চকবাজার থানা-পুলিশের নামে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি

চকবাজারের একজন ভাসমান বিক্রেতার কাছ থেকে টাকা আদায় করছেন বিপ্লব খান। রোববার (২১ জুন) বেলা ১২টা ২৫ মিনিটে তোলা ছবি। ইনসেটে বিপ্লব খান-সুপ্রভাত

প্রতিদিন টাকা আদায় করেন সোহেল, রাসেল ও বিপ্লব#
পুরো এলাকাকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার দাবি ব্যবসায়ীদের#

রুমন ভট্টাচার্য :
মহাকারী করোনাকালের কঠিন সময়ে থেমে নেই চাঁদাবাজি। যেখানে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই এখন সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর সেখানে প্রতিদিন চকবাজার থানা, টহল পুলিশ ও ফাঁড়ির নামে প্রকাশ্যে চাঁদা তুলছেন তিন ব্যক্তি। রাস্তা ও ফুটপাতে বসা ভাসমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদার নামে এই টাকা আদায় করা হচ্ছে। বাদ নেই প্যারেড মাঠের বাজারও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চকবাজার থানার নামে সোহেল, ফাঁড়ির নামে বিপ্লব ও টহল পুলিশের নামে রাসেল নিয়মিত টাকা তুলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এর প্রশংসা করে গত ১২ মে রাত ৭টা ২৮ মিনিটে একটি পোস্টও দেন বিপ্লব।
তবে বিপ্লবকে চিনেন না জানিয়ে চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই আকরাম হোসাইন সুপ্রভাতকে বলেন, ‘ফাঁড়ির নামে কেউ চাঁদাবাজি করলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’ এরকম লোকগুলো প্রত্যেক পুলিশ অফিসারের সাথে অ্যাড থাকে, বলেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, সোহেল রাহাত্তারপুল, রাসেল ডিসি রোড ও বিপ্লব বড় মিয়া মসজিদ এলাকায় বসবাস করেন। ধুনীরপুল এলাকায় রাসেলের একটি চায়ের দোকান রয়েছে। বিপ্লব নিজেকে ফুলতলা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে চলেন। তবে কোথাও কোনো অফিস নেই।
ভাসমান ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন থানার নামে-২০ টাকা, ফাঁড়ির নামে-৩০ টাকা ও টহল পুলিশের নামে ৩০ টাকাসহ মোট ৮০ টাকা চাঁদা নেন এরা তিনজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চকবাজার এলাকায় প্রায় ১৫ বছর ধরে ভ্যানগাড়িতে পণ্য বিক্রি করছেন এমন একজন ব্যক্তি বলেন, ‘যখন ৫ টাকা হাসিল ছিল তখন থেকে ব্যবসা করে আসছি। বর্তমানে হাসিল দিতে হয় ১০০ টাকা। ‘সেয়ানা পোলারা’ নিয়ে যায় ৫০ টাকা। থানা-পুলিশের নামে তিনজনে নেয় ৮০। প্রায় ৫-৬ বছর ধরে এভাবে টাকা দিচ্ছি।’
জানা যায়, প্রতিদিন ধুনীরপুল থেকে ফুলতলা, প্যারেড মাঠের বাজার, কেবি আমান আলী রোড, ডিসি রোড, লালচান্দ রোড, তেলিপট্টি রোড, কাপাসগোলা, গুলজার মোড়, কলেজ রোড, প্যারেড কর্ণার এলাকার প্রায় শতাধিক ভাসমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তোলা হয়। প্রতিমাসে মাসে সেই চাঁদার টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক লাখ টাকা।
চকবাজার কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চাঁদাবাজি এখানে ওপেন সিক্রেট। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে চকবাজার কাঁচাবাজার প্যারেড মাঠে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু ধুনীরপুল-ফুলতলা পর্যন্ত এতগুলো তরকারির দোকান রাস্তা ও ফুটপাত কিভাবে দখল করে আছে? এগুলো তুলতে সিটি করপোরেশন দু’বার উচ্ছেদ অভিযান করেছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য।’ তিনি পুরো এলাকাকে দ্রুত সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার দাবি জানান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান সুপ্রভাতকে বলেন, ‘পুলিশের কথা বলে চাঁদা আদায় এটা অসম্ভব ব্যাপার। তবে এটা চলছে, শুনছি দীর্ঘদিন ধরে। এরা কারা? আমাকে তালিকা দিন। তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।’
সরেজমিন রোববার (২১ জুন) বেলা ১২টা ২৫ মিনিটে চকবাজার কাঁচাবাজারের সামনে বসা একজন আম বিক্রেতার টাকা কাছ থেকে ব্লু শার্ট ও কালো জিন্স প্যান্ট পরিহিত এক ব্যক্তিকে টাকা নিতে দেখা যায়।’
পরে সেই বিক্রেতা মো. জুবায়ের জানান, টাকা নেওয়া ব্যক্তির নাম বিপ্লব। প্রতিদিন ৩০ টাকা নেন পুলিশের নামে। এর আগে আরো দু’জন এসে ২০ ও ৩০ টাকা নিয়ে গেছে একই কথা বলে।’
এ বিষয়ে জানতে বিপ্লব খানের মুঠোফোনে ঐদিন রাতে যোগাযোগ করা হলে তিনি চাঁদা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন ‘ফুলতলা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির নামে টাকা নেওয়া হয়।’ সমিতির অফিস কোথায় এবং রশিদ দেওয়া হয় কিনা এমন প্রশ্নের তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ফাঁড়ির ইনচার্জকে চিনেন না জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি। রাসেলের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনকল ধরেননি এবং সোহেলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কে বি আমান আলী রোডের সবজি বিক্রেতা মো. রাজ্জাক বলেন ‘সোহেল ২০ টাকা, রাসেল ৩০ টাকা ও বিপ্লব নেয় ৩০ টাকা। এভাবে প্রতিদিন দিতে হয়।’
চকবাজার থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নিজাম উদ্দিনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘সোহেল, রাসেল ও বিপ্লব এরা কারা? এদের কাউকেই চিনি না। আমরা জানি এখানে বাজারের হাসিল তোলা হয়। হাসিল ছাড়া অন্য কোন খাতে টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই। যদি নিয়ে থাকে এটি কতটুকু সত্য দেখতে হবে। এখানে বাজার কমিটি নিয়ে একটা গ্রুপিং আছে। ভুক্তভোগীরা আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’