তেল গ্যাস সন্ধানে সম্ভাবনার আলো

আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করবে বাংলাদেশ

ডেস্ক রির্পোর্ট »

সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ। সংশোধিত মডেল পিএসসির আওতায় অবশেষে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎপাদন বাড়াতে বঙ্গোপসাগরের ২৪টি ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আগামী ১০ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্রের আহ্বান করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের ২৪ ব্লকে (অফশোর ব্লক) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা থাকবে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপর এসব দরপত্র মূল্যায়ন করতে সময় লেগে যেতে পারে চলতি বছর।

বিদেশি ৫৫টি কোম্পানিকে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হবে। দরপত্রে অংশ নিতে পারে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন, এক্সন মবিলসহ চীনের একাধিক কোম্পানি।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, দরপত্র আহ্বানের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এর সব শর্ত ও সুবিধা জানানো হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি তেল কোম্পানির সঙ্গে প্রি-মিটিং, ইকোনমিস্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, ঢাকায় রোড শোসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে সরকার।

২০১২ ও ২০১৪ সালে মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশের সব প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের পর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে ঢাকার বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের উপকূলের অনেকাংশ এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।

গভীর বঙ্গোপসাগরে নিজ সীমানায় অনুসন্ধান চালিয়ে এরই মধ্যে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছে ভারত ও মিয়ানমার। চলতি বছরের শুরুতে অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে গভীর সাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার করেছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি)। খনিটি থেকে দৈনিক ৪৫ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল এবং ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। খনিটি থেকে উত্তোলন কার্যক্রম শুরু হলে দেশটির শুধু জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ অর্থ সাশ্রয় হবে ১০ হাজার কোটি রুপির মতো।

আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারও এরই মধ্যে গভীর সাগরে অনুসন্ধান চালিয়ে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছে। বাংলাদেশের সীমানার নিকটবর্তী এলাকার মিয়া ও শোয়ে নামে দুটি গ্যাসকূপ থেকে এরই মধ্যে কয়েক ট্রিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করে ফেলেছে দেশটি। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে এ গ্যাস তারা এখন চীনেও রফতানি করছে।

২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় মিয়ানমারের। এরপর ২০১৩ সালে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে দেশটি। এরপর ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয় ২০১৪ সালে। এরই মধ্যে এ নিষ্পত্তিরও ১০ বছর পেরিয়েছে। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে কোনো সাফল্যেরই দেখা পায়নি বাংলাদেশ।

বঙ্গোপসাগরে গভীর-অগভীর সমুদ্রে মোট ২৬টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক রয়েছে। সর্বশেষ ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছিল পেট্রোবাংলা। সেই দরপত্রে নয়টি ব্লকের জন্য বিদেশী কোম্পানিগুলো কাজ করার আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত তিনটি ব্লক ইজারা নিয়েছিল আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি ওএনজিসি এসএস ৪ ও ৯ নম্বর ব্লক ইজারা নিয়েছিল। আর অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান সান্তোস ইজারা নিয়েছিল ১১ নম্বর ব্লক। তবে সে প্রক্রিয়া থেকে ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি।

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ২০২৩ সালে মডেল পিএসসির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার। এর আওতায় বিদেশী কোম্পানিগুলোকে ব্লক ইজারা দেয়া হবে। সংশোধিত এ মডেল চুক্তি অনুযায়ী, সাগরে গ্যাস পাওয়া গেলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ১০ শতাংশ ধরে সরকার প্রতি ইউনিট গ্যাস কিনবে।

সংশোধিত মডেল পিএসসিতে দামের পাশাপাশি সরকারের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এর আগে মডেল পিএসসি-২০১৯-এ বলা হয়েছিল, গ্যাসের উত্তোলন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এতে বাংলাদেশের শেয়ার অনুপাতও বাড়তে থাকবে। আর কমতে থাকবে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার।

এবারের মডেল পিএসসি চুক্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের হিস্যা গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করবে। তবে ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ের দুই বছরের মধ্যে কূপ খনন করে গ্যাস না পেলে বা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য না হলে শর্তসাপেক্ষে যথাক্রমে ১ ও ২ শতাংশ হিস্যা বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।

সীমানা নিষ্পত্তির পর গভীর সমুদ্রে জ্বালানি অনুসন্ধানে মনোযোগ বাড়িয়েছে মিয়ানমার ও ভারত। আর বাংলাদেশ সময়ক্ষেপণ করেছে আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নে।

বিশেজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আবারও উদ্যোগ নিতে পেরেছে, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক। আরো আগেই দরপত্র আহ্বানের কাজটি করা জরুরি ছিল। দরপত্রে বিদেশী কোম্পানিকে আকৃষ্ট করা গেলে দেশের জ্বালানি খাতের জন্য ভালো কিছু হবে।  কারণ মিয়ানমার ও ভারত আমাদের সমুদ্রসীমার কাছে গ্যাস পেয়েছে। আমাদের সীমানায়ও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, এমনই মনে করেন বিশেজ্ঞরা।