খুনি আলবার্ট

বাসিল ফার্নান্দো »
অনুবাদ : আলমগীর মোহাম্মদ »

আলবার্ট গ্রামের একজন ফৌজি কর্মকর্তা ছিলেন। এই কারণে গ্রামবাসীরা তাঁকে মিনিমারু আলবার্ট নামে ডাকতো। তারা এটা করতো তাঁকে অপমান করতে, তাঁর সাথে দু’নাম্বারী করতে, তাঁকে একঘরে ক’রে রাখতে, এবং সর্বোপরি নিজেদের অকর্মণ্যতা চাপা দিতে।
জো’র মনে পড়ে আলবার্টের মৃত্যুর কয়েকমাস পর শান্তা তাকে খুবই দরদ দিয়ে বলেছিল আলবার্টের কথাগুলো।
ওদের তিনজনেরই বাড়ি কলম্বোর আশেপাশে একটা গ্রামে। জো এই গ্রামে এসেছিলেন বিয়ের পর, তা-ও ত্রিশ বছর আগে। সরকারি চাকুরে হওয়ার কারণে সবাই তাঁর খোঁজ রাখতো এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ওই গ্রামের একজন হয়ে উঠেছিলেন । শান্তা জো’র চেয়ে বয়সে কমপক্ষে বিশ বছরের ছোট, গ্রামের প্রথম স্নাতক ছিলেন এবং গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে আলাপে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। সম্প্রতি জনৈক জাপানি ফৌজি কর্মকর্তা সম্পর্কে জানতে পেরে তিনি খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন।
গ্রামের লোকজন আলবার্টকে সবসময় মিনিমারু আলবার্ট হিসেবেই চিনতেন। হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি একবার। অবশ্য আদালত যথোপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় তাঁকে বেকসুর খালাস দিয়েছিল। কিন্তু আদালতের রায় জনমনে প্রতিষ্ঠিত ধারণা বদলাতে পারে নি। তারও অনেক আগে থেকে গ্রামবাসী তাঁকে মিনিমারু আলবার্ট নামে ডাকতো। অবশ্য সেটা তাঁর অনুপস্থিতিতে। তাঁর ছেলেমেয়েকে বলতো খুনি আলবার্টের সন্তান।
গ্রামবাসী যারা কি না নিজেদেরকে ক্ষমাশীল হিসেবে ভাবতে স্বচ্ছন্দবোধ করে, তারা আলবার্টের প্রতি অহেতুক নির্দয় আচরণ করেছিল। যদিও তারা দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা, ভ্রষ্ট যাজক, এবং এমনকি খুনিদেরকেও মাফ করে দিতো।
কষ্টের কথা এ গ্রামের মানুষ প্রায়শই ভুলে যায় এবং কষ্টদাতাকেও ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু যারা তাদের অক্ষমতাকে প্রশ্ন করতো তাদেরকে তারা ক্ষমা করতো না — অন্যভাবে বলতে গেলে প্রকৃতপক্ষে, যারা তাদের ভীরুতা সম্পর্কে মুখ খুলতো তাদের ব্যাপারে খুবই নির্দয় ছিল।
জো’র মনে পড়ে আলবার্ট একজন জোয়ান মানুষ ছিলেন। শারীরিক অবয়বের বিচারে জো’র দেখা সবচেয়ে শক্তিমান পুরুষ আলবার্ট। লম্বা-চওড়া, শ্যামল গাত্রবর্ণ এবং তীক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। কতক লৌহমানবীয় বৈশিষ্ট্যও ছিল বলা যায়। আলবার্ট দ্রুতগতিতে হাঁটতে পারতেন এবং করিৎকর্মা ছিলেন। তিনি সবসময় কিছু না কিছু করতে চাইতেন। বলতে গেলে, তিনি সবসময় কর্মতৎপর ছিলেন।
শান্তা ও জো’র আলাপের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো গ্রামের মানুষ স্বভাব- চরিত্র বিশ্লেষণ। শান্তা প্রায়সময় গ্রামবাসীদের চাঁছাছোলা সমালোচনা করতেন। জো অতটা নির্দয় না হলেও মনে করতেন শান্তার কথার কিছুটা সত্যতা আছে।
“আমাদের মানুষের অবস্থা দেখেন” শান্তা বলতেন। “তাঁরা কর্মতৎপরতাকে কি পরিমাণ ঘৃণা করে। তারা কীভাবে নির্জীব হয়ে থাকতে চায়। তাদের ধারণা কাজে নেমে পড়া মানেই অসুবিধেয় পড়া।”
“সম্ভবত জনগণ ভুল করছে না”, জো মাঝেমধ্যে তর্ক করতেন তাঁর কমবয়সী বন্ধুকে উত্তেজিত করে দিতে নয়, নতুন একটা অবস্থান তৈরির জন্য। জো সবসময় ভালো আলাপের ভক্ত। “আপনি জানেন আলবার্ট অপরাধ না করেও কীভাবে পুলিশের হাতে মার খেতেন। সম্ভবত গ্রামের মানুষগুলো তাদের শত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারে সবকিছুর সমাপ্তি কীভাবে হয়।”
“হ্যাঁ, আমার মনে হয় আপনি সব আলাপে আলবার্টের প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। শান্তা বলতেন, আপনি তর্কে জিততে নোংরা কৌশল অবলম্বন করেন,” শান্তা আরো যোগ করেন, “আপনি ভুল জিনিসকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে জানেন যা শুনে শুদ্ধ মনে হবে মানুষের।”
“আপনি জানেন যে আলবার্ট কখনো পুলিশের মার খেয়ে ভড়কে যেতেন না। তিনি ঐ পুলিশ সদস্যদের ঘৃণা করতেন যারা একজন ব্যক্তিকে ধরে আনতে পারলে দলবদ্ধভাবে অত্যাচার করতো। এদের কারো সাথে দেখা হলে আলবার্ট একটা সলজ্জ হাসি বিনিময় করে সটকে পড়তেন। দুই বা তিনজনের সাথে দেখা হয়ে গেলে, তারা তাঁকে এসব মনে না রাখতে বলতো। এইসব গ্রামের সবার জনা।গ্রামবাসীরা গোপনে তাঁর এসব গুণের কদর করতো। কিন্তু এমন একটা ভাব করতো যেন আলবার্টকে তারা ঘৃণা করে।
“কিন্তু তিনি বীরের বেশে মরতে পারেননি। তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল ক্রাচে ভর দিয়ে গ্রামবাসীর দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে।” জো এটা বলেছিলেন তাঁর বন্ধুর রাগ পরখ করতে।
কিন্তু শান্তা ঠান্ডা মাথায়, চোখেমুখে একটা ঝলক নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আপনি এখন ফাঁদে আটকা পড়েছেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম আপনি ভিক্ষের কথা কখন তুলবেন।
“একটা পাখির পালক কেটে দিয়ে পাখিটার কাছে আকাশে ওড়া প্রত্যাশা করতে পারেন আপনি? আপনি জানেন এটা কীভাবে ঘটেছিল। একজনকে ভাড়া করা হয়েছিল আলবার্টকে খুন করার জন্য। কিন্তু সে আলবার্টকে দেখে ভয় পেল। সুতরাং সে অপেক্ষা করতে লাগলো আলবার্ট কখন ঘুমিয়ে পড়বে। শেষতক আলবার্ট যখন গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়লেন সেই ভাড়াটে লোকটা তাঁর একটা পা কেটে ফেলল। সম্ভবত, সে মনে করেছিল সে আলবার্টের গলা কাটতে পেরেছিল। তারপর মেডিকেলে ডাক্তাররা তাঁর পা টা বাঁচানোর কোন চেষ্টা করলেন না। আলবার্ট মেডিকেল থেকে ফিরলেন এক পায়ে। হ্যাঁ, একটা পালকছাড়া পাখি। একটা পালক দিয়ে কোনভাবেই ওড়া যায় না। দুটো লাগবেই।
আলবার্টের সাথে কী হয়েছিল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো আলবার্টকে মেডিকেল থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে এক পায়ে ফিরতে দেখে গ্রামবাসী কী পরিমাণ খুশি (অবশ্যই গোপনে) হয়েছিল সেটা। তারা ভাবল, তাদের বিশ্বাস নিশ্চিত ছিল। তারা ছেলেমেয়েদের বলেছিল, আহা, শেখার জন্য এটা একটা ভালো উদাহরণ; বেশি লাফালাফি করলে শেষতক পা ভাঙবেই! এবং এভাবে গ্রামবাসীরা আবারো মানসিকভাবে তাদের সেই পুরনো অসুখী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল।”
“কিন্ত,” জো জিজ্ঞেস করলো, “এই পরিস্থিতিতে একজন ফৌজি কর্মকর্তা আত্মহত্যা করতো না?”
“কিন্তু আলবার্ট এমন একজন ফৌজি কর্মকর্তা যিনি জানতেন না তিনি কে ছিলেন,” শান্তা অনেকটা ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন।

লেখক পরিচিতি :
বাসিল ফার্নান্দো একজন শ্রীলঙ্কান বিচারক, কবি ও খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী। শ্রীলঙ্কার উচ্চতর আদালতে প্রায় নয় বছর ধরে বিচারক হিসেবে কাজ করেন তিনি। এরপর জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন উচ্চপদে। তিনি ২০১৪ সালে ‘জরমযঃ খরাবষরযড়ড়ফ অধিৎফ’ লাভ করেন।

অনুবাদক : আলমগীর মোহাম্মদ
শিক্ষক, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।