পাহাড়জুড়ে উৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি »

গত কদিনের আনুষ্ঠানিকতাগুলো পূর্ণতা পেয়ে প্রবেশ করলো উৎসব আঙিনায়। তিনদিনের বৈসাবি আয়োজনের প্রথম দিন ফুলবিজু অনুষ্ঠিত হলো পাহাড়জুড়ে বুধবার সকালে। মহাসমারোহে রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদেও নানান প্রান্তে নানা এলাকার মানুষ পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে নতুন বছরের জন্য শুভকামনা জানিয়ে গঙ্গা দেবীর নিকট প্রার্থনা করেন।

গতকাল বুধবার চাকমা জনগোষ্ঠীর ‘ফুল বিজু’, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘হাঁড়িবৈসু’ আর মারমা সম্প্রদায়ে সূচিকাজ। ঠিক ফুলবিজু নামে অভিহিত না হলেও এইদিন প্রায় সকল পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীই পানিতে ফুল ভাসানোর আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন প্রায় একই নিয়মে।

ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ফুলবিজু উপলক্ষে রাঙামাটি শহরের রাজবনবিহার ঘাট, পলওয়েল পার্ক, কেরানী পাহাড়সহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, সাংক্রান, বিহু-২০২৩ উদযাপন কমিটি ও ব্যাক্তিগত উদ্যেগে পানিতে ফুল ভাসানো হয়।

উৎসবের প্রথম দিনে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করে এবং কলাপাতা করে পবিত্র এই ফুল ভাসিয়ে দেয় পানিতে, তাই একে বলা হয় ‘ফুল বিজু’। পানিতে ফুল ভাসিয়ে নিজ পরিবার এবং দেশ তথা সমগ্র জীবের মুক্তির জন্য গঙ্গা দেবীর নিকট প্রার্থনা করা হয়। পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ বেদনাকে ভাসিয়ে দিয়ে নতুন দিনের সম্ভাবনার আলো জ্বালান পাহাড়ের বাসিন্দারা। পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো দিনের বেদনা ভুলে নতুন দিনের প্রত্যয়ের কথা জানায় ফুল ভাসাতে আসা পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা। ত্রিপুরারা এইদিন বয়স্কদের ¯œান করান, সংবর্ধিত করেন এবং নতুন কাপড় উপহার দেন।

রাঙামাটির রাজ বনবিহার ঘাটে হ্রদের পানিতে ফুল ভাসিয়ে দেবাশিষ চাকমা বলেন, ‘ফুল বিজু হলো আমাদের বিজু উৎসবের সূচনার দিন। এই দিন আমরা গঙ্গা দেবীকে ফুল নিবেদন করি। যাতে আমাদের সমগ্র দুঃখ কষ্ট মুছে যায় এবং নতুন বছরকে যাতে আমরা আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারি।

ফুল ভাসিয়ে আনন্দ চাকমা নামের এক তরুণ বলেন, আমরা এই দিনে পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হই। হ্রদের পানিতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের নতুন বছরের জন্য শুভকামনা আর প্রার্থনা জানাই। পাশাপাশি পানি যেহেতু আমাদের মানব জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই জলের দেবীকে গঙ্গার উদ্দেশ্যে আমরা ফুল নিবেদন করি।

সুনেত্রা তালুকদার নামের এক তরুণী বলেন, এটা আমাদের একটি চাকমা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। মূলত আমরা ফুলটা গঙ্গা দেবীকে দান করি সকল জীবের মঙ্গল কামনায়। অনেকে বিহারে ফুল দান করলেও সবাই একসাথে ফুল ভাসানোটাই এখন মূল আনন্দে রূপ নিয়েছে।

শহরের কেরানী পাহাড় এলাকায় রাঙামাটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট কতৃক আয়োজিত ফুল ভাসানো অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান নিজের আনন্দের কথা জানিয়ে বলেন, আজ (গতকাল) থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব বৈসাবির তিনদিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ পাহাড়ের বসবাসরত সমগ্র ক্ষু-নৃগোষ্ঠীদের আমি আমার রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈসাবির শুভেচ্ছ ও অভিনন্দন জানাই। আমি আশা করি এই উৎসব আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো দৃঢ় করবে।

বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, সাংক্রান, বিহু-২০২৩ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের সবচে বড় এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা কিছুদিন আগ থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছি। আজ ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে তিনদিনের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। সবাই যাতে নতুন বছর ভালোভাবে কাটাতে পারে সেই কামনা করি।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন কাপ্তাই হ্রদে মা গঁঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা করেছি। আমরা যাতে সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে সকল জাতিগোষ্ঠী এক হয়ে একসাথে বসবাস করতে পারি।

রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। শতবর্ষ ধরে পাহাড়ে আমরা বসবাস করে আসলেও সম্প্রীতি অটুট ছিল। আমরা প্রত্যাশা করছি আগামী দিনগুলোতেই সম্প্রতি অটুট থাকবে। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি সংরক্ষণের মধ্যদিয়ে আমাদের সংস্কৃতির প্রসার ঘটবে।

পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসব ১৬ এপ্রিল মারমা সম্প্রদায়ের জলকেলি’র মাধ্যমে শেষ হবে পাহাড়ের বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানোর এ অনুষ্ঠান তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচিত। এই উৎসব চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু নামে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মানুষ সাংগ্রাই, মারমা জনগোষ্ঠী মানুষ বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বিষু, কোনো কোনো জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে। বৈসুকের ‘বৈ’ সাংগ্রাইয়ের ‘সা’ ও বিজু, বিষু ও বিহুর ‘বি’ নিয়ে উৎসবটিকে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামে পালন করা হয়।

খাগড়াছড়ি
বিগত বছরের সমস্ত দুঃখ, গ্লানি মুছে দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে পাহাড়ি ও বাঙালিরা আনন্দে মেতেছে বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু ও বাংলা নববর্ষের উৎসবে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসব। যা ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত। বাংলা বর্ষের শেষ দিনে চাকমারা ‘ফুল বিজু’, ত্রিপুরা সম্প্রদায়েরা ‘হাঁরিবৈসু’ আর মারমা সম্প্রদায়ে ‘সূচিকাজ’ নামে পালন করে যা ‘ফুল বৈসু/ফুল বিঝু নামে সর্বাধিক পরিচিত। চেঙ্গী নদীতে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে মুখরিত ছিল গতকাল। এ ফুল বিঝু/বৈসুর দিনের চেঙ্গী পাড়ে ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা ও বাঙালি সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে ফুল দিয়ে গঙ্গাদেবীকে প্রণাম জানাতে আসেন।

এ সময় খাগড়াছড়ি জেলা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, জেলা পুলিশ সুপার মো.নাইমুল হক ও পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী, জেলা পরিষদের সদস্য কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া নদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এর মধ্য শুরু হয়েছে বৈসাবি’র আয়োজন। পানিতে ফুল দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এই উৎসব। এরপর পাহাড়ে ১৪ এপ্রিল মারমা সম্প্রদায়ের ‘জলকেলি’ উৎসব হবে।

গতকাল বুধবার সকালে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে জলে নানান রঙের ফুল দিয়ে উদযাপিত হয় ফুল বিজু।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম এই সামাজিক আয়োজনে ব্যস্ত এখন শহর, নগর আর পাহাড়ি গ্রামগুলো। বাংলা বর্ষ বিদায় ও বরণ উপলক্ষে ত্রিপুরারা বৈসুক/বৈসু, চাকমারা বিজু, মারমারা সংগ্রাই, সাওতালরা পাতা এভাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে আলাদাভাবে পালন করে এই উৎসব। উৎসবের প্রথম দিনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা ফুল আর নিমপাতা দিয়ে ঘর সাজায়।

ফুল বিজুর দিনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা বয়সী পাহাড়িরা ফুল নিয়ে আসতে শুরু করে বিভিন্ন ঘাটে। খুব ভোরে মা গঙ্গার উদ্দেশে নদীতে পবিত্র এই ফুল দিয়ে প্রণাম জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই উৎসব। উৎসবে নারীরা বাহারি রঙের ঐতিহ্যবাহী রিনাই-রিসা, পিনোন-হাদি পরে আর ছেলেরা ধুতি, পাঞ্জাবি/ফতুয়া পরে চেঙ্গী নদীতে ফুল দিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো বছরের সব গ্লানি মুছে নতুন বছর বয়ে আনবে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি এমনটাই প্রত্যাশা সকলের। তবে করোনার দুই বছরের বিষাদ ও বেদনা ভুলে আবারো প্রিয় বৈসাবি উদযাপন করতে পেরে খুশি সকলেই। ফুলবিজুর নানান আয়োজনে উপস্থিত বিশিষ্টজনরাও জানালেন নিজেদের উচ্ছাস, আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার কথা।

পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ বেদনাই যেন ভাসিয়ে দিয়ে নতুন দিনের সম্ভাবনার আলো জ্বালায় পাহাড়ের মানুষ। পুরনো দিনের বেদনা ভুলে নতুন দিনের প্রত্যয়ের কথা জানায় ফুল দিতে আসা পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা।

জেলা শহরের খবং পড়িয়াস্থ চেঙ্গী নদীতে ফুল দেয়ার সময় চাকমা সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি জানান, এটি পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ঐহিত্যবাহী সামাজিক উৎসব। পুরাতন বছরের সকল দুঃখ, গ্লানিকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরে জগতের সবাই যেন সুখে, শান্তিতে এবং আনন্দের সাথে কাটাতে পারি সেই প্রার্থনা করা হয় মা গঙ্গা দেবীর কাছে। সুন্দর পৃথিবী যেন ভালো হয়ে ওঠে এমনাটাই প্রত্যাশা।

চৈত্র মাসের শেষ দিনকে চাকমা সম্প্রদায়েরা বলে মূল বিজু। এর আগের দিনকে ফুল বিজু, আর পহেলা বৈশাখ পরিচিত গোজ্যেপোজ্যে/গজ্জ্যা পুজ্জ্যা দিন হিসেবে। এ দিন কেউ কোনো কাজ করে না, পাড়ায় ঘুরে ঘুরে, খেয়ে দিনটি পাড় করে থাকে। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন বৈসু পালন করা হয়। চাকমা সম্প্রদায়ে বিজু আদিকাল থেকেই চলে আসছে। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন বৈসু পালন করা হয়। ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ে বৈসু-সাংগ্রাই আদিমকাল থেকেই চলে আসছে। বৈসু-সাংগ্রাই মানে আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়, বৈসু-সাংগ্রাই মানে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো। বৈসু-সাংগ্রাই মানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, সর্বোপরি বৈসু-সাংগ্রাই মানে হলো মিলনমেলা।