নসু চেয়ারম্যান

জসিম উদ্দিন মনছুরি »

নসু ইদানিং চেয়ারম্যানের পিছু-পিছুই থাকে। চেয়ারম্যানের বাজার-সদাই করা, সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়াসহ যাবতীয় কাজকর্মে সহায়তা করে থাকে। গরমে চেয়ারম্যানের ছাতাটাও সে ধরে। উদ্দেশ্য চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হয়ে দুচার টাকা কামাই করা। ক্ষমতার ব্যাপার তো আছেই। চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের পর সিলটাও সে বসিয়ে দেয়। দুচার মাস যেতে না যেতে সে চেয়ারম্যানের আপন লোক হিসেবে পরিচিতি পায়। লোকেরাও নসুকে সুপারিশ করে যেন চেয়ারম্যান তার কার্যটা সিদ্ধি করে দেয়। নসু আগে আবুল বিড়ি ফুঁকতো। ইদানিং আয়-রোজগার বেড়ে যাওয়ায় সাহায্য প্রার্থীরা তাকে ডার্বি সিগাটের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। নসুর ঘরও টিনের চালা থেকে সেমি পাকা হয়। চেয়ারম্যানের যেকোনো কাজে-অকাজে নসুর ডাক পড়ে। নসুও মহাখুশি। নসুর ক্ষমতা বাডতে থাকে। মাঝে-মাঝে শালিস-বিচারেও তার ডাক পড়ে।
নসু আগে এলাকায় ছোটখাটো চুরি-চামারি করে বেড়াতো । মুরগি চুরি, ছাগল চুরি, বদনা চুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এলাকায় চোর হিসেবে তার পরিচিতি ব্যাপক। পরে অব্যশ্য মাছধরার ট্রলার বেয়ে দিনকাল কোনোমতে কাটাচ্ছিল। শফির বোটে নসু মাছ ধরতো। নসু চুরিবিদ্যায় পারদর্শী হওয়াতে কষ্ট করে মাছধরায় তার আগ্রহ ছিল না। সে অন্য মাঝি-মাল্লাদের বোঝায়, এত কষ্ট না করে দস্যুপনা করে মাছ ছিনিয়ে আনলেই তো রোজগার বাড়ে। দু-একজন সায় না দিলেও অধিকাংশ তার মতে সাই দেয়। যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। নসু অস্ত্র কেনে। কাটাবন্দুক। তারা আর কষ্ট করে মাছ ধরে না। বিভিন্ন ট্রলার থেকে মাছ ছিনিয়ে আনে। শফি কোম্পানির ট্রলারে আয়ও বাড়ে। প্রচুর ইলিশ মাছ পায়। টাকা আর টাকা।
নসু : ওই বোটটা ধরতে হবে। মনে হয় প্রচুর মাছ পেয়েছে। চল …
জুনু : মাঝি , আঁরার তেল শেষ। কিছু তেল দিবা?
বোটটি ছিল মহেশখালীর জাগির কোম্পানির। কোম্পানি দয়ালু লোক। আহা বেচারাদের মাঝসাগরে তেল শেষ, কী অবস্থা হবে। কাসেম মিশিন কমা। আমাদের তো পর্যাপ্ত তেল আছে। কিছু তেল দে। মাছও তো অনেক পেয়েছি।
জাগির কোম্পানি ট্রলার থামিয়ে নসুদের তেল দিতে যায়। বোট ভেড়াতেই নসু তার কাটাবন্দুক নিয়ে, বাকিরা দা-কিরিচ নিয়ে জাগির কোম্পানির লোকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সব মাছ ছিনিয়ে নেয়। জাগির কোম্পানি বাধা দেওয়ায় তাকে বেধড়ক পেটায়। তার দুটি আঙুল কেটে নেয়। সেবার নসুদের পনের লক্ষ টাকা লাভ হয়। শফি কোম্পানি মহা খুশি। তার আয় বাড়ে রাতারাতি।
এভাবে নসুর দিনকাল ভালোই কাটছিল। এখন সে সাগরের দস্যু সম্রাট। যে কেউ নসুর নাম শুনলে তটস্থ হয়। নসু আর এখন কারো অধীনে মাছ ধরে না।
নিজে একটা বোট নিয়ে দস্যুবাহিনী গঠন করে দস্যুতা চালায়। অনেকের বোট ধরে নিয়ে আসে, মুক্তিপণে ছেড়ে দেয়। নেয় মোটা অংকের টাকা।
এভাবে নসুর প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ে। গাঁ-গেরামের সবাই তাকে সমীহ করে চলে। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সে অজস্র দান করে। অসহায় মেয়েদের বিয়ের খরচ দিয়ে, মসজিদ বানানোর সওয়াব লুটে নেয়। তার পাঁচতলা বাড়ি ওঠে। খাস কামরায় বসে শালিস বিচার-করে। তার বিচার ন্যায়-অন্যায় যা হোক, কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। প্রতিটি মাহফিলেই সে প্রধান অতিথি। এক লক্ষ টাকার কমে কাউকে দেয় না। গাড়ি কেনে। ড্রাইভার রাখে মোটা অংকের বেতনে। এভাবে নসুর উত্থান হয়। প্রতিটি বিচারে তাকে দশ হাজার দিতে হয়।
মান-সম্মান ক্ষমতা-প্রতিপত্তির নসুকে সবাই অনুরোধ করে সে যেন এবারের ইলেকশনে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ায়। তার প্রতীক সিংহ। পোস্টারে লেখা হয় ‘জনদরদি, দানবীর, ন্যায়বিচারক নসু চৌধুরীকে সিংহ মার্কায় ভোট দিয়ে জনগণের সেবা করার সুযোগ দিন।’
গ্রামের মানুষ নগদে বিশ্বাসী। তাই টাকার কুমির নসু চৌধুরী প্রতি ভোট পাঁচ হাজারে কিনে নিয়ে বিপুলভাবে নির্বাচিত হয়। দাপটের সাথেই নসু এখন চেয়ারম্যানি চালিয়ে যাচ্ছে। তার বাড়িতে সাইনবোর্ডের মতো করে টাঙিয়ে দেয়া আছে :

নসু চৌধুরী, চেয়ারম্যান
১২ নং গঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ।
লোকেও এখন তার বাড়িকে
চেয়ারম্যান বাড়ি বলে ডাকে।