চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবায় যুক্ত হবে পেট-সিটি স্ক্যান

নির্ণয় হবে নির্ভুল ক্যান্সার

নিলা চাকমা »

ক্যান্সার নির্ণয়ে আধুনিক প্রযুক্তি পজিট্রন ইমিশন টমোগ্রাফি (পেট)-সিটি স্ক্যান বা পেট সিটি স্ক্যান। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স এ যুক্ত হচ্ছে সেবাটি। প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের কাজও শেষের দিকে। লক্ষণ দেখা মাত্র ক্যান্সার রোগীর ৯০ শতাংশের ওপরে রোগ শনাক্ত করতে সহায়তা করে পেট সিটি স্ক্যান- দাবি সংশ্লিষ্টদের। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামেই সুলভ মূল্যে ক্যান্সার রোগ শনাক্ত করতে পারবেন রোগীরা। এজন্য আর ঢাকা বা বিদেশ যেতে হবে না।

জানা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পাশেই ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স (নিনমাস) এ ২০১৭ সালে পেট-সিটি স্ক্যান যুক্ত করা হয়। এরপর ২০২১ সালে ২৪ অক্টোবর ‘নিনমাস’র আওতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দুটি পেট-সিটি স্ক্যান স্থাপন করা হয়। ঢাকায় মাত্র কয়েকটা বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছে এই পেট-সিটি স্ক্যান । এবার প্রথমবার চট্টগ্রামে যুক্ত হতে যাচ্ছে অত্যাধুনিক ক্যান্সার নির্ণয়ের এই স্ক্যানটি। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসেন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স চট্টগ্রামে সেবা দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম ছাড়াও ময়মনসিংহে বর্তমানে পেট-সিটি স্ক্যান স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।

ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসেন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স চট্টগ্রামে ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় অবকাঠামোর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ৬ তলাবিশিষ্ট এই ভবনটিতে সাইক্লট্রন সুবিধাও থাকবে। ক্যান্সার চিকিৎসায় আইসোটোপ উৎপাদন করা হবে। বেসরকারি হাসপাতালে পিইটি-সিটি পরীক্ষা করতে প্রায় ৬০ বা ৬৫ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ক্যান্সার রোগীরা ২৫-৩০ হাজারের মধ্যে এই পরীক্ষা করাতে পারবেন। চট্টগ্রামের কোনো রোগীকে ঢাকা গিয়ে পেট-সিটি স্ক্যান করাতে হবে না। ঘরের দুয়ারে কম খরচে এই পরীক্ষা করাতে পারবেন।

পেট-সিটি স্ক্যান কি
শরীরে যদি ক্যান্সার বাসা বাঁধে, বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও তা খুঁজে পাওয়া না গেলে পেট-সিটি স্ক্যান করা হয়। এটির মাধ্যমে সহজে ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। এছাড়া যাদের ক্যান্সার হয়ে গেছে, তাদের কেমো থ্যারাপিতে কেমন সারা দিলো সেটা বুঝতে সাহায্য করে এই স্ক্যান। এছাড়া ব্রেনে নিউরোলোজিক্যাল সমস্যা এবং হার্টের সমস্যা থাকলেও এই স্ক্যানের সাহায্য নেওয়া হয়।

পেট-সিটি স্ক্যান কিভাবে কাজ করে
পেট (পজিট্রন ইমিশন টমোগ্রাফি) স্ক্যান এবং সিটি স্ক্যান এ দুটো মেশিন পেট-সিটি স্ক্যানের ভেতরে থাকে। যখন পেট সিটি স্ক্যান করানো হয় তাকে এক ঘণ্টা আগে রেডিও অ্যাক্টিভ ইনজেকশন (ফ্লুরো ডিঅক্সি গ্লকোজ) শরীরে দেওয়া হয়। এটি ধমনীর মাধ্যমে বা খাবারের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। এরপর রোগীকে এক ঘণ্টা শুয়ে রাখা হয়। পরে সেটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এক ঘণ্টা অতিক্রম করলে রোগীকে বাথরুমে যেতে বলা হয়। তারপর স্ক্যান করানো হয়। কোথাও ক্যান্সার থাকলে তা নির্ভুুলভাবে ধরা পড়ে। তবে ক্লাস্টোফোবিয়া (ভয়ের অসুখ), গর্ভবতী, অ্যালার্জি ও হার্টের সমস্যা থাকলে পেট-সিটি স্ক্যান না করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
চট্টগ্রামে পেট-সিটি স্ক্যান স্থাপনের খবরে ক্যান্সার আক্রান্ত রুম্পা চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে পেট- সিটি স্ক্যান যুক্ত হচ্ছে। সেটা ভালো খবর। আমি প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার আক্রান্তের খবর বুঝে উঠতে পারিনি। এখানে অনেক চিকিৎসক দেখিয়েছি। অনেক পরীক্ষা করিয়েছি। কিন্ত তেমন জটিল কিছু ধরা পড়েনি। পরে শরীর যখন মাত্রাতিরিক্ত খারাপ হয়, ভারতে চলে যাই। সেখানে ক্যান্সার ধরা পরে। কিন্ত চট্টগ্রামে পেট-সিটি স্ক্যান থাকতো প্রাথমিক অবস্থায় আমি রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসাসেবা নিতে পারতাম। আমি চাই এটা দ্রুত স্থাপনের কাজ শেষ করে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হোক।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রোগী বলেন, আমাদের তো এতো অর্থ নেই। বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ঢাকায় গিয়ে সরকারি খরচে করলে দীর্ঘ সিরিয়াল পড়ে। অন্যদিকে বেসরকারিতে খরচও বেশি। এছাড়া কেমোথোরাপি কতটুকু সারা দিচ্ছে তা দেখতে পেট-সিটি স্ক্যান লাগে। আমাদের মতো গরিবদের জন্যও হলেও দ্রুত সেবা নিশ্চিত করা হোক।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় চমেক হাসপাতালের রেডিও থেরাপি ওর্য়াডের বিভাগীয় প্রধান ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘এখানকার মানুষ ভোজন রসিক। ভাজা-পোড়া ছাড়া একদিনও চলে না। যার ফলে অন্যান্য রোগের সাথে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ক্যান্সার রোগের জন্য উন্নত মানের চিকিৎসা সেবায় এখনো পিছিয়ে। চট্টগ্রামে পেট-সিটি স্ক্যান হলে সেটা একটা মাইল ফলক হবে। আমাদের মেডিক্যালে নতুন ক্যান্সার ভবন নির্মাণ কাজ চলমান। এটার কাজ শেষ হলে এবং পেট-সিটি স্ক্যান এই দুটা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেই ক্যান্সার চিকিৎসায় এক ধাপ এগুবো চট্টগ্রাম।’

কখন থেকে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হবে এমন প্রশ্নে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স চট্টগ্রামের পরিচালক ডা. পবিত্র কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘এটা আসলে বলা মুশকিল। এটা সরকারের একটা প্রকল্প। তবে তারা আমাদের জানিয়েছেন আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে চিকিৎসাসেবা চালু হবে। এখন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আমরাও চাই দ্রুত কাজ শেষ হোক। যাতে এ এলাকার রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়।’