নাথপাড়া বধ্যভূমি যেন পাড়ার মোড়ের ডাস্টবিন!

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »

মাত্র কয়েক ঘণ্টায় কুড়াল, কিরিচ আর রামদা দিয়ে কুপিয়ে ৩৯ জন স্থানয়ীসহ ৭৯ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ চট্টগ্রামে গণহত্যার সূচনা হয় মধ্যম হালিশহরের নাথপাড়ায়। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের (ইপিআর) ৪০ জন সদস্যের সহযোগিতায় এই হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছিলো স্থানীয় বিহারিরা। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নৃশংসভাবে হত্যা, এমনকি সন্তানের রক্তে মাকে স্নান করিয়ে বরর্বতা চালায় তারা। তাই এখানে স্বাধীনতা স্মৃতি ট্রাস্টের উদ্যোগে স্বাধীন বাংলাদেশের ৩০ বছর পর নির্মাণ করা হয় ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু এ স্থান পরিদর্শন করে মনে হয়, এ যেন পাড়ার মোড়ে গড়ে ওঠা কোনো ডাস্টবিন।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মধ্যম হালিশহরের নাথপাড়ায় বাদল নাথ, অনিল বিহারী নাথ, নারায়ণ চন্দ্র বৈষ্ণব, দুলাল কান্তি নাথসহ শতাধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করে বিহারিরা। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকায় কালের সাক্ষী এ জায়গাটিতে গড়ে ওঠেছে উঁচু উঁচু দালান। এমনকি নাথপাড়া জায়গাটির নামও বদলে হয়ে ওঠে মাইজপাড়া ও খুরশীদবাগ। মুছে যেতে বসেছিল চট্টগ্রামের প্রথম গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন। তবে ২০০১ সালে পাড়ার মোড়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হলেও অধিকাংশ শহীদ পরিবার এখনো পায়নি কোনো স্বীকৃতি। বহু শহীদের মধ্যে স্মৃতিস্তম্ভে ঠাঁই পেয়েছে সমীরণ, সুনীল, নিশিকান্ত, প্রকাশ, অক্ষয়, শিউলী রাণী, বাদল, অনিলসহ ৪২ জন শহীদের নাম।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, নাথপাড়া বধ্যভূমি সংস্কারহীন অবস্থায় পড়ে আছে। দেওয়ালে লেখা নামগুলোও যেন মুছে যাওয়ার বাকি। ছোট এ বধ্যভূমি নিয়ে নেই কারো কোনো মাথাব্যথা। পাড়ার মোড়ে অবস্থান থাকায় সবাই এটিকে ব্যবহার করছে ডাস্টবিনের মতো করেই। স্মৃতিস্তম্ভে জমে আছে পানি। সেখানে জন্ম নিয়েছে শেওলাসহ নানা পরজীবী উদ্ভিদ। নানা ময়লা আবর্জনার দেখা যাচ্ছে না স্মৃতিস্তম্ভের পদতল।

এ নিয়ে পাড়ার মোড়ের কিশোরের দলকে জিজ্ঞস করলে তারা বলে, ‘এটা শহীদ মিনার। এখানে সবসময় ময়লা থাকলেও বিজয় দিবসের আগে এগুলো পরিষ্কার করা হয়। আজকেও এগুলো পরিষ্কার করার জন্য একটা লোক আসছিলেন। কিন্তু উনি আবার চলে যান।’

ওই লোকের নাম পরিচয় জানতে চাইলে জানা যায়, তিনি পিযূষ কুমার নাথ (৭২)। উনার বাবা অনিল বিহারী নাথকে ৩১ ডিসেম্বর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। পরিষ্কার করতে এসে শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করায় তিনি আবার ঘরে ফিরে যান। উনার ঘরে গিয়ে কথা হয় দেখা যায়, তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন হাঁটতে যাওয়ার জন্য।

সুপ্রভাতকে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় আমি ক্লাস টেনের (দশম) ছাত্র ছিলাম। আমাদের চারপাশে পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করতো। এখানে যুদ্ধের শুরুতেই ৩১ মার্চ বুধবার বিহারিরা আমাদের ওপর নির্মম অত্যাচার শুরু করে। তারা আমার বাবাকে আমার সামনে কেটে মেরে ফেলেছে। পুত্রের সামনে পিতাকে খুন করার পরও পুত্র কিছু করতে না পারার মতো আর কোনো দুঃখ আর হয় না। এরপরও দুলাল ও বাদলকে খুন করে তাদের রক্তে তাদের মাকে স্নান করিয়েছিলো। এমন মর্মান্তিক কোনো দৃশ্য পৃথিবীতে থাকতে পারে না। এসব বলতে আমার চোখে সব ভাসতে শুরু করেছে।’

এ কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ভরে ওঠে কান্নায়। একপর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘এসব এখন দেখার কেউ নেই। আমারও বয়স হচ্ছে। আমার বয়সী যারা ছিলেন, তাদের অনেকে মারা গেছেন। এখন সরকার যদি এ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার দায়িত্ব না নেয়, তাহলে কাকে কি বলবো। আমরা ছোট ছিলাম। কিন্তু আমরা চুপ ছিলাম না। এখানে আমরাও ইপিআর সেনাদের মেরেছি। বিহারিদের মেরেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছি। কিন্তু আমরা এসব কোনো কিছুরই স্বীকৃতি চাই না। এ স্মৃতিস্তম্ভ টিকিয়ে রাখার জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি। অনেকের প্রতিশ্রুতি শুনেছি। এখন আর এসব ভাবি না।’

তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, দুই সন্তানের রক্তে ¯œান করানোর হয়েছিলো নিরবালা দেবীকে। তিনি বেঁচে নেই। তবে তার ঘরে রয়েছেন তার মেয়ে, ছোট ছেলেসহ পুত্রবধূ ও নাতি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁর পুত্রবধূ বলেন, ‘এসব বলে লাভ কি? প্রতিবছর ডিসেম্বর ও মার্চে আপনারা আসেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সংস্থার মানুষ আসেন। কোনোকিছুই তো হয় না। আমার শাশুড়িকে তার দুই ছেলের রক্ত দিয়ে ¯œান করিয়েছিল। উনি এখন বেঁচে নেই। আমার ননদ এখনও বেঁচে আছে। তিনি পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচতে আগুনে ঝাঁপ নিয়ে পুরো শরীর পুড়ে ফেলেছিলেন। তার খবর কেউ নেয় না। এই একটা মহিলা পুরো গায়ে পোড়া চিহ্ন নিয়ে একা একা কিভাবে আছেন তা কেউ জানে না। উনি এখন কারো সঙ্গে কথাও বলেন না।’

প্রসঙ্গত, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে হালিশহর ইপিআর ঘাঁটি থেকে মেজর রফিকের নেতৃত্বাধীন ইপিআর বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় দক্ষিণ হালিশহরের লোকজন নানাভাবে ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পাক হানাদার বাহিনী। পরবর্তীতে, ২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গোপসাগরের উপকূল হয়ে দক্ষিণ কাট্টলীর ইপিআর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। তাই প্রথম হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় নাথপাড়া এলাকায়। অধ্যাপক ঢালী আল মামুনসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যেগে নির্মিত শহীদ বেদীর জন্য জমি দান করেন শহীদ হেমেন্দ্র কুমার নাথের সন্তান।