ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ঝড় নয়, জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা উপকূলে

# পূর্ণিমা ও জোয়ারের কারণে উপকূলে তিন থেকে ছয় ফুটের অধিক উচ্চতার জোয়ার হতে পারে
# আজ দুপুরের পর উড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে ‘ইয়াস’
# উপকূলে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত, তবে শেষ মুহূর্তে বাড়তে পারে সংকেত

ভূঁইয়া নজরুল >
ঝড় নয়, জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়তে পারে দেশের উপকূল। সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপ ও চরাঞ্চলের অনেক এলাকা গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে প্লাবিত হয়েছে। পূর্ণিমা ও জোয়ার উভয়ের প্রভাবে উপকূলে আজ বুধবার জোয়ারের উচ্চতা ৩ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে দেশের উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর গতিপথ দেখে এটা নিশ্চিত তা উড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের দিয়ে অতিক্রম করে স্থল নিম্নচাপে রূপ নেবে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরসহ আবহাওয়াবিষয়ক বিভিন্ন মডেলে ঝড়ের গতিপথ নিয়ে একই চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে ঝড়ের কেন্দ্রে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটারর গতিতে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। আজ দুপুরের পর সমবেগে তা উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এই বেগে উপকূলে তেমন ক্ষতিকর প্রভাব না পড়লেও এতে জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। ইতোমধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৩ নম্বর বিশেষ বুলেটিনে দেশের উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় তিন থেকে ছয় ফুট অধিক উচ্চতার জোয়ার হতে পারে বলে জানিয়েছে।
জলোচ্ছ্বাস আতঙ্ক যে কারণে
উপকূলে জলোচ্ছ্বাস আতঙ্কের প্রধান কারণ পূর্ণিমা ও ঘূর্ণিঝড় আঘাতের সময় জোয়ার থাকা। স্বাভাবিকভাবেই পূর্ণিমার সময়ে সাগরের পানি ফুলে উঠে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তি জোয়ার দেখা যায়। অপরদিকে আজ বুধবার উপকূলে আঘাতের সময় থাকবে জোয়ার। একদিকে জোয়ার ও অপরদিকে পূর্ণিমা উভয়ের মিলিত প্রভাবে উপকূলে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। এতে জলোচ্ছ্বাস দেখা দিতে পারে। এবিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক এবং ন্যাশনাল ওশোনোগ্রাফি মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির (নোয়ামি) চেয়ারম্যান সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘এই ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের উপকূলে তেমন ঝড়ো হাওয়া দেখা যাবে না। এটি প্রবাহিত হচ্ছে উড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে। তবে এর প্রভাবে উপকূলে বাড়তি জোয়ার দেখা দিবে। আর এতেই উপকূলে ক্ষয়-ক্ষতি বাড়বে।’
তিনি আরো বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ নেই। তাই সেখানে বাড়তি উচ্চতার জোয়ার হলে সাগরের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে।
এবিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ইতোমধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুুলনা, বরগুনাসহ অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে কিংবা বেড়িবাঁধ না থাকায় পানি প্রবেশ করেছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস অতিক্রম করার সময় উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে তিন থেকে ছয় ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে আমরা ঘোষণা দিয়েছি।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর পতেঙ্গা কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন, আজকের দ্বিতীয় জোয়ার সন্ধ্যায়। সেহিসেবে যদি বিকেল থেকে ঝড়টি অতিক্রম শুরু করে তাহলে উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই জোয়ারের উচ্চতা বাড়বে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৩ নম্বর বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে দেশের উপকূলীয় জেলা, চর ও দ্বীপাঞ্চল সমূহে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে ছয় ফুট অধিক উচ্চতার জোয়ার হতে পারে। একইসাথে এসব এলাকায় ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।
বৃষ্টিপাত হবে কি-না জানতে চাইলে শহীদুুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে হালকা বৃষ্টিপাত হবে। তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ একটু বেশি হতে পারে। তবে ভোগাতে পারে জলোচ্ছ্বাস।
সংকেত বাড়তে পারে
অতীতের ঘূর্ণিঝড়ে আমরা দেখেছি ছয় বা সাত নম্বর বিপদ সংকেত একদিন আগেই দিয়ে দেয়া হতো। তবে এবার এখনো সংকেত না বাড়িয়ে স্থানীয় সতর্ক সংকেত তিন নম্বর রাখা হয়েছে। এই সংকেত আর বাড়বে কি-না জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন,‘ কাল (বুধবার) সকালের দিকে হয়তো সংকেত কিছুটা বাড়ানো হতে পারে। তবে এখনই এবিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, এই সংকেত বাড়ানোর বিষয়টি অনেকগুলো সংস্থার সমন্বয়ে হয়ে থাকে। স্থানীয়দের মনস্তত্ত্বও বিবেচনায় আনা হয়। কারণ অনেক সময় দেখা যায়, সংকেত না বাড়ালে মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে আসতে চায় না। আবার ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় স্ট্যান্ডিং কমিটির কার্যক্রমও শুরু হয় না। তাই অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করে সংকেত বাড়ানো হয়ে থাকে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৩ নম্বর বিশেষ বুলেটিনে জানায়, প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ৫৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৫০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা বন্দর থেকে ৩৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৩৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরো ঘনীভূত হয়ে উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি উড়িশ্য ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের মধ্য দিয়ে আজ বুধবার দুপুরের পর অতিক্রম করতে পারে। এর প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে বলে দেশের বন্দরসমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ১২০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উল্লেখ্য, চলতি মাসের আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বঙ্গোপসাগরে এক বা একাধিক নিম্নচাপ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এসব নিম্নচাপ থেকে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনাও বলা হয়েছিল। বছরের এসময়ে সাগরে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে। এপ্রিল-মে ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম।