চিকিৎসকের দেখা মেলে না, কর্মঘণ্টায়ও ফাঁকি

আরবান ডিসপেনসারি

নিলা চাকমা »

দুপুর ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট। সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রৌফাবাদ আরবান ডিসপেনসারিতে এসেছেন মরিয়ম বেগম। তখন কোনো চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট ছিলেন না। জানা গেল, ফার্মাসিস্ট ১০ দিনেরও বেশি ছুটিতে রয়েছেন। তাই সেখানে থাকা একমাত্র অফিস সহায়কই চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করছেন! এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ রয়েছে, এই ফার্মাসিস্ট এবং অফিস সহায়ক মিলে রোগীর কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে ওষুধ সরবরাহ করে থাকেন। এভাবেই চলছে চট্টগ্রাম নগরের ৯টি সরকারি ডিসপেনসারি।

এখানকার চিকিৎসক ও অন্য কর্মচারীদের কর্মঘণ্টা সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। কিন্ত এসব ডিসপেনসারিতে দুপুর সাড়ে ১২টার পর কোনো চিকিৎসক বা অফিস সহায়কই থাকেন না। তারা দুঘণ্টা পর সকাল ১০টায় এসে আবার বেশ কিছুক্ষণ রয়ে-সয়ে তারপর রোগী দেখেন। ফলে রোগীরা প্রতিনিয়ত চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন।

রোগী মরিয়ম বেগম বলেন, ‘বাসার কাজ সামলাতে দেরি হয়ে যায়। তাই সকালের দিকে আসতে পারি না। অথচ আজ এসেও কোনো চিকিৎসক পেলাম না। শুধু তাই নয়, এখানে সুযোগ পেলেই টাকা নেন ফার্মাসিস্ট-কর্মচারীরা। আমার মেয়ের কাছ থেকে অনেকবার তারা টাকা নিয়েছেন ওরা।’

জানা গেছে, চট্টগ্রামে নগরে সরকারিভাবে আরবান ডিসপেনসারি রয়েছে ৯টি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)-এর আওতায় রয়েছে ২১টি। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবকটিতেই তিনজন মেডিক্যাল অফিসার, একজন করে ফার্মাসিস্ট এবং অফিস সহায়কের পদ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শুধু আউটডোর চিকিৎসা দেওয়া হয়। যার আওতায় রয়েছে জ্বর-কাশি, প্রেশার, ডায়রিয়া এবং চর্মরোগ। জটিল কোনো রোগী পাওয়া গেলে চমেক হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখান থেকে ডেঙ্গুর স্যালাইন, ট্যাবলেট, সিরাপ, ক্যাপসুলসহ ১৫ থেকে ২০ পদের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়ার কথা।

গত ২৯ আগস্ট সরেজমিনে গিয়ে পাঁচলাইশ আরবান ডিসপেনসারিতে ১২টার পর ইনচার্জসহ ২ চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। শুধু একজন চিকিৎসক ছিলেন। আবার ১২টার পর এখানে সেবা দেওয়া হয় না বলে রোগীদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। পরদিন আসতে বলা হয়। ওই দিন ১২টার সময় রাহাত্তাপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসেন মো. আনোয়ার হোসেন। হাতে ব্যথা নিয়ে আসা এ রোগীকে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আমাকে আগামীকাল আসতে বলা হয়। কিন্ত আমার রোগকে কি পরের দিনের জন্যে অপেক্ষায় রাখতে পারবো ? আমরা গরিব, তাই বেসরকারিতে দেখাতে পারি না। তার জন্য এখানে আসা। কিন্ত এসেও লাভ হলো না। চিকিৎসক দেখাতে পারলাম না।ওষুধও পেলাম না।

গতকাল ১৯ সেপ্টেম্বর হালিশহর আরবান ডিসপেনসারিতে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে দেখা যায়, ৩ জন মেডিক্যাল অফিসার থাকার নিয়ম থাকলেও আছেন শুধু ডা. নাহিদা হাসান নামে একজন। রোগীর দীর্ঘ লাইন। তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রায় আধঘণ্টা কথা বলা শেষ হলে রোগী দেখা শুরু করেন। অন্য ডিসপেনসারিতে বিনামূল্য সেবা দেয়া হলেও সেখানে প্রতি রোগী থেকে ৫ টাকা করে নেওয়া হচ্ছিল।

গত ১-১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগ্রাবাদ আরবান ডিসডেপনসারি, ফিরোজ শাহ কলোনি আরবান ডিসপেনসারি, কর্নেল হাট ডিসপেনসারি সরেজমিনে দেখা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত অফিস করেন না কেউই। সকাল ৮টার দিকেও আসেন না। যার কারণে রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না ঠিক মতো। বিশেষ করে গৃহিণীরা এ সেবা থেকে বঞ্চিত থাকছেন। তাদের দাবি, ঘরের সব কাজ সামলে সেবা নিতে আসতে হয়। কিন্তু তারা আসতে-আসতে রোগী দেখা বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘১টার দিকে রোগী আসা কমে যায়। মাঝেমধ্যে তো একজনও আসে না। সেজন্য আমরা চলে যাই’। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

তবে ভিন্নচিত্র দেখা গেল শেরশাহ আরবান ডিসপেনসারিতে। গতকাল (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকেও রোগী দেখছিলেন চিকিৎসকেরা। তবে ৩ জনের মধ্যে ১ জন চিকিৎসককে দেখা যায়নি। ওষুধ নিতে কোনো টাকা দিতে হচ্ছে না রোগীদের।

প্রতিষ্ঠানটির ইনচার্জ ডা. নাসরিন সুলতানা বলেন, সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত রোগী দেখার নির্দেশ রয়েছে আমাদের। এখানে কোনো টাকা নেয়া হয় না। বিনামূল্যে সব সেবা ও ওষুধ দেয়া হয়। আমাদের সকল প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর স্যালাইনও আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ।

এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানে সমস্যা রয়েছে, সেখানে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত কর্মঘণ্টা রয়েছে। তবে চিকৎসকদের জন্য সকাল ৯টা থেকে আউটডোর খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে। কারণ তারা সকলে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন। কারোর জন্যই সরকারি অ্যাপার্টমেন্ট নেই। তাই কর্মঘণ্টায় এর প্রভাব পড়ছে।’