাজকর্ম ধরিয়ে দেয়ার পর বিয়ে করিয়ে দিলে ছেলে অটোমেটিক সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরবে। মায়ের কথা না হয় ফেলানো যায়। কিন্তু বউয়ের কথা তো আর ফেলানো যায় না।
দরোজায় উপর্যুপরি টোকা দেয়ার পর আছিয়া খাতুনের ঘুম ভাঙে। চোখ কচলাতে-কচলাতে মা মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে লাইটের সুইচ অন করে বলে- খাড়া আইয়ের।
দরোজা খোলার পর সুমন ঢুলতে-ঢুলতে ঘরে ঢুকে। মা দরোজা বন্ধ করে সুমনের দিকে তাকায়। সুমন হাঁটতে পারছে না। পড়ে যাবে এমন সময় মা ধরে ফেলে। সুমনের গায়ে মদের বিদঘুটে গন্ধ।
-বিঁয়ানবেলা যে টিঁয়া লই গেছোস। হেই টিঁয়া দি তুই … ! মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমন বলে- মদ গিলছি।
মা ভ্রু বাঁকা করে বলে- আঁর হালাল টিঁয়া দি তুই মদ গিলছোস?
-হ গিলছি।
কথাটি শুনে মা সুমনের গালে কষাইয়ে একটা থাপ্পড় দেয়। আরেক গালে আরেকটা থাপ্পড় দিতে যাবে ঠিক এমন সময় সুমন মায়ের হাত ধরে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, চুতমারানি, হালাল টিঁয়া মারাস? বিদেশ যায় বেডা মাইনষ্যের লগে ডলাডলি কৈরছোস। আঁই কিচ্ছু জানি না ভাইবছোস?
আছিয়া খাতুন পাথর হয়ে যায়। সে দেখে, এ্যানার্জি লাইটের আলোয় সুমনের চেহারাটা ওর পাষাণ বাপের মতো দেখাচ্ছে। যে তাকে ‘চুতমারানি’ বলে চুলের মুঠি ধরে বেদম প্রহার করতো।