হালখাতা ঐতিহ্যে আবারো সাজুক নববর্ষ

মো. মহসীন »

প্রতি বাংলা বছরের শেষ দিকে বাঙালি নতুন বর্ষবরণ নিয়ে এক অনাবিল সুখ খুঁজে পায়। এই নববর্ষ পালনে বাঙালিরা এক প্রাণের উৎসবে মেতে উঠে। বাংলা বছরের শুরুতে পহেলা বৈশাখ বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে অনেক মনকাড়া আয়োজন ।
এই ক্ষেত্রে বছরের শুরুতে শহরের ব্যাবসায়ীরা বিদায়ী বছরের হিসাব নিকাশের সমন্বয় করে নতুন বছরের হিসাব হালনাগাদ করার জন্য একটা লালখাতা দিয়ে হালখাতায় লিখন পর্ব শুরু করেন।
প্রকৃতপক্ষে হালখাতা, বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব নিকাশ আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার একটা ঐতিহ্যগত প্রক্রিয়া। এই হালখাতা উৎসবে দোকানপাটের ব্যবসায়ীরা নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ও খরিদ্দারদের দাওয়াত করে আর উৎসব উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এই হালখাতার মনজুড়ানো উৎসব। বিশেষ করে স্বর্ণ ব্যাবসায়ীরা আজও দেশের অনেক স্থানে তাদের দোকানগুলো রঙিন সাজে সাজিয়ে হালখাতা উৎসব পালন করে থাকে।
গ্রামের হালখাতা উৎসবে ব্যবসায়ীরা বৈশাখ শুরুর প্রারম্ভ থেকে দোকানপাট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে কাগজের রকমারি ফুল ও বেলুন দিয়ে বর্ণিল সাজে সাজিয়ে নেয়। ক্রেতাদের আপ্যায়ন করতো জিলাপি,মিষ্টি ,খাজা ও দই চিড়া দিয়ে। এ উপলক্ষ্যে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খরিদ্দারকে মিস্টিমুখ করিয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে কিছু আকর্ষণীয় উপহার সামগ্রীও তাদেরকে দিয়ে থাকে।
শুভাকাক্সক্ষী ও খরিদ্দার তাদের সামর্থ অনুযায়ী পুরোনো লেনদেনগুলো হালনাগাদ করে নিতো। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো।প্রকৃতপক্ষে হিসাবের এই খাতা হাল নাগাদ করা থেকে ‘হালখাতা’-র উদ্ভব হয়।
ইতিহাসে প্রেক্ষাপটে বলা যায়, মোগল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বহু রীতিনীতি ও প্রথার উদ্ভব হয়েছিল এবং সেই সাথে শুরু হয় বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাবগুলো সাজানো আনুষ্ঠানিকতায় হালনাগাদ করার বিশেষ প্রক্রিয়া। মোগল আমলে প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা ও অন্যান্য পাওনাদি তৎকালীন জমিদারদের নিকট পরিশোধ করতেন এবং পয়লা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টি মুখ করানোর পাশাপাশি আনন্দ উৎসব করতেন।
বৈশাখে বাঙালিদের বিবিধ উৎসব আয়োজনের কোন কমতি নেই, পহেলা বৈশাখের দিনে বাঙালি সমাজে বিবিধ আনন্দমুখর আয়োজনে এক অভূতপূর্ব আমেজ পরিলক্ষিত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পহেলা বৈশাখের শুরুতে হালখাতা তেমন একটা দৃষ্টিগোচর হয় না। শহরের প্রায় দোকানপাট গুলো মনোরম সাজে সজ্জিত করা হয়। কালের পরিক্রমায় ডিজিটাল যুগের আবির্ভাবে এখন সকল ব্যবসায়ীদের হিসাবনিকাশ চুড়ান্তকরণে হালখাতার প্রথা অনেকটা বিলুপ্তির পথে, অনেক লেনদেন আজকাল ডিজিটাল ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড আর ডেবিট কার্ড এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে হালখাতা প্রথা তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বে অতীতের হস্তসাধিত প্রথার বিশেষ সৌন্দর্য ক্রমশ মলিন হয়ে পড়ে। আগেকার সময়ের পুরোনো ব্যাবসায়ীদের থেকে হালখাতা প্রথা বিষয়ে বেশ তথ্য পাওয়া যায়, তাদের মতে, হালখাতা উৎসব ছিলো বিবিধ আনন্দভরা প্রাণবন্ত আয়োজন। বর্তমান সময়ে ব্যবসায়ীরা প্রায় সবাই ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে লেনদেন সম্পন্ন করে থাকে। নগদ বিক্রি অথবা বাকিতে লেনদেন সবই ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে সম্পন্ন করা হয়। তাই ক্রমশ পহেলা বৈশাখে হালখাতা উৎসবে সেই আগেকার আমেজ আর প্রতীয়মান হয় না। অতএব আবারো সকলের মাঝে ফিরে আসুক হালখাতা উৎসব আরো নতুন আঙ্গিকে এবং নতুন বৈশাখী চেতনায়। হালখাতা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে। চৈত্রের মধ্যভাগ থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় বকেয়া আদায়ের, এটা চলে নববর্ষ পর্যন্ত।
লেখক : প্রাবন্ধিক