চণ্ডালপুত্র

দীপক বড়ুয়া »

লোকে কত কথা বলে। পৃথিবীটা চ্যাপটা। কেউ বলে কমলালেবুর মতো গোল। যে যাই বলুক, পৃথিবী পৃথিবীর মতোই।  ঠিক হীরালালও তার মতোই, এইরূপে দ্বিতীয়জন  নেই। সে চ-ালপুত্র। জাতের একেবারই নিচু ওরা। সমাজে তাদের দৃষ্টিনন্দিতভাবে কেউ দেখে না।

পৃথিথবীতে সাড়ে সাত শ কোটি মানুষ। দুজন  একই রকম হয় না। সবাই ভিন্ন। তবে যমজ সন্তানের মধ্যে অনেক কিছু মিল থাকে। চেহারা, হাত, পায়ে। কন্ঠে হয়তো মিল থাকে না, ভিন্ন হয়।

নয়নপুরের  মানুষ  হীরালাল। ওরা যমজ দুই ভাই। দশ  মিনিট  আগে পিছে ওদের জন্ম। অন্যজন ধীরলাল। ওরা  দেখতে একই। গায়ের রঙ ফর্সা, উজ্জ্বল। কেউ লেখাপড়া  শেখেনি। উত্তরাধিকার সূত্রে ওদের কাজ শ্মশানে মরা মানুষ পোড়ানো। এটা ওদের বাপদাদার কাজ।

মানুষ পোড়ানোর কাঠ, টায়ার, কেরোসিন যা যা লাগে সব স্বজনের। ওদের নির্দিষ্ট পাঁচ শ টাকা দিতে হয়। দুই ভাই লাশ পোড়া শেষ হলে বাড়ি ফিরে।

একদিন ওদের মা হীরালালের বিয়ে দেয়। মা’র এক কথা। বাড়ি ফাঁকা, একা একা ভালো লাগে না। বউ পেয়ে মায়ের  সে কি আনন্দ।

সারাদিন বউ নিয়ে ঘরের কাজ, গল্প, আনন্দ সবই করে। চার বছর না যেতে বউমার ওপর চরম  রাগ শাশুড়ির। আগের মতো ভালোবাসে না। কড়া কথা শোনায়

কী হলো বউমা? আর কতদিন! নাতির শখ নেই আমার? একা ভালো লাগে না, বলে দিলাম।

তখনও হীরালাল, ধীরলাল বাড়ি ফেরেনি। আজ দুজন মানুষ মারা গেছে। পরপর পোড়াতে হবে। অনেক রাতে দুভাই  আসে। ওদের চোখেমুখে  হাসি। মাকে হীরালাল  বলে,

মা, আজ ভালো আয় হলো। লাশ পোড়াবার জন্য বাড়তি টাকা দিয়েছে।

ঠিক আছে বাবা। শোন, আমার আর একা থাকতে ভালো লাগে না। আমার নাতি চাই। নাতির সাথে খেলতে চাই, বলে দিলাম। ততক্ষণে প্রিয়বালা দুভাইকে খেতে দেয়।

শাশুড়ির কথা প্রিয়বালার কানে বাজে। দুঃখ পায়। রান্নাঘরের কাজ শেষে প্রিয়বালা শোবার ঘরে আসে। হীরালাল বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলে

প্রিয়বালা এলে?

বউ তো অবাক, যাতে স্বামীর ঘুম না ভাঙে, ধীরে শব্দ ছাড়া ঘরে ঢোকে। তারপরও কীভাবে বুঝলো, আমি এলাম! প্রিয়বালা নরম গলায় বলে, হ্যাঁ গো, এতো আস্তে ঘরে ঢুকলাম, তাও টের পেলে কীভাবে?

অভ্যাস, তোমার গায়ের গন্ধ।

ওমা, সে কি  কথা!

আজ চার বছরেরও বেশি হলো আমার ঘরে এসেছ। দীর্ঘদিন কাছাকাছি থাকি। গায়ের গন্ধ বুঝবো না?

যা, কি যে বলো!

সত্যি কি জানো, তোমার গায়ের গন্ধটা মিষ্টি। আমার ভীষণ পছন্দ।

প্রিয়বালা মাথায় চিরুনি চালাতে-চালাতে বলে

ছাড়ো ওসব কথা। মা নাতি চায়। আমার ওপর প্রচ- রেগে আছে। কী করি।

সব তো ভগবানের ইচ্ছে। মা সেটা বোঝে না?

চলো ডাক্তার দেখাই।

ঠিক আছে, তাই হবে।

ওরা ডাক্তার দেখায়। কিছুদিন পর ধীরলালকেও মা বিয়ে দেয়। এখন সব আদর-মমতা ছোটবউ  নয়নতারার কাছে। বড় বউমার খবর রাখে না। এটা কি সংসারের নিয়ম! কী জানি? দিন যায়। কারো ঘরে সন্তান আসে না। মায়ের রাগ দুই পুত্রবধূর ওপর। বাড়িতে অশান্তি, হইচই। বড়ো গলায়  মা  বলে, একে তো আমরা নিচুজাতের। কেউ সম্পর্ক রাখে না। আমাদের কাজ লাশ পোড়ানো। ছি ছি কোন্ এ জাতে আমাদের জন্ম হলো! লোকে বলে, আমরা  চ-াল। সমাজের নিগৃহীত জাত। আচ্ছা বাপু, আমরা না হলে মানুষ কে পোড়াতো, একটু ভেবেছো কোনওদিন! ঘরে পচতো। নাতি-নাতনি নিয়ে সুখ পেতে চাই, তাও কপালে নেই। হায় ভগবান, কী অভাগ্য কপাল নিয়ে জন্ম আমার!

সকাল-সকাল মা দুই ছেলেকে  ডাকে।

দুভাই মাকে ভয় পায়। শ্রদ্ধা  করে। মায়ের মুখের ওপর কথা বলার সাহস পায় না। এই শিক্ষা তাদের বাপের দেয়া। বাবা বলতো

দেখ খোকারা, আমরা সমাজের খুবই নিচু জাত। আহামরি কিছুই  নেই। আমরা আমাদের নিয়ে। আমাদের সমাজ ছোট। তোদের পড়াতে পারিনি। কারণ আমাদের ইশকুলে যেতে নেই। তা অবশ্য এখন নেই। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। তোদের ছেলেমেয়েদের ইশকুলে পড়াবি। লেখাপড়া ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। আরেকটা কথা মনে রাখবি। মায়ের ওপর পৃথিবীতে দ্বিতীয় কিছুই নেই। আমি আজ আছি , কাল  থাকবো না। মাকে কোনদিনও অশ্রদ্ধা করবি না। মায়ের  মুখের পের কথা বলবি না।

তখন থেকে মায়ের ওপর শ্রদ্ধাশীল ওরা।

মা বলে

হীরা, তোকে আবার বিয়ে দিতে চাই। হীরা কিছু বলে না।

তখন খবর আসে মানুষ মরার। পরপর তিনজন মরার খবর আসে। এ রকম মাঝেমাঝে হয়। সপ্তায় সাতজনও মারা যায়। একটা প্রবাদ আছে,  এই শ্মশানে মানুষ মারা গেলে একজনও যায়। তিনজনও যায়, সাতজনও যায়।

এটা হয়তো ওদের বিশ্বাস, না হয় অন্ধ ধারণা। মানুষ বয়স, অসুখেই মারা যায়। এখানে শ্মশানের দোষ কী?

মায়ের সাথে আর কথা হয় না। দুভাই  লাশপোড়ার বিষয় নিয়ে আলাপের জন্য মানুষের বাড়ি চলে যায়।

দুভাইয়ের আজ বাড়ি ফিরতে মাঝরাত হয়। তিনটি লাশের দাহ। কম নয়।

রাতের বিছানায় প্রিয়বালা কাঁদে। হীরালাল মুখ-হাত ধুয়ে শুতে আসে। তখনও প্রিয়বালা কাঁদছে। হীরা প্রিয়বালার মাথায় হাত রেখে বলে, কী হয়েছে, তুমি কাঁদছো কেন?

স্বামীর চোখের ওপর চোখ রেখে প্রিয়বালা বলে

তোমার মা তোমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছে। তাড়াতাড়ি নতুন বউ আসবে ঘরে।

কী বলছো, মা কি তাই বলেছে?

আচ্ছা তুমিই বলো, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী রেখে সিঁথিতে সিঁদুর পরে সামাজিকতায় তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়। এই বিয়ে এতই ঠুনকো, সহজে ভেঙে যাবে?

বিয়ে ভাঙার কথা কে বললো? হীরালাল উত্তর দেয়।

মা, তোমার জন্য দ্বিতীয় বউ আনবে, আমার দোষটা কোথায়, বলো! আমি কোথায় যাবো এখন? ডাক্তার দেখালে, ডাক্তার আমার দোষ দেখেনি, তোমার দোষ দেখেনি। তাহলে আমার শাস্তি হবে কেন?

হীরালাল নির্বাক। কথা বেরোয় না মুখে।

ঐদিকেও তাই।

ধীরলালের বউ নরম নয়, কঠিন। নয়নতারা উঁচুগলায় বলেÑ

আবার বিয়ে করবে?

ধীরলাল বউয়ের থেকে দূরে দাঁড়ায়। কথার উত্তর দেয় না। বউকে ভয় পায় ধীরলাল। বউ বলেÑ

বিয়ে করবে আবার?

তুমি বললে করবো। ধীরলাল উত্তর দেয়।

নয়নতারা আগুরের মতো জ্বলে ওঠে। চেঁচিয়ে বলে,

কী বললে, আমি বললে বিয়ে করবে! এক্কেবারে চুপ। এত্তো সাহসী হলে কখন? লাশ পোড়াতে-পোড়াতে পেয়েছো?

হইচইয়ে ছুটে আসে শাশুড়ি। ধীরলাল, নয়নতারা ভয়ে কাঁপে।

দরজা খোলা ছিল। শাশুড়িকে দেখে নয়নতারা চুপ। ধীরলাল চুপ। কারো মুখে কোনও কথা নেই। হীরালাল, প্রিয়বালা আসে। শাশুড়ি  উঁচুগলায় বলে

সবাইকে বলছি, শোনো, আমার নাতি চাই। বংশধর চাই। বাজে কথা শুনতে চাই না। এতো রাতে ঘরে উঁচুগলায় কথা বলতে লজ্জা হয় না ছোট বউমা। দোষ করবে। গলা উঁচু থাকবে, সেটা হবে না। আমাকে নাতি দাও। ব্যস আর কিচ্ছু চাই না। হীরালাল, তোর নতুন বউ ঠিক করেছি। ক’দিনের মধ্যে নিয়ে আসবো।

ওইটুকু বলে শাশুড়ি নিজের ঘরে চলে যায়।

ঠিকঠিকই হীরার নতুন বউ আসে ঘরে।

সুন্দরী নয়। মোটামুটি। কোনো মা-বাবা চায় না এক বউ থাকতে সে ঘরে তার মেয়ে বিয়ে দেবার। সুন্দরী না হোক। তাতেও  শাশুড়ি সন্তুষ্ট। তার একটি নাতি চাই। বেশি কিছু নয়।

হীরা, প্রিয়বালা, ধীরলাল, নয়নতারা কারো মুখে হাসি নেই। কেমন যেন বাড়ির মাঝখানে প্রাচীর উঠেছে। একটি ঘরে দুদল মানুষ। একদিকে শাশুড়ি, নতুন বউ। অন্যদিকে হীরা, ধীর, প্রিয়, নয়ন।

কিছুদিন যায়। বছর যায়। তারপরও হেমলতার ঘরে নাতি আসে না।

মা’র রাগ হয় না আর। মা এবার চুপ। হয়তো মা বুঝতে পারে এটাই ভাগ্য।

সত্যি সত্যি ভাগ্য প্রসন্ন হয় প্রিয়বালার। কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে ছেলে। ঘর ভরে যায় আনন্দে। নাতিকে বুকে তুলে সেকি আদর! চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় নাতির নরম গাল। শাশুড়ি প্রিয়বালাকে জড়িয়ে ধরে।

হায়রে মানুষের স্বার্থ। লাভের দিকেই শুধু ছুটে।

নয়নতারা, হেমলতা এক্কেবারে অনাথ, অসহায় এখন। হীরালাল, ধীরলাল মায়ের কা- দেখে অবাক, স্তব্ধ। নির্বাক নয়নতারা, হেমলতা। ওরা দুজন স্বপ্নচোখে দেখে, ভাবে, হয়তো ভাগ্য তাদের একদিন সুপ্রসন্ন হবেই। ওদেরও কোলে আসবে টুকটুকে সন্তান। এটাই মানুষের চরিত্র। স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বভাব। মানুষ তো মানুষই। উঁচুনিচু তো মানুষের তৈরি।