পাহাড়িকা ত্রিপুরা ও তার ভালোবাসা

দীপক বড়ুয়া »

সবার ভালো লাগে পাহাড়। কারণ তার একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। রূপের মাধুর্যে গড়া পাহাড়। পাহাড় একজন সুন্দরীর চেয়েও অনন্য হয়ে ওঠে ষড়ঋতুতে, ভিন্ন রূপে। প্রকৃতির অপরূপ এই পাহাড়। এখানের মানুষগুলো সরল, সহজ, মায়াবী। তাদের নিজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস আছে।
অবসর বিনোদনে সবাই পাহাড়ে যায়। স্নিগ্ধ, বিশুদ্ধ হাওয়ার উপাদানের অভাব নেই এখানে। শহরের বিষাক্ত ধুলো দেখা যায় না কোথাও। এক সময় শুধু পাহাড়ি আদিবাসীরা থাকতো পাহাড়ে। নির্মল পরিবেশে। ফাঁকা। মানুষের ভিড় ছিল না। আজকাল অনেক বাঙালি পাহাড়ে বাড়ি করেছে। এক সঙ্গে থাকে সবাই। পাহাড়ি- বাঙালি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যেন।
পার্বত্য জেলা শহর অনেক। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন। প্রতিটি শহর চমৎকার সুন্দর। একটি অন্যটির মতো নয়। আবার অনেক মিল আছে পাহাড়ে। সব পাহাড় উঁচুনীচু, ঢালু। পাহাড়ের বুকে বনপাহাড়ি সারি-সারি গাছ। ভোরে, দুপুরে, সন্ধ্যায় ভিন্নরূপের ঝাঁজ ঝরে। কী সুন্দর!
রাঙামাটি! আধো গাঁয়ে পাহাড়ের কোমরে অনেক বাড়ি। দূর থেকে মনে হয়, স্বর্গ। সবাই চাষি। চাষ করে জীবন কাটায়। অনেকেই সরকারি চাকুরে। আবার শহর খুব একটা দূরে নয়। পাহাড়ের উঁচুতে দাঁড়ালেই দেখা যায় রাঙামাটি শহর। স্বচ্ছজলের লেক। চারিদকে পাহাড় এবং রাশি-রাশি জল। জলের মাঝখানে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটেছে পিচঢালা পথ। বাস, ট্যাকসিতে যাওয়া-আসা। ইশকুল, কলেজ, সরকারি অফিস-আদালত কাছাকাছি। সব রাঙামাটি শহরে।
আধুনিক শপিংমল, হোটেল-মোটেলে ভরা। রূপের বন্যায় ভাসে পাহাড়।
আজকাল বাঙালিরা ঈদের লম্বা ছুটিতে কক্সবাজারের মতো খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবনেও যায়।
সেই আধো গাঁ পাহাড়ে পাশাপাশি কত বাড়ি। ওদের সমাজ আছে। সমাজপতির কথায় সবাই চলে। স্থানীয় চেয়ারম্যান আছে।
পাহাড়িকা ত্রিপুরা কলেজে পড়ে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা এক সাথে কলেজে যায়। তারিখও যায়। তারিখও ত্রিপুরা। বাড়ি পাশাপাশি। লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো। এসএসসিতে ফোর প্লাস। এইচএসসিতেও পাবে। কলেজের অধ্যক্ষ-অধ্যাপকেরা সবাই ভালোবাসে তারিখকে। তারিখ সুদর্শন। লম্বা গড়ন। ফরসা। মেয়েরাও পছন্দ করে ওকে। পাহাড়িকা ভালোবাসে তারিখকে।
পাহাড়িকার ভালোবাসা অন্যরকম। সে জীবনসাথি হিসেবে ভেবে নিয়েছে তারিখকে। তারিখ ওসবের ধারধারে না। তার প্রথম ভাবনা দেশ, দেশের প্রতি ভালোবাসা, মমতা এবং লেখাপড়া। দেশকে তারিখ প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার বাবা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের তারিখটি মনে রেখে নাম রেখেছেন তারিখ। বাবা বলেন, সাতই মার্চ বাংলাদেশের জন্য একটি দীপ্তিমান দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিল এই দিনে। তাঁর ডাকে পেয়েছি এই বাংলাদেশ।
বাংলা নববর্ষ এলে বাঙালিরা দিনটিকে বরণ করে। এদিন শুধু বাঙালিদের নয়। সকল ধর্মের, সকল জাতির। ভেদাভেদ থাকে না। পাহাড়িদের নববর্ষও প্রাণের উৎসব। ওরা বিভিন্ন আঙ্গিকে নববর্ষ উদযাপন করে। এটিকে শুভদিন ভাবে সবাই। সারা বছরের দুঃখমোচনের দিন। সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার দিন। পুরো পার্বত্যজেলায় বসে আনন্দের হাট। যেন উৎসবের শহর। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন। মারমা, ত্রিপুরা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায় সবাই যেন এক, অভিন্ন এখানে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত প্রায় এগার ভাষাভাষী আদিবাসী সম্প্রদায়েরর প্রধান সামাজিক উৎসব এই বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ। যারা ত্রিপুরা সম্প্রদায় তারা বৈসুক নামে, মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই এবং চাকমা সম্প্রদায় বিজু নামে পালন করে। সংক্ষেপে তিন সম্প্রাদায়েরর উৎসবের প্রথম অক্ষর নিয়ে বর্ষবরণ ‘বৈসাবি’ উৎসব নামে পরিচিত।
ত্রিপুরাদের ফুলভাসানি উৎসব। সেই উৎসবে মুখোমুুখি পাহাড়িকা-তারিখ ত্রিপুরা। পাহাড়িকা আজ পাহাড়ি রঙিন পোশাক পরেছে। মুখে অনাবিল হাসি। ঠোঁটে স্বপ্নীল কলাপাতার রঙে লিপস্টিক। নখজুড়ে একই রঙের পালিশ। পাহাড়িকা বলে, এই শোনো তারিখ, অনেক কথা বলার আছে।
তারিখের চোখ অনেক দূরে। যেখানে পাহাড়িকার আধুনিক সাজের গন্ধ নেই। পাহাড়িকা শক্ত, নরম নয়। সে নতুন বছরের ছোঁয়ায় আবারও বলে,
– তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি তারিখ।
– পাহাড়িকা, আমি মা-বাবার বিয়ের ষোল বছর পরে জন্মেছি। আমার ইচ্ছে, অনেক বড় হবো আমি। বহুদূর ছুটতে হবে আমাকে। তাই ঐসব সস্তা বিষয় নিয়ে ভাবি না।
– এই নববর্ষ দিনকে সস্তা বলছ? আজকের দিনটা সস্তা নয়। মিথ্যে বলছ। আজ অন্তত এ কথা তো দিতে পারো, তুমি আমাকে পছন্দ করো! যখন বড়সড় একজন খ্যাতিমান হবে, তখন না হয় …
– হু হ্যাঁ! আরও একটি বিষয় তোমার জানা প্রয়োজন। যেটা বাবার মুখে শোনা।
– সেটা কী?
– তোমার বাবার সত্যিকার পরিচয় কি জানো? স্বাধীনতার সময় তোমার বাবার ভূমিকা কী ছিল! তোমার বড় তিন ভাই তো তোমার বাবার মতো নয়। সম্পূর্ণ আলাদা। অথচ তোমার বাবা বাংলাদেশে থাকেন, ভাবেন পাকিস্তান নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন রাজাকার কমান্ডার। কত পাহাড়িদের বাড়ি পুড়িয়েছেন, মেরেছেন, তাড়িয়েছেন হিসেব নেই। স্বাধীনতার এত বছর পরে চলে যাবার সময় হলো। তবু পরিবর্তনের ছোঁয়া নেই। আশ্চর্য মানুষ। এখনও পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর!
-আমার বাবার দোষে আমি দোষী হবো কেন? তারিখ একটিবার ভেবে বলো। আমার জন্ম তো বাংলাদেশের মাটিতে। বাংলা আমার প্রাণ,সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য।
-শোনো পাহাড়িকা, আমার বাবা বেঁচে নেই। তিনি সব সময় একটি কথা বলতেন, যে গাছের শেকড় ভালো নয়, সেই গাছের ফল কোনোদিনও ভালো হবে না। তোমার শেকড়ও ঠিক তাই। তুমি ভালো হবে না কোনোদিন।
পাহাড়িকা কিছু বলবে দেখে তারিখ বলে, চুপ! এই নববর্ষ দিনে আর কোনো কথা নয়। আনন্দ করো। গাও, নাচো। মন ভালো হবে। নিশ্চিন্তে একটিবার ঘুমুতে পারবে। পাহাড়িকার চোখ তারিখের চোখে।
তারিখের কঠিন কথায় পাহাড়িকার চোখে জল ছলছল পরে। মুখের সমস্ত দামি কসমেটিকস গলে পড়ে। কান্নার শব্দ হয়। পাশে বসা বুবলির তা সহ্য হয় না পাহাড়িকার চোখের জল। কান্নার শব্দ। পদ্মশ্রীও চুপ থাকে না। ওরা সবাই পাহাড়িকার কাছের বন্ধু। ওরা সবাই জানে তারিখকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সে। কিন্তু পাহাড়িকাকে এতটুকুও পছন্দ করে না তারিখ।
পদ্মশ্রী বলে, দেখো তারিখ, গর্ব-অহংকার কোনো মূল্যবান সম্পদ নয়। আজ হয়তো আছে। কালও থাকবে কেউ তা বলতে পারে?
বুবলি বলে, এই নববর্ষ উৎসবটি নানা নামে অভিহিত। নিবেদনের ধরন একই। তাৎপর্যও অনেক। তাই এই উৎসবটি শুধু আনন্দের নয়, প্রকৃত একজন মনের মানুষকে বেছে নেবার প্রতিজ্ঞার দিনও। এই উৎসব সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ঐক্য ও বন্ধনের প্রতীকও বটে। তাই তুমি পাহাড়িকাকে তুচ্ছ ভেবে দূরে সরিয়ে দিতে পারো না। এটা তোমার ভারি অন্যায়। তুমি মানতে পারো ,আমরা তা মানবো না।
এত কথা শোনার পর তারিখ মুখ খুলে, আমি কি করবো বলো?
পাহাড়িকাকে তোমার হৃদয়ে ঠাঁই দেবে তুমি। বুবলি স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে বলে।
আমি পারবো না। কারণ সে একজন রাজাকারের মেয়ে। রাজাকার আমার বাবার শত্রু, আমারও শত্রু। দেশের শত্রু। তাই সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
– ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’Ñ এই মূল্যবান কথাটি আমার নয়, তারিখ। একজন খ্যাতিমান কবির। কথাটিকে কীভাবে অস্বীকার করবে তুমি। পারবে অস্বীকার করতে? কথাগুলো পদ্মশ্রী গম্ভীরতর উঁচু শব্দে বলে।
মানুষ তো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সকল ধর্মই এ কথা বলে। তারিখ মনের কাছে প্রশ্ন রাখে, পদ্মশ্রী তো ঠিকই বলছে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’! তবে আমি কি ভুল সিদ্ধান্তই নিলাম? পাহাড়িকাকে দূরে সরিয়ে দেওয়াটা সঠিক নয়? না না না! সে তো রাজাকারের মেয়ে। তার সাথে আমার ভাব, সস্পর্ক! ছি ছি ছি। তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
কী ভেবে তারিখ কাউকে কিছু না বলে ছুটে যায়।
সবাই অবাক, পাহাড়িকা, পদ্মশ্রী, বুবলি।
কি অমন ঘটনা ঘটলো যে, তারিখ ছুটে গেল। তাও কাউকে কিছু না বলে! এটা তারিখের ঘোর অন্যায়।
বৈশাখের আজ চারদিন চলছে। প্রচণ্ড গরমে পুড়ছে পুরো দেশ। পার্বত্য জেলায়ও তাই। ঠা ঠা গরমে ছটফঠ করছে সবাই। মাথা ফাটা গরমে সব পুড়ছে। তীব্র গরমের জ্বালায় কি রাত, কি দুপুর, কি সকালে কারো চোখে ঘুম নেই। তারিখ আজ বেছে নিয়েছে ঘুমুবার জায়গা হিসেবে উঠোন। ও ঘরে শোবে না। বাড়ির মাটির উঠোনে একটি পাটি বিছিয়ে শোয়। ঘর থেকে তা অনেক আরাম।
আকাশে অনেক তারা। তবে আলো নেই। মেঘ নেই। বাতাস নেই কোথাও। চুপচাপ পাহাড়। ঘরের চেয়ে বাইরে বেশ ঠান্ডা। তবে মশার মায়া-আদরে ঘুম আসে-ভাঙে!
চমৎকার পরিবেশ। এই মাত্র শুরু হলো। পাহাড়িকার হাত তারিখের হাতে। নির্মল হাওয়া বইছে চতুর্দিকে। এই যেন মেঘ হাঁটছে আকাশে। মৃদু বাতাসের ছোঁয়া। পাহাড়ি কা বারবার বলছে, তারিখ, তুমি ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না। শুধু একটিবার বলো, তুমি আমার। চিরদিন আমাকে পাশে রাখবে। সুখে-দুঃখে।
ঠিক সেই মূহূর্তে তারিখের বাবা চান কুমার বলে, তারিখ, তোর ভাবনাটা ভুল। তুই এবং পাহাড়িকার বন্ধন পূর্বজন্ম থেকে লিখিত। এটা শুধু আমি নই, পৃথিবীর কেউ এই বাঁধন রোধ করতে পারবে না। তুই পাহাড়িকাকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করো, বাবা। ভুলে যা, সে একজন রাজাকারের মেয়ে।
বাবার গলার শব্দ পেয়ে তারিখের ঘুম ভাঙে। ইতিউতি দেখে চারপাশে। সে খোঁজে বাবা, পাহাড়িকাকে। কেউ নেই। গায়ে চাঁদের মিষ্টি আলো চিকচিক করে। উঠোনে পাটিতে শুয়ে আছে সে। গরম নেই। শান্ত -শীতল। তারিখের মুখে-ঠোঁটে হাসি। মন বলে, ছুটে যাবে পাহাড়িকার বাড়ি?
ধুত! না না সে হয় না। এখন তো গরম নেই। ঠান্ডা বুকে এতো রাতে নিশ্চয়ই পাহাড়িকা ঘুমুচ্ছে। পাহাড়িকা ঘুমাক নির্বিঘ্নে। তারিখ মত বদলায়। রাত শেষ হোক। সকাল হোক। ধলপহরে পৃথিবী যখন ঘুমে ডুবে থাকবে ঠিক তখন উচ্চ গলায় নয়, পাহাড়িকার কানে-কানে বাবার কথাটি শোনাবে গিয়ে।
রাত শেষ হয় না কেন! রাগে তারিখ নিজের ঠোঁট কামড়ায়। এক সময় ধীরে-ধীরে রাত শেষ হয়। ভোর হাসে। তারিখও হাসে। আজ তারিখের মনে অবাক আনন্দ খেলে। আহা! কী সুখ অন্তরে!