রেকর্ড বৃষ্টিতে ‘অচল’ চট্টগ্রাম

অনেক স্থানে ছিল না বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ
নিচতলার বাসা পানিতে তলিয়ে গেছে
দুই স্লুইসগেইট কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ
আরও দুদিন থাকবে এমন বর্ষণ
রেয়াজউদ্দিন বাজারে সাড়ে তিনশো ব্যবসায়ীর মালামাল নষ্ট

রাজিব শর্মা »

রেকর্ড বৃষ্টিতে ‘অচল’ হয়ে পড়েছে বন্দরনগরী।’ চট্টগ্রামে শেষ ২৪ ঘণ্টায় ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি মৌসুমে পরিমাণে সর্বোচ্চ। অতি ভারি বর্ষণে নগরীর অধিকাংশ এলাকা দিনভর ছিল জলমগ্ন। আগামী দুদিন এমন বৃষ্টি চলতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
টানা তিনদিনের বৃষ্টিতে প্লাবিত নগরীর নিচু এলাকা। নিচতলার অধিকাংশ বাসা-বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমি ধসের শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্ক বার্তায়।

গতকাল রোববার সকালে জলাবদ্ধতার কারণে নগরীর প্রায় সড়কে বন্ধ ছিল গাড়ি চলাচল। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারের অন্তত সাড়ে তিনশো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর পানিবন্দি হয়ে পড়ে কয়েক হাজার পরিবার। এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)র প্রকল্প স্লুইস গেট ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এর দায়িত্বে গাফিলতিকে দুষছেন নগরবাসী ও ব্যবসায়ীরা।
গতকাল রোববার নগরীতে বিভিন্নস্থানে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমর সমান পানি দেখা যায়।
খাতুনগঞ্জ ও রেয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীর পানি কর্ণফুলী মোহনায় প্রবেশ করে সাধারণত চাক্তাই ও রাজাখালি খাল দিয়ে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ওই দুটি খালের মুখে স্লুইস গেট করা হলেও সেগুলো কোন কাজে আসছে না। এমনকি জোয়ারভাটা চলাকালীন পানি গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ ও নগরীর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়া পানি নিষ্কাশন ও নিরসনে স্লুইস গেইট দুটির কর্মকর্তাদের দায়িত্বে রয়েছে যথেষ্ট অবহেলা। এজন্য বৃষ্টির পানি জমে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
অর্ধশতাধিক এলাকা পানিবন্দি

সরেজমিনে দেখা যায়, রেয়াজউদ্দিন বাজারের বিভিন্ন মার্কেট, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, হালিশহর, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, চকবাজারের ডিসি সড়ক, বাকলিয়ার বউবাজার, রাহাত্তর পুল, কালামিয়া বাজার, মিয়াখান নগর, মাস্টারপোল, সিরাজুদৌল্লাহ সড়ক, দুই নম্বর গেট, ষোলশহর, বহদ্দারহাট, হালিশহর, কমার্স কলেজ সংলগ্ন এলাকা, ছোট পুল, বড় পুলসহ নগরীর অর্ধশতাধিক নিচু এলাকা তলিয়ে যায়। এতে অনেক এলাকায় পানি নেমে না যাওয়ায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ড্রেনের পানি অনেক উঁচু স্থানের সড়কেও উঠতে দেখা গেছে।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ
সরেজমিনে দেখা যায়, বৃষ্টির কারণে জামালখানে ট্রান্সফরমার নষ্ট হওয়ায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ওইস্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। তাছাড়া আন্দরকিল্লা, পাথরঘাটা টেরিবাজার, বকসিরহাট, চকবাজার, বহদ্দারহাট ও আগ্রাবাদের গোসাইলডাঙ্গাসহ অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ ছিল না। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী।

নগরীর বাকলিয়ার ডিসি রোডের বাসিন্দা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, গত চার দিন ধরে বৃষ্টিপাতের সাথে জোয়ার চলাকালীন পানি উঠছে। এতে কলোনির নিচের বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। তাছাড়া সৈয়দ শাহ রোডের বেশিরভাগ ভবনের নিচতলা ডুবেছে। তবে স্লুইস গেট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। কারণ তারা জোয়ার ও ভাটায় পানি চলাচল যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে না। ফলে জমে থাকা পানি নামছে না।
বাকলিয়ার ব্যবসায়ী হামিদুল হক বলেন, ‘ডিসি রোড, শান্তিনগর, রসুলবাগ, বগাবিল, সৈয়দশাহ রোডে চারদিন ধরে পানিবন্দি ছিল হাজারো মানুষ। এবার জলাবদ্ধতা কম হবে আশা করলেও তা থেকে রক্ষা পায়নি নগরবাসী। গত ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে জলাবদ্ধতার কোন পরিবর্তন দেখছি না।’

রেয়াজউদ্দিন বাজারের আড়তদার ব্যবসায়ী মো. শফিউদ্দিন বলেন, ‘গত তিন দিন ধরে জোয়ার চলাকালীন বৃষ্টিপাতে রেয়াজউদ্দিন বাজার, তিনপুলের মাথায় পানি উঠলেও রোববার সকালে বেশি জলাবদ্ধতার শিকার হয় ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘক্ষণ পানির স্থিতি থাকায় মুদির দোকান, মোবাইলের দোকান, কাপড়ের দোকান, ঘড়ির দোকানসহ অন্তত সাড়ে তিনশো ব্যবসায়ীর মালামাল নষ্ট হয়েছে।’

কাপাসগোলা এলাকার ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রতিবছর চকবাজার এলাকায় পানি হয়। কিন্তু পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকার ফলে মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে। চকবাজার খাল দিয়ে রাজাখালি হয়ে যে স্লুইস গেইট হয়েছে তা পরিচালনার দায়িত্বে অবহেলাও রয়েছে। তাছাড়া নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নালা সংস্কারে কিছু কাজ করলেও প্রায় স্থানের অবস্থা এখনো আগের মতো রয়েছে। দীর্ঘদিনের নালা সংস্কার না হওয়াতে পানি চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নগরীর পানি যায় চাক্তাই খালের উপর দিয়ে। ওই খালেই যদি সমস্যা থাকে জলাবদ্ধতা নিরসন কিভাবে হবে? জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কর্তৃপক্ষ চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখে যে দুটি স্লুইস গেট দিয়েছে তা প্রশস্ততায় অনেক ছোট। ফলে একসাথে নগরের এত পানি নামা অনেকটা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। স্লুইস গেট গুলো তদারকিতেও রয়েছে অবহেলা।
তিনি আরও বলেন, খাতুনগঞ্জে গত তিনদিন পানি উঠেছে স্লুইস গেট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য। এমনিতে নগরীর অনেক স্থানে খাল সংস্কার না হওয়ার ফলে পানি আটকে আছে। তার মধ্যে স্লুইস গেট বন্ধ রাখার কারণে বেড়েছে জলাবদ্ধতার সমস্যা।

নগরবাসীর অভিযোগের কারণে গতকাল রোববার বিকাল সাড়ে তিনটায় বাকলিয়ার রাজাখালী ও চাক্তাই খালের মোহনায় স্লুইস গেট দুটিতে সরেজমিনে দেখা যায়, রাজাখালী স্লুইস গেইটে কর্মরত একজন দারোয়ান ও কর্মী বসে থাকলেও অন্য চাক্তাই স্লুইস গেইটে কোন কর্মকর্তাদের দেখা যায়নি। তাছাড়া ওইসময় কর্ণফুলীর মোহনার পানি চাক্তাই ও রাজখালী খাল দিয়ে নগরে প্রবেশ করতে দেখা যায়।
স্লুইস গেইটের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজাখালি স্লুইস গেইটে কর্মরত কর্মী রতন শেখ বলেন, ‘আমি এই স্লুইস গেইটে কাজ করি। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার যখন স্লুইস গেট খুলতে বলে আমরা তখন খুলে দিই।’

নগরবাসী ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়ে অস্বীকার করে স্লুইস গেইটের দায়িত্বরত ইঞ্জিনিয়ার মো. সোহান বলেন, ‘আমরা সঠিক সময়ে স্লুইস গেট বন্ধ করছি ও খুলছি। যারা অভিযোগ করছে তারা মিথ্যে অভিযোগ করছে। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে স্লুইস গেইটের কর্মকর্তারা কাজ করে যাচ্ছেন।’
নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টি নিয়ে কাজ চলছে প্রকল্পগুলোয়। বাকি ২১টি খাল নিয়ে কোনো পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো। ২১টি খালের বেশির ভাগই দখলে আছে। তবে প্রকল্পে ৩৬টি খালের পানি নিষ্কাশন নিয়ে কাজ হলেও ২১টি খালের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

এ বিষয়ে জানতে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চাক্তাই ও রাজাখালি স্লুইস গেট আমার প্রকল্পের অধীনে না। এসব সিডিএর অন্য একটি প্রকল্পের। চাক্তাই খালের রিটের্নিংয়ের দায়িত্ব আমার, কিন্তু রেগুলেটরের দায়িত্ব সিডিএর। তাই চাক্তাই খালের যতটুকু খনন করার সুযোগ হয়েছে আমরা ততটুকু করেছি। তবে অনেক স্থানে আমরা কাজ করতে পারিনি, এর কারণ ওইসব এলাকায় এক্সক্লেভেটর ঢুকার কোন রাস্তা নেই। রাস্তা তৈরি করতে হলে আশেপাশের ভবন ভাঙতে হবে।