দৃশ্যমান করতে শহীদ মিনারের উচ্চতা আরো বাড়ানো হবে: মেয়র

‘চট্টগ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিপ্লব উদ্যানের দোকান তুলে দিতে চাইলে আমার কিন্তু দ্বিমত নাই’

সুপ্রভাত জানতে চাই ♦

সমসাময়িক আলোচিত বিষয় নিয়ে সুপ্রভাত বাংলাদেশের বিশেষ আয়োজন ‘সুপ্রভাত জানতে চাই’। সাক্ষাৎকারভিত্তিক এ পরিবেশনার দ্বিতীয় পর্বেও যুক্ত ছিলেন সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।

সুপ্রভাত ডিজিটাল প্লাটফর্মে প্রচারিত সাক্ষাৎকারটি সুপ্রিয় পাঠকদের জন্য আজ তুলে ধরা হলো।

সুপ্রভাত : এবার স্বাধীনতা দিবসে আমরা কি আমাদের সেই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে পারবো নাকি এবারো আমাদেরকে অস্থায়ী শহীদ মিনারে যেতে হবে?

রেজাউল: শহীদ মিনারকে নিয়ে আমাদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমি সকলকে, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, নাট্যকার সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে আমি  ডেকেছিলাম এবং একটা মতামত নিয়েছিলাম। সকলের মতামতের ভিত্তিতে যেহেতু শহীদ মিনার আবার নতুন করে, নতুন আঙ্গিকে করবে তাই এটাকে আমরা মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের ওখানে স্থানান্তরিত করেছিলাম অস্থায়ীভাবে।

কিন্তু তৈরি হওয়ার পরে আমরা শহীদ মিনার দেখে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছি। তখন আমি সবাইকে আবার ডেকেছিলাম এবং সবাইকে নিয়ে ওখানে বসেছিলাম। সবাই এতে খুব ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।  আমি নিজেও বিস্মিত হয়েছি। কারণ শহীদ মিনার থাকবে খোলামেলা, প্রশস্ত সিঁড়ি থাকবে, সবাই গিয়ে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। এখন এমনভাবে এটিকে গড়েছে মনে হয় যেন কোনো একটি ঐতিহাসিক দালানের সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, তারপর দেখছি শহীদ মিনার এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে  তো শহীদ মিনার এমন হতে পারে না। সবচেয়ে মারাত্বক ব্যাপার হচ্ছে-এখানে উঠতেও যেমন কেউ দুর্ঘটনার শিকার হবে, নামতেও একইভাবে দুর্ঘটনার শিকার হবে। সেখানে তো কেউ আর একা একা যায় না, সবাই দলবদ্ধ হয়ে যায়। মিছিল নিয়ে যায়। সেখানে আবেগ কাজ করে। এজন্যে আমরা আবার সবাইকে ডেকেছি, সবার মতামত নিয়েছি। আমরা এ শহীদ মিনার চাই না। আমরা দৃশ্যমান শহীদ মিনার চেয়েছিলাম। পথ দিয়ে যাওয়ার সময়ে একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করবে-শহীদ মিনার কোথায়, তাকে আমি দোতলায় নিয়ে গিয়ে শহীদ মিনার দেখাতে হবে। এজন্যে সবাই বলেছেন, আমরা এ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করবো না, যতদিন শহীদ মিনার দৃশ্যমান না হয়।

সুপ্রভাত : আমাদের যারা নীতিনির্ধারক, যারা উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করেন তাদের মস্তিষ্কে সবসময়েই কাজ করে যে অবকাঠামো মানেই উন্নয়ন, বিল্ডিং বানানো মানেই উন্নয়ন, ইমারত মানেই উন্নয়ন। আসলে কি তাই ? যেমন ধরুন, এখানে যে মুসলিম হল ছিল, সেখানে সামনে খোলা চত্বর ছিল, পাবলিক লাইব্রেরি ছিল। আমরা এখানে বইমেলা করতাম, অনেক অনুষ্ঠান করেছি এখানে। সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতায় এখানে মাসব্যাপী বইমেলা হতো।

আমরা ভেবেছিলাম সেই খোলা জায়গার সঙ্গে শহীদ মিনারের খোলা জায়গা মিলে বড় একটা ময়দান হয়ে যাবে। গত ফেব্রুয়ারিতেই আপনি যখন বইমেলার জন্যে খালি জায়গা খুঁজছিলেন তখন বাধ্য হয়ে সিআরবিতে যেতে হয়েছে, অথচ এখানেই তা করা যেতো। আপনি এসব বিষয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

রেজাউল: আসলে এ অসঙ্গতিটা হতো না, এ প্রসঙ্গে আমরা ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে- যদি এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট সবার মতামতকে সংষ্পৃক্ত করা যেতো তাহলে এ প্রশ্নগুলো উঠতো না। কারণ যে কোনো একটা হলের  সামনে একটা খোলা জায়গা থাকলে যে অনুভূতিটা থাকে, সেখানে যদি আপনি ইমারত দিয়ে, পাথর দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেন তাহলে আপনার সে অনুভূতি থাকবে না। আমার মনে হয়, আমাদের মুসলিম হল এখন যেভাবে করা হয়েছে তার থেকে আগে যে অবস্থায় ছিল তা অনেক ভালো ছিল।  কারণ সেখানে আমাদের একটা প্রশস্ত মাঠ ছিল, ওখানে গিয়ে আমরা হলটাতে যেতাম সেখানে আলো-বাতাস সবকিছু ছিল। কোনো একটা অনুষ্ঠান হলে বাইরে করতে হতো, বইমেলা বলেন বা শহীদ মিনারে কোনো একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে তখন এখানে ঠাসা মানুষের জমায়েত হতো। শহীদ মিনারটি দৃশ্যমান ছিল। মোটকথা সেখানে একটা আলাদা পরিবেশ সৃষ্টি হতো। আমরা এখন সেই পরিবেশটাকে ধ্বংস করেছি। এতে কালচারাল কমপ্লেক্স, শহীদ মিনার, বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে কথা হয়।

সুপ্রভাত :  আপনি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তিন বছর হলো, এ সময়ে একজন নগর পিতা হিসেবে এই কালচারাল কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কেউ কি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি? অথবা আপনি নিজ থেকে কি তখন কমপ্লেক্সটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন?

রেজাউল: আমি এতটুকু বলবো, কেউ এ প্রসঙ্গে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এটা উচিত ছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এলকায় কোনো স্থাপনা বা কোনো প্রজেক্ট (প্রকল্প) কোনো সংস্থা করতে গেলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে সঙ্গে যদি আলাপ-আলোচনা করা হয় তাহলে এক্ষেত্রে কোনো অসঙ্গতি থাকলে তা দূরীভূত হবে। এখানে আমরা সবসময়ে জবাবদিহিতার মধ্যে থাকি। কারণ আমরা কোনো কাজ করতে অবশ্যই চিন্তা করি, এ কাজটা করলে আমার নাগরিকেরা কোনো অসন্তুষ্ট হচ্ছে কি-না। কালচারাল কমপ্লেক্স নির্মাণের ব্যাপারেও যদি আমার  সঙ্গে আলাপ করতো তাহলে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসা যেতো। তা না করায় আজ অপরিকল্পিতভাবে রাস্তার ওপর এভাবে একটি শহীদ মিনার গড়ে তোলা হয়েছে।

সুপ্রভাত : আপনি তো এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে একটা কমিটির মাধ্যমে সুপারিশ জানিয়েছিলেন, এটা কি তারা আমলে নেয়নি ?

রেজাউল: আমি শহীদ মিনারের যিনি স্থপতি ওনাকে ডেকেছিলাম। উনি এসেছিলেন এবং চট্টগ্রামের যাঁরা স্থপতি ওনারাও এসেছিলেন। তাঁরা সবাই সরেজমিনে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে শহীদ মিনারের এলাকাটি পরিদর্শন করে একটা প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে শহীদ মিনারের উচ্চতা আরো বাড়ানো এবং সাইড ওয়াল ভেঙ্গে দেয়া এবং সিঁড়ির প্রশস্ততা বাড়ানোর বিষয় আছে। এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে মোটামুটি এ শহীদ মিনার দৃশ্যমান হবে।

সুপ্রভাত : নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি নগরে অন্তত ২৫ শতাংশ খোলা জায়গা রাখা প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের এ শহরে তো তেমন কোনো জায়গা নেই। এরমধ্যে নগরের বিপ্লব উদ্যানে যে খোলা জায়গা ছিল, অনেকেই সকাল-বিকাল সেখানে ঘোরাঘুরি করার সুযোগ পেতো। কিন্তু আপনার আগে যিনি মেয়র ছিলেন, তাঁর সময়ে সেখানে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে দোকান ভাড়া দেয়া হয়। আমরা ভেবেছিলাম আপনি দায়িত্ব নেয়ার পর এই প্রকৃতিবিনাশী যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তার বিপক্ষে দাঁড়াবেন। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম, আপনার সময়েও এ ভুলগুলো শোধরানোর কোনো চেষ্টা করা হলো না। বরং সেখানে নতুন করে আরো কিছু স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাইছি।

রেজাউল:  আসলে নতুন কোনো স্থাপনা সেখানে তৈরি করা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, বিপ্লব উদ্যানে কোনো প্রকার বাণিজ্যিক স্থাপনা থাকার বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি রাজি না। আমাদের পূর্ববর্তী যারা ওখানে দোকান, মার্কেট করে গিয়েছেন সেগুলো তুলতে হলে আমাকে সবকিছু কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে। এখানে আর্থিক ব্যাপার আছে। আমরা এটার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ওনারা (দোকান মালিক) মামলা করেছেন। পরে এ নিয়ে একটা সমঝোতা হলে আমি একটা প্রস্তাব দিই, যখন পূর্বের দোকানপাটগুলো ভাঙা যাচ্ছে না, মার্কেট ভাঙা যাচ্ছে না। কারণ এতে অনেক আর্থিক দায় বহন করতে হবে। আমার প্রস্তাবটি ছিল এরকম- মার্কেটের ওপরে দ্বিতীয় তলায় একটি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর হবে, চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জাদুঘর হবে। আর এতে দোকানগুলো যাতে পার্ক থেকে দেখা না যায়, দোকানগুলো যাতে ঢেকে যায় সে জন্যে আমি একটি প্রস্তাব দিয়োছিলাম সবুজ অর্কিড দিয়ে তৈরি একটি বড় ফ্ল্যাগ একশো-দেড়শো ফুট উচ্চতার  ফ্ল্যাগ তৈরি করে দেয়ার জন্যে, যাতে দোকানগুলো আর দেখা না যায়। এতে অনেকে মনে করেছেন আমরা ওখানে নতুন করে দোকান করছি। আসলে দোকান করার কোনো চুক্তি হয় নাই। আমি বলেছি, পার্কে সবুজ প্রকৃতির প্রাধ্যন্য থাকতে হবে। আর তার প্রস্তাব রেখেছে, আগে থেকে নির্মিত কিডস রুমগুলো রাখার জন্যে, আমি শুধু দুটি রুম রাখতে বলেছি। এছাড়া আমি নতুন ভাবে কোনো স্থাপনা করার পারমিশন (অনুমোদন) দিই নাই। এরপরেও যদি চট্টগ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ দোকানগুলো তুলে দেয়ার জন্যে এগিয়ে আসে আমার কিন্তু দ্বিমত নাই, আমি কিন্তু একমত। এখানে আমি লজ্জিত হয়েছি একটা জিনিস দেখে, কিছুদিন আগে আমি পেপারে (পত্রিকায়) দেখলাম ‘বিপ্লব উদ্যান মার্কেট মালিক সমিতি’। তাহলে উদ্যান নাই আর, এটা মার্কেট হয়ে গেছে। আমি নীতিগতভাবে এটাকে মেনে নিতে পারি না।