চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও কিংবদন্তি আজিজ-জহুর

মুহাম্মদ শামসুল হক »

শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত একটি নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জীবনের শুরুতে বঙ্গবন্ধু তাঁর মূল নামের অংশ ছিল না। কিন্তু বাংলার মানুষের জন্য তাঁর ধারাবাহিক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের মূল্যায়ন করে ছাত্র-জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে যে উপাধি দিয়েছিলেন আজ থেকে ৫৩ বছর আগে, জনতার ভালোবাসার সেই বঙ্গবন্ধু শব্দটিই কালক্রমে তাঁর মূল নামের জায়গা দখল করে নেয়। তাই আজ নাম হিসেবে বঙ্গবন্ধু আর শেখ মুজিবুর রহমান সমার্থক।  তবে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ডাক নামের মতো বঙ্গবন্ধু বেশি উচ্চারিত হয়। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান ওরফে খোকা। ছেলেবেলা থেকে দুরন্ত প্রকৃতির এই খোকা ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনীতির তালিম পেয়েছিলেন প্রবীণ-প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সেহরাওয়ার্দীর স্নেহময় সান্নিধ্যে এসে। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিশ্রুতিশীল মাঠকর্মী শেখ মুজিব ছাত্র-জনতার সুখ-দুঃখের নিরন্তর সহযাত্রী হয়ে পথ চলতে চলতে পাকিস্তান সৃষ্টির অল্প কিছুদিনের মধ্যে পরিণত হন দক্ষ সংগঠকে। মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকসহ সর্বস্তরের মানুষের চাওয়াকে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাজনীতির মাঠ আঁকড়ে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছেশক্তি ছিল তাঁর। ফলে তিনি সমসাময়িক এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদেরও পেছনে ফেলে বাংলার অবিসংবাদিত নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও হতে পেরেছেন জাতির পিতা।

রাজনীতি করে নেতা হতে হলে রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন হয়। আর দলকে জনভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে প্রয়োজন  দেশব্যাপী সাংগঠনিক তৎপরতা চালানো এবং নেতা-কর্মী-জনতার প্রতি ভালোবাসা ছড়ানো। সেই তৎপরতার অংশ হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য শুরু থেকে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরের অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকার বাইরে সফরে বের হন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। একজন বুদ্ধিদীপ্ত দূরদর্শী নেতাকে দলের সাংগঠনিক ভিত্তির জন্য উপযুক্ত স্থান ও সঙ্গী নির্বাচনে অগ্রাধিকার নির্বাচন করতে হয়। যুগ যুগ ধরে এই চট্টগ্রাম সংগ্রামের উর্বর ভূমি এবং সংগ্রামী মানুষদের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত। এখানকার সমসাময়িক উদ্যমী, প্রতিশ্রুতিশীল কিছু নেতা-কর্মীর সঙ্গে পরিচয়সূত্রে তাঁদের সম্পর্কেও সম্যক ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধুর। তাই শুরুতেই তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাজে ঢাকার পরে চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দিয়ে ৪৮ সালের শেষ দিকে সফরে আসেন   বিপ্লবী ভূমি চট্টগ্রামে। পরের বছরও তিনি চট্টগ্রামে আসেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজে। এর মধ্যে প্রথম দিকে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রধান রাজনৈতিক গুরু খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে-যদিও এ সফরের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ স্মরণ করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট নেতারা।

জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে-পরে (জেলখানায় বন্দী জীবনের সময় ছাড়া) ২৮-৩০ বার চট্টগ্রাম এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর রাজনীতির সূত্র ধরে এখানকার তৎকালীন অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। অনেকের বাসা-বাড়িতে যাতায়াত ও খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে পারিবারিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতি নেতা-কর্মীদের এ সম্পর্ক, আস্থা ও ভক্তি অটুট ছিল। চট্টগ্রামের প্রবীণ নেতাদের অনেকেই ছিলেন বয়সে বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক, কেউ কেউ কয়েক বছরের বড়ও। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এমন ছিল যে, ঘরোয়া বৈঠকে পরস্পর হাসি-ঠাট্টার ছলে তুই-তোকারি করে কথা বলতেন। দলের সাংগঠনিক কাজের খরচ মেটানোর লক্ষ্যে চট্টগ্রামের কয়েকজন নেতার সঙ্গে যৌথ ব্যবসার অংশীদারও হয়েছিলেন তিনি।

আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বিবেচনায়ও বাংলাদেশে ঢাকার পরই চট্টগ্রামের স্থান। বঙ্গবন্ধু সেটা জানতেন এবং বুঝতেন বলেই চট্টগ্রামের নেতা-কর্মীদের তিনি সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রচারের প্রথম জনসভা চট্টগ্রামে আয়োজন এবং একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বার্তা চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু তাঁর একাধিক বক্তৃতায় এসব কথা স্বীকারও করেছেন। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও উল্লেখ পাওয়া যায় সেই সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের কথা। বর্তমান কক্সবাজার জেলা তখন ছিল চট্টগ্রাম জেলার একটি মহকুমা। চট্টগ্রামের পাশাপাশি কক্সবাজার মহকুমায়ও সংগঠন ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী ছিলেন শেখ মুজিব।

চট্টগ্রামে আওয়ামী পরিবারের (মুসলিম ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগ) প্রথম দিককার কর্মী-সংগঠক যাঁদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু এখানে আওয়ামী রাজনীতির বীজ বপন করেছিলেন এবং ক্রমে যাঁরা তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন সেই কাণ্ডারীদের সিংহভাগই এখন আর বেঁচে নেই। ইতিমধ্যে যাঁরা মারা গেছেন এবং তাঁর স্নেহ-সাহচর্য পেয়ে  আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন এমন অনেকের সঙ্গে এ লেখকের কথা হয়েছে গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে-বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা গবেষণা ও লেখালেখির সূত্রে। ষাট ও সত্তরের দশকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকা এবং সভা-সমাবেশে যাতায়াতের সুবাদে বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখেছেন এবং তাঁর নেতৃত্ব সম্পর্কে সম্যক জানা শোনা আছে এমন অনেকের সঙ্গেও কথা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, আলাপচারিতা এবং বিভিন্ন স্মৃতিচারণামূলক লেখার তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, চল্লিশের দশকের প্রথম দিক থেকে মুসলিম লীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ ও শ্রমিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নানা প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের তখন কিছু তরুণ নেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজ, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ফজলুল হক বিএসসি, শেখ মোজাফ্ফর আহমদ (সালারে জিলা), আমির হোসেন দোভাষ, আজিজুর রহমান, আবুল খায়ের চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, জাকেরুল হক চৌধুরী, ভূপতিভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী), আবদুর রহমান চৌধুরী, মাওলানা আবু তাহের প্রমুখ। অবশ্য ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সম্পর্ক শুরুর দিকে ছিন্ন হয়ে যায়। রাজনীতির যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরও যাঁদের পরিচয় ও সম্পর্ক হয় তাঁরা হলেন-সিরাজুল হক মিয়া, এম এ ওয়াহাব, ডা. ছৈয়দুর রহমান, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, জানে আলম দোভাষ, ওবায়দুল হক (সাংবাদিক), ডা. নুরুন্নাহার জহুর, ডা. এ এম এম জাকেরিয়া, এম সিদ্দিক মিয়া, মিয়া আবু মেহাম্মদ ফারুকী, এনজি মাহমুদ কামাল, ইসহাক মিয়া, ডা. বিএম ফয়েজ, ডা. সুলতান আহমদ, বিধান কৃষ্ণ সেন, এম ইদ্রিস বিএসসি, সুলতান আহমদ কন্ট্রাক্টর, মোহাম্মদ ইউসুফ (বুলবুল ইউসুফ), আমিনুল হক, এম এ হান্নান, মৌলানা নূরুল ইসলাম জেহাদী, শেখ মোশাররফ হোসেন, তারেক আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, সুলতান আহমদ কুসুমপুরী, হাফেজ মোহাম্মদ শরীফ, এম এ মজিদ, ইদরিস আলম, নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, শাহ বদিউল আলম, বদন দিদারী, ডা. আবু জাফর, এসএম জামাল উদ্দিন, অ্যাডভোকেট বদিউল আলম, একে এম আবদুল মান্নান, হামিদুর রহমান, আবদুল খালেক (চাচা খালেক), আহমদ নুর সওদাগর, আশরাফ খান প্রমুখ। ষাটের দশকের শুরু এবং মাঝামাঝি সময় থেকে আরও যাঁরা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে জেলা বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে     নেতৃত্বে এসেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিতি ও সাহচর্য পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, এম এ মান্নান, অধ্যাপক শায়েস্তা খান, মীর্জা আবু মনছুর, বশিরুজ্জামান চৌধুরী, আবু ছালেহ, কফিল উদ্দিন, শেখ মোজাফ্ফর (বোয়ালখালী), আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, আতাউর রহমান খান কায়সার, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আবুল কাসেম মাস্টার, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী (শহীদ) প্রমুখ। স্নেহভাজন তরুণ ছাত্র ও যুব নেতাদের মধ্যে আরও ছিলেন, এসএম ইউসুফ, শহীদ মুরিদুল আলম, নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু, আবুল কালাম আজাদ, মোকতার আহমদ, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, মৌলভি সৈয়দ আহমদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমদ, ইনামুল হক দানু, শফিউল বশর, সফর আলী, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, গোলাম রব্বান, আনোয়ারুল আজিম, মুহাম্মদ ইউনুছ, অমল মিত্র প্রমুখ। এ ছাড়াও স্বাধীনতার পূর্বাপর আরও অনেক নেতা কর্মীর সঙ্গেও তাঁর এমন সম্পর্ক তৈরি হয়ে থাকতে পারে যার বিস্তারিত তথ্য এ লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের জন্ম থেকে বিকাশের নানা পর্যায়ে অনেক নেতা-কর্মীর নেতৃত্ব ও অবদান ছিল, এখনো আছে। শুরু থেকে যাঁরা আওয়ামী মুসলিম লীগের হাল ধরে যাত্রা করেছিলেন তাঁদের অনেকে নানা কারণে শেষ পর্যন্ত দলে টিকে থাকেননি। কেউ কেউ মত ও পথ পরিবর্তন করে ভিন্ন ধারার রাজনীতিতে ঠাঁই নিয়েছেন। কিন্তু এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর রাজনীতির স্বাভাবিক যাত্রাপথে সাময়িক মান-অভিমানের ছায়া থাকলেও তাঁরা পুরো জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও সংস্পর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধ থেকে শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হলেও এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক-বন্ধুত্বের কথা ছড়িয়ে আছে কিংবদন্তির মতো। আরও নানা জন আন্দোলন-সংগ্রামসহ নানান পদে, নানান দায়িত্বে থেকে কাজ করলেও চট্টগ্রামের সার্বিক রাজনীতির চাকা আবর্তিত হয়েছে মূলত এ দুজনকে কেন্দ্র করে।

জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ আজিজের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ও বন্ধুত্ব ব্রিটিশ যুগে ১৯৪৩-১৯৪৪ সাল থেকে। এ পরিচয় হয় কলকাতায় রাজনীতির মাঠে। তাঁরা তখন (আজিজ-জহুর) ছিলেন মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরীর অনুসারী। দেশভাগের পর মুসলিম লীগে টানাপড়েন শুরু হলে ফজলুল কাদের চৌধুরী ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগে থেকে যান আর আজিজ-জহুর চলে আসেন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী (মুসলিম) লীগে। পুরো পূর্ব বাংলায় ঢাকার বাইরে প্রথম দু জেলায় আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি গঠন করা হয়। এরমধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম। এম এ আজিজের ভাই এম এ মজিদের তথ্য অনুযায়ী ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের সামনে ৩ নম্বর ওয়েলেসলি ফার্স্ট লেইনে অনুষ্ঠিত অল বেঙ্গল মুসলিম লীগের কাউন্সিলে শেখ মুজিবের সঙ্গে এম এ আজিজের প্রথম পরিচয়। ১৯৪৫ সাল থেকে শেখ মুজিব হালিশহরে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।’

এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন ‘১৯৪৩ সাল থেকে চট্টগ্রামের এই কর্মীদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আজ পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব অটুট আছে। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আজিজুর রহমান, ডা. সুলতান আহমদ, আবুল খায়ের চৌধুরী এবং আরও অনেকে ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অনেকে ছিটকে পড়েছেন। আজিজ ও জহুর আজও সক্রিয় রাজনীতি করছেন। জহুর শ্রমিক আন্দোলন করেন এবং সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি। এম এ আজিজ এখন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। পাকিস্তান হওয়ার পর অনেকবার ও অনেকদিন জেলে কষ্ট ভোগ করেছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব তখন এদের নেতা ছিলেন। পরে তিনি মুসলিম লীগে থেকে যান। আজিজ ও জহুর আওয়ামী লীগে চলে আসেন। চৌধুরী সাহেব খুবই স্বার্থপর হয়ে উঠেন এবং একগুঁয়েমি করতেন, সেজন্য যাঁরা তাঁকে চট্টগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পরে তাঁরা সকলেই তাঁকে ত্যাগ করেন।’

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী যে সময়ে লেখা তার পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু ও এম এ আজিজের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যক্তিগত গণ্ডি থেকে পারিবারিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তার প্রমাণ মেলে এম এ আজিজের সহধর্মিণী বেগম তাহেরা আজিজের কথায়।

তিনি বলছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মঞ্জু (এম এ আজিজের ছেলে নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু, স্বাধীনতার পর জাসদ নেতা) যখন হলে থাকবে বলে ঠিক করলো, তখন উনার বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায়ই বলতেন, “মঞ্জু আমার বাসায় থেকে লেখাপড়া করবে, তার লজ্জা কিসের!” বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা এবং অত্যধিক ভালবাসার ফলে মঞ্জু উনার বাসায় থেকে দুই মাস বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতো। পরবর্তীতে ইকবাল হলে সিট পাওয়ার পর মঞ্জু হলে চলে যায়। কিন্তু এর পরও তিনি বলতেন, “অবশ্যই দু-একদিন পরপর এসে ঘুরে যাবি এবং তোর চাচির (বেগম মুজিব) সাথে দেখা করে যাবি।” তাহেরা আজিজ আরও জানাচ্ছেন, ‘শেখ মুজিব যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উনার সাথে (এম এ আজিজের সঙ্গে) গোপনে আলাপ করতেন। শেখ মুজিব প্রায় সময় রাত ১২টার পর উনাকে ফোন করতেন।’

আগরতলা মামলা থেকে মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু লাহোরে যে গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেন তাতে প্রতিনিধি দলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন চট্টগ্রামের দুই নেতা- জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ আজিজ। যদিও এম এ আজিজ ওই বৈঠকে যাননি।

১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম গঠিত হলে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে শেখ মোজাফ্ফর আহমদ ও এম এ আজিজ। সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি হন আমির হোসেন দোভাষ ও সাধারণ সম্পাদক হন জহুর আহমদ চৌধুরী। জহুর আহমদ চৌধুরী চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী ছিলেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে এবং ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের নবগঠিত কার্যকরী কমিটিতে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রম সম্পাদক নিযুক্ত হন। জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু দলের জন্য জহুর আহমদ চৌধুরীর ত্যাগ ও নিষ্ঠার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন।

রাজনৈতিক জয়যাত্রায় চট্টগ্রামের মানুষের অতীত সংগ্রামী ভূমিকাকে বঙ্গবন্ধু প্রায় স্মরণ করতেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর চট্টগ্রামের সঙ্গীদের প্রতিও আস্থা রাখতেন। এখানকার নেতা-কর্মীদেরও তাঁর প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধার ভাব ছিল প্রশ্নাতীত। পরস্পরের আস্থার সম্পর্ক কত গভীর ছিল তার প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণার জন্য প্রথম জনসভা করার স্থান হিসেবে চট্টগ্রামকে বেছে নেওয়া এবং চট্টগ্রামের নেতাদের উদ্যোগে কথিত আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মামলা পরিচালনার জন্য মুজিব ফান্ড গঠন করে অর্থ সংগ্রহ ও তা ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া, বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁর বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবাহোত্তর আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনার আয়োজন হয়েছিল চট্টগ্রামে। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সফরের জন্য ঢাকার পরই চট্টগ্রামকে যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন তা ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে ছয় দফা ঘোষণা করলে বিভিন্ন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আইউব খানের সামরিক সরকার ও আওয়ামী লীগ বিরোধী মহল তো বটে, আওয়ামী লীগের ভেতরের বড় একটি অংশও ছয় দফার বিরোধিতা করতে থাকেন। দলের কাউকে না জানিয়ে কিংবা দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ ছয় দফা ঘোষণাকে অনেকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি।

এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন ১১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় ছয় দফার বিরোধিতার মুখে বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে প্রথম এগিয়ে আসেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছয় দফাকে সমর্থন করে প্রথম বিবৃতি দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, এম এ হান্নান, জানে আলম দোভাষ, আবুল কাসেম সাব জজ প্রমুখ যা ১৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। পরের দিন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিও ছয় দফার সমর্থনে বিবৃতি দেয়। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নেন, চট্টগ্রামে জনসভার মাধ্যমে তিনি ৬ দফা ঘোষণা করবেন।

ছয় দফা চট্টগ্রাম থেকে ঘোষণার কারণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য উদ্ধৃত করে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী বলেন, ‘টেলিফোনে শেখ সাহেব বললেন, “আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ২৫ তারিখ লালদীঘির ময়দানে ৬ দফা ঘোষণা করব।” আমি (হারুন) বললাম, ঢাকা থেকে করলে হয় না? শেখ সাহেব বললেন, “দেখ, ঢাকাইয়ারা তোদের মতো অর্গানাইজ করতে পারবে না। তাছাড়া, সারা চট্টগ্রামের একটা নাম আছে, চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার দেশ, ঐখান থেকে আমি শুরু করতে চাই।”’

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত কর্মী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক নুরুল ইসলামের লেখায় চট্টগ্রামের নেতাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থার গভীরতা আঁচ করা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব সময় চট্টগ্রামের কথা বলতেন। জহুর আহমদ, এম এ আজিজ, মানিক চৌধুরী, ডা. ছৈয়দুর রহমান-এদের কথা খুব বলতেন। বঙ্গবন্ধু একটা কথা বলতেন, “তোরা দেখিস, যেদিন আমার চট্টগ্রাম জাগবে সেদিনই আমার বাঙালি জাগবে, আমার স্বাধীনতা আসবে, আমার বিজয় আসবে”’

চট্টগ্রামের নেতা-কর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এমন আগ্রহের কারণেই তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে ছয় দফার জনসভা আয়োজনের ব্যাপক প্রস্তুতি নেন এখানকার আওয়ামী লীগ নেতারা। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা কর্মসূচির বিস্তারিত আনুষ্ঠানিক জনসভার মাধ্যমে ঘোষণা করেন বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু হিসেবে উপাধি পাওয়ার আগে চট্টগ্রামের নেতা-কর্মীরা তাঁকে ‘বঙ্গশার্দুল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। লালদীঘির সভায় সেদিন (২৫ ফেব্রুয়ারি) সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি ও শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম কণ্ডারি জহুর আহমদ চৌধুরী। সভা পরিচালনা করেন অকুতোভয় সংগঠক এম এ আজিজ। এতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী প্রমুখ। কক্সবাজার থেকে আফসার কামাল চৌধুরী, একেএম মোজাম্মেল, ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ও নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে এবং ফেনী থেকে খাজা আহমদের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন।

এর আগে ওইদিন সকালে উল্কাযোগে চট্টগ্রামের বটতলী রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে সংবর্ধনা শেষে তাঁকে স্টেশন রোডে অবস্থিত সড়ক ও জনপথ বিভাগের মালিকানাধীন রেস্ট হাউসে নিয়ে আসেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের দুই অদম্য কর্মী ইদরিস আলম ও শাহ বদিউল আলম।

১৯৫৮ সালে ওই রেস্ট হাউসের ২৩ নম্বর কক্ষটি ভাড়ায় নেন এবং পরবর্তী সময়ে সেটিকে সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করে সেখান থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করতেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ওই রেস্ট হাউস পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্ন না থাকা এবং টেলিফোন সংযোগ না থাকায় ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে সদরঘাটে হোটেল শাহজাহানে অবস্থান করেন বঙ্গবন্ধু। কথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র অভিযোগপত্রের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, ‘১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ১নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম সফর করেন এবং লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাষণ দেন। প্রসঙ্গত, দেশব্যাপী ছয় দফার প্রচার করতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের হাতে ৮ মে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুসহ যে আটজন নেতা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাঁদের মাঝে অন্যতম ছিলেন চট্টগ্রামের দুই নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ আজিজ।

মুহাম্মদ শামসুল হক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।