টিসিবি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ

এ আর এম শামিম উদ্দিন »

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে এই দৃশ্য সাধারণ যে, কারণে অকারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাতে মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত জনসাধারণের জীবনযাত্রা অত্যন্ত দুর্বিষহ ও কষ্টকর হয়ে উঠে।
এ বিষয়টি অবতারণা করার বাসনা জেগেছে যখন আমি আন্দরকিল্লা বাড়ি থেকে অফিসে যাওয়ার পথে জামালখান ক্রস করার সময় দেখি টিসিবির ন্যায্যমূল্যের ট্রাকে মজুদ নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল নেয়ার জন্য রোদে পুড়ে সাধারণ মানুষ দীর্ঘলাইন দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এ দৃশ্য সত্যিই কষ্টদায়ক। সরকারের এ ব্যবস্থার দুটি উদ্দেশ্য, প্রথমত সাধারণ জনগণকে ন্যায্যমূল্যে প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করা অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে প্রভাব ফেলা। কিন্তু আমি মনে করি এ ব্যবস্থা অত্যন্ত সাময়িক এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
স্বাধীনতার পর জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের বিনা কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো প্রতিরোধ করতে হলে সরকারি উদ্যোগে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে যেটি ন্যায্যমূল্যে জনসাধারণকে মালামাল সরবরাহ করবে অন্যদিকে সারাদেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে যার ফলশ্রুতিতে তিনি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা জনগণ লক্ষ্য করছি অজ্ঞাতকারণে টিসিবিকে নির্লিপ্ত করে রাখা হয়েছে এবং যেসব মালামাল সরবরাহ করা হয় তা অত্যন্ত নি¤œমানের। এসব কারণে সরকারের টিসিবিকে শক্তিশালী করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কোন চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
আমরা মাঝে মাঝে লক্ষ্য করি সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য মজুতদারদের গুদামে হানা দেয় এবং বাজারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে; তাতে দ্রব্যমূল্য আরো বৃদ্ধি পায় কারণ খ- খ-ভাবে এরকম ব্যবস্থা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে না বলে আমি মনে করি।
সারাদেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে
১। টিসিবিকে অত্যন্ত শক্তিশালী করতে হবে এবং একটি সিস্টেমের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
২। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কোন কোন বিশেষ সময়ে ন্যায্যমূল্যে সামান্যতম মালামাল সাধারণ মানুষকে লাইন ধরে সরবরাহ করা কোন উত্তম ব্যবস্থা নয়। অধিকন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই অসম্মানিত ব্যবস্থায় না পারছে লাইন ধরতে না পারছে সীমিত আয় দিয়ে সংসার চালাতে।
৩। টিসিবিকে অর্থবল ও জনবল দিয়ে নতুনভাবে সাজাতে হবে।
৪। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় টিসিবির স্থায়ীভাবে বিক্রয়কেন্দ্র থাকতে হবে যাতে সারা বৎসর জনগণ ন্যায্যমূল্যে ভাল মানের নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল সহজেই টিসিবির দোকান থেকে কিনতে পারে যেখানে থাকবে কাঁচা বাজার, শুকনা বাজার, মাছ, মাংস ইত্যাদি মালামাল।
৫। সরকার উন্নয়নের জন্য বড় বড় প্রজেক্ট পাশ করেছে এবং বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করছে অথচ জনগণের অত্যান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেনো ফলপ্রসু প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছে না।
৬। টিসিবির দেশি-বিদেশি মালামাল ক্রয়ে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। যৌক্তিক মূল্যে, কোয়ালিটিসম্পন্ন মালামাল ক্রয় ও আমদানি করতে হবে। অতীতে আমরা সংবাদপত্র মাধ্যমে জেনেছি পোকাযুক্ত চাউল, ময়দা, আটা ইত্যাদি ক্রয় করা হয়েছে যা কিনা টিসিবির মালামালের প্রতি জনসাধারণের অনীহা সৃষ্টি হয়েছে এ পরিস্থিতির উন্নতি একান্ত প্রয়োজন।
৭। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ ক (ধারা) অনুযায়ী সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব অতএব এই মৌলিক চাহিদার মধ্যে সরকার টিসিবির মাধ্যমে প্রতি জেলা ও উপজেলায় বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে অন্নবস্ত্রসহ মালামাল ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় করলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
৮। শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থার পাশাপাশি কাজ করলে একটি ভাল সুফল পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ- চিকিৎসা, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও যাতায়াত ব্যবস্থায় মানুষ সুফল পাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারেও বলা যায় কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্বল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রের ভাল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় ও প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে তার উদ্দেশ্য বিনষ্ট করে দেয়। এজন্য সরকারি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসমূহ মনিটরিং ও সুপারভিশন শক্তিশালী করতে হবে।
৯। কৃষকের কাছ থেকে সরকার ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল মালামাল ক্রয় করে টিসিবির বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রয় করলে দ্রব্যমূল্য অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে পাশাপাশি কৃষকের কাছ থেকে মালামাল সংগ্রহ করে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্দেশ্যকে নিয়মিত কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
১০। টিসিবির জন্য বিদেশ থেকে মালামাল ক্রয়ে এলসি খোলার সময়ে ভাল মালামাল, সঠিক দামে, সঠিক দেশ থেকে ক্রয় করা হচ্ছে কিনা কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। এবং মাল দেশে পৌঁছার পর বা গুদামে পৌঁছার পর এলসি অনুযায়ী মালামালের সার্ভে ও তদন্ত নিয়মিত চালু রাখতে হবে। পরিশেষে আমি আশা রাখি সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে টিসিবিকে মানুষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে।
স্বাধীনতার ৫০ বৎসর পরে জনগণের এ আশা পোষণ করা তাদের অধিকার। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ও জনসাধারণের কষ্ট লাঘবে টিসিবির কর্মকা-ের ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে এ প্রত্যাশা রইল।
লেখক : প্রাবন্ধিক