চুক্তিবদ্ধ ও বাধ্যতামূলক শ্রম এবং নারী

ড. আনোয়ারা আলম »

‘দক্ষিণ ভারতের এক বিরাট অঞ্চলে এখনো আছেন দেব দাসীরা – হাজার হাজার বছরের পুরনো এ প্রথায় এখনো মন্দিরে দেবদাসীরা নাচেন- এরকম এক দেবদাসী ইমলা – বিবিসির এক সংবাদদাতাকে জানান- যৌবনে কোন বয়স্ক লোকের প্রতি সতীত্ব বিসর্জন দেওয়ার পরে তাদের দেবীর সেবায় উৎসর্গ করতে হয় নিজেকে— যা একধরনের পতিতা বৃত্তি -, গ্রামবাসীর কাছে তাদের পরিচয় ‘পবিত্র পতিতা’ এবং যৌনকর্মেই নিজেদের সম্পৃক্ত রাখলেও উপার্জন চলে যায় বাবা ও মায়ের কাছে, দালাল হিসেবেও থাকেন একজন অভিভাবক —কর্ণাটকে ভাগলকোট এলাকার একটি শহরে বিবিসির প্রতিবেদককে ২০ বছরের শোভা জানান -’ মাত্র তের বছর বয়সে বাবা মা তাকে বিয়ের সাজে সাজিয়ে, নিলামে সর্ব্বোচ্চ দরদাতার কাছে তার সতীত্ব বিসর্জন দিতে বাধ্য করেন। এর কারণ দারিদ্র্য, যা তাদের এ কাজে বাধ্য করেছে। শোভার মায়ের মতে মেয়ের কারণে তাদের জীবনে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এসেছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকার এ প্রথা বন্ধে নানা উদ্যোগ নিলেও এ প্রথা এখনো টিকে আছে।যারা এ পেশায় আসেন তারা কোনভাবেই মুক্তি পান না।’
নেপালের পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার বালিকা চুক্তির ভিত্তিতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করে। ‘কামলারি’ নামে পরিচিত এই মেয়েদের পেশা অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের সমান। তাদের পরিশ্রমের টাকা চলে যায় বাবা মায়ের হাতে, সবচাইতে বেদনার হলো এই মেয়েদের ওপর ধর্ষণসহ অনেক যৌননিপীড়নের অভিযোগ আছে।’
বাংলাদেশের চা বাগানে শ্রম দেন অনেক নারী শ্রমিক। একটা সময়ে নির্দিষ্ট চুক্তিতে কাজ করতেন। এখন অনেকটা স্বাধীন হলেও মজুরি পান অতি সামান্য। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ব্রিটিশ আমলে বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ বা মাদ্রাজ অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা এখানে কাজ করতে আসতেন। এখনো চা বাগানের অর্ধেকের ও বেশি শ্রমিক নারী। শতকরা ৯৫ ভাগ নি¤œবর্গের হিন্দু। যাদের স্বল্প মজুরির সাথে সামাজিক মর্যাদাও নাই। একজন নারী শ্রমিক রূপালি বলেন-’ আমরা জনবিচ্ছিন্ন চা বাগানের শ্রমিক পল্লীতে বসবাস করি- তাই বাইরে গিয়ে কাজ করতে সাহস পাই না।’ অথচ মানবেতর জীবন ঝুঁকির মধ্যে বসবাসকারী এসব নারী শ্রমিকের শ্রমেই সচল রয়েছে চা বাগান গুলো।
গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন শ্রমক্ষেত্র যেমন খেত,খামার,জলমহাল,রাস্তা ও বাড়িঘর নির্মাণে নিয়োজিত নারী ও শিশুরা নিয়োগদাতার সাথে মৌখিক চুক্তিতে (যার নব্বই ভাগ মালিকদের ওপর নির্ভরশীল) শ্রম দেয়। বেকারত্বের কারণে এ ধরনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের একদিকে যেমন মজুরি কম- অন্যদিকে কাজের সময়সীমা ও নির্দিষ্ট নয়।
নারী শ্রম দেয়- বলা যায় দুর্গাদেবীর মতো। কৃষি প্রধান প্রাচীন বাংলায় নারী গৃহস্থালি কাজের বাইরে চাষাবাদের মতো কঠিন শ্রমে অংশ নিতেন। আনুমানিক একাদশ দ্বাদশ শতকের মেয়েরা সূতো কেটে তুলো ধূনে খুব মিহি কাপড় তৈরি করতে পারতেন। চর্যাপদের মেয়েদের নৌকা চালানো, মদ বানানো থেকে শুরু করে হাতি পোষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের মজুরি তো নয়ই স্বীকৃতি ও দেওয়া হতো না। এরপরে ও নারী শ্রম দিচ্ছে নানাভাবে ঘরে ও বাইরে। এরপরে ও এই একুশ শতকেও নারীশ্রমকে যখন বাধ্যতামূলক বা চুক্তিভিত্তিক হিসেবে অমানবিক ভাবে ব্যবহার করা হয় তখন হাজারো প্রশ্ন মনের ভেতরে।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগে তবে বিশ্বের বিশেষত এশিয়া বা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাধ্যতামূলক বা চুক্তিবদ্ধ শ্রমের শেকলে বাঁধা পড়ছে অনেক নারী।মানবাধিকার কর্মীদের মতে -‘এ পেশা হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের সমান। যাদের অভিভাবকই গৃহপ্রভু বা ভূ-স্বামীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের মেয়ে শিশুকে কাজে পাঠায়’। এ প্রথা বিশেষত পাকিস্তান ভারত ও নেপালে বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। যেমন জেমস টেইলরের মতে (১৮৪৯)সালে -উনিশ শতকের প্রথম ভাগেই ঢাকা শহরে দুইধরনের কাজের লোক ছিল। স্থায়ী দাস ও পারিশ্রমিক ভিত্তিক কাজের লোক।হিন্দু পরিবারে নারী ভৃত্যের পরিচয় ছিল দাসী আর মুসলিম পরিবারে বাঁদী। এছাড়া ধর্মের নামে সেবাদাসী যা পতিতাবৃত্তির ই নামান্তর। বর্তমানে পতিতা বৃত্তি পেশা হিসেবে স্বীকৃত। এটিও বাধ্যতামূলক শ্রম বা চুক্তি শ্রম।
সভ্যতার শুরু থেকেই পতিতাবৃত্তি প্রচলিত ছিল। পতুর্গীজ পর্যটক ডোমিন্গোপিয়াস এর বর্ণনায় যে সেবাদাসীর কথা বলা আছে তা নামান্তরে পতিতা। দক্ষিণ ভারতে পাথরে খোদিত লেখায় বর্ণিত হয়েছে -। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে তাঞ্জোরের রাজস্থানে, কোলাকিং এর মন্দিরে প্রায় ৪০০ জন সেবাদাসী নিযুক্ত ছিল। ভারত উপমহাদেশে বিদেশি বণিকদের চাহিদা পূরণের জন্য পতিতা বৃত্তির প্রসার ঘটে। অবশ্যই এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল চরম দারিদ্র্য। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ও পতিতা বৃত্তি তে চলে আসতে বাধ্য হয় অনেক নারী। মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ বা যুদ্ধের কারণে ও আমরা জেনেছি কতো কতো নারী পতিতা বৃত্তি কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
কোম্পানি আমলে ঢাকা এ গ্রন্থে জেমস টেলর উল্লেখ করেছেন -‘অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকা শহরে পতিতা বৃত্তি ছিল অসংগঠিত আকারে। বিশ শতকে কোলকাতার সোনাগাছি এবং ঢাকার অদূরে নারায়নগঞ্জের টানবাজার পতিতালয় বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল সারা বাংলায়।
১৯৪০ দশকে কলকাতা, রংপুর ও চট্টগ্রামের ব্রিটিশ সেনাশিবিরগুলোতে অনেক নারী পেটের দায়ে এ পেশায় জড়িত হন।
পতিতা বৃত্তির উদ্দেশ্যে মানব পাচার যতটা বৃদ্ধি পায় শ্রমের উদ্দেশ্য বিশেষত নারী অভিভাসন ততটা পায়না। হিউম্যান রাইটস এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে -’যদিও অভিবাসনের কিছু ইতিবাচক দিক আছে কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে -‘অভিবাসী নারী গৃহ শ্রমিকদের সাথে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের অমানবিক আচরণসহ ধর্ষণের ঘটনা ও ঘটছে।’
ফিলিপাইনের এক নারীর ভাষায়-’ এক সৌদি তাকে ১০ হাজার রিয়াল দিয়ে কিনেছে এবং পরবর্তীতে গৃহকর্মের পরিবর্তে সে এখন রক্ষিতা। চুক্তিবদ্ধ শ্রম ও বাধ্যতামূলক শ্রম -দাস প্রথারই অন্যরূপ। যার মূখ্য কারণ দারিদ্র্য এবং বেদনার সাথে বলতে হয় এ বোঝা বহন করতে হয় নারীকেই। আর একটি বিশেষ কারণ জেন্ডার অসমতা। পুরো তৃতীয় বিশ্বে নারীর দারিদ্র্যসহ নানা ধরনের প্রতিকূল অবস্থার দায়ভার বহন করতে হয় নারীকেই। যে কারণে ব্যবহৃত হয় তার শ্রম ও শরীর।
নারীর এই শ্রম দাসত্ব থেকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রয়োজন দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, নারীর প্রতি অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন, নারী পুরুষ সম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তন এবং সমাজের সঙ্গে নারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন বিধান প্রবর্তনের সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি। চুক্তিভিত্তিক শ্রম বা বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার নারীর জন্য প্রয়োজন আইনগত সহায়তা ও প্রয়োজনে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে তাদের জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা। একই সাথে প্রয়োজন নারী আন্দোলনের আদর্শিক ভিত্তি প্রবর্তন ও প্রচার যাতে নারী ও পুরুষের সমতা অর্জনের মাধ্যমে নারী শ্রম শোষণ বন্ধ হয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট