খালের মাটির নিচে চাপা পড়েছে ছালেহ আহমেদ!

নদীতে পড়লে অবশ্যই ভেসে উঠতো : ফায়ার সার্ভিস

শেষ হলো উদ্ধার অভিযান

ভূঁইয়া নজরুল »
খালের মাটির নিচেই চাপা পড়ে আছে ৫০ বছর বয়সী ছালেহ আহমেদের মৃতদেহ! আর এই মাটি চাপার ঘটনাটি ঘটেছে চশমা খাল, মির্জা খাল ও নোয়াখালের প্রায় ৯ কিলোমিটারের মধ্যে। তবে মৃতদেহ কোনোভাবেই কর্ণফুলীতে পতিত হয়নি কিংবা খালের পানিতেও নেই। যদি নদীতে বা খালে থাকতো তাহলে অবশ্যই এতোদিনে তা ভেসে উঠতো। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান শেষে এবং খাল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
গত ২৫ আগস্ট প্রবল বৃষ্টিতে সকাল ৯টার দিকে মুরাদপুর মোড়ে আয়োজন রেস্তোরাঁর সামনের খালে পড়ে গিয়েছিল ছালেহ আহমেদ। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরা পটিয়ার বাসিন্দা চকবাজারে সবজি বিক্রি করতেন। বৃষ্টির সময় প্রবল স্রোতে খালে পড়ে যাওয়ার পর একজন লোক টেনে তুলতে চাইলেও তোলা যায়নি, পানির স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু ভেসে কোথায় গেল? জীবিত বা মৃত কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি ছালেহ আহমেদকে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল ১১ দিনের অভিযান শেষে গত রোববার তাদের অভিযান সমাপ্ত করে। তাহলে কোথায় গেল ছালেহ আহমেদ?
ছালেহ আহমেদের তিনটি পরিণতি হতে পারে
প্রথম পরিণতি-ছালেহ আহমেদকে না পাওয়ায় অনেকের ধারণা ছালেহ আহমেদ হয়তো পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছেন। তবে যেহেতু খালের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ কার্যক্রম চলছে তাই কোথাও না কোথাও আটকে গিয়ে খাল থেকে নিজেই উঠে গিয়েছেন কিংবা কেউ না কেউ তাকে উদ্ধার করেছে। নোয়াখাল পাড়ে রিটেনিং দেয়াল নির্মাণের কাজে নিয়োজিত ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশান কোম্পানির কর্মচারী মোহাম্মদ রাজু গতকাল দুপুরে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এখানেও এসেছিল উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে। হয়তো নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিটি খালের মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে অথবা খাল থেকে কারো না কারো সহায়তায় তিনি উঠে গিয়েছে।
কিন্তু খালে মাটি চাপার সাথে একমত হলেও খাল থেকে উঠে যাওয়ার সাথে একমত নন নিখোঁজ হওয়া ছালেহ আহমেদের বড় ছেলে সাদেকুর রহিম। পশ্চিম পটিয়া এ জে চৌধুরী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদেকুর রহিম বলেন, ‘আমার বাবা জীবিত থাকলে এতোদিন অবশ্যই বাসায় আসতো। তাই জীবিত নেই বলেই মনে হচ্ছে।’
একইমত জানান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ্ আলী। তিনি বলেন, ‘যদি বেঁচে থাকতো তাহলে অবশ্যই বাসায় পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যেতো। আর মিডিয়ার কল্যাণে কোথাও থাকলে অবশ্যই লোকজন ঠিকই খবর দিতো।’
দ্বিতীয় পরিণতি-প্রবল পানির স্রোতে হয়তো ছালেহ আহমেদের মৃতদেহ কর্ণফুলীতে চলে গিয়েছে। কিংবা খালের কোথাও না কোথাও আটকে আছে। তবে এই ধারণাটিও সঠিক নয় বলে জানান ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন শিকদার। তিনি বলেন, খালের যে প্রান্তে (চশমা খাল) পড়েছে সেখান থেকে মির্জা খাল ও নয়া খাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আমাদের ৮০ জন কর্মী তল্লাশি চালিয়েছে। খালের কোথাও আটকে নেই এবং ভেসেও নেই। শুধু আমাদের লোক ই নয়, খালে যেসব টোকাই জিনিসপত্র সংগ্রহ করে তাদের দিয়েও খুঁজে দেখেছি।
তিনি আরো বলেন, কর্ণফুলীতে যেকোনো লাশ গেলে অবশ্যই নির্ধারিত সময় পড়ে তা ভেসে উঠবেই। যেহেতু এতোদিনেও তা ভেসে উঠেনি তাই নদীতে যায়নি। একইভাবে খালের মধ্যে কোথাও আটকে থাকলেও এতোদিনে তা ভেসে উঠতো এবং দুর্গন্ধ ছড়াতো। তাই খাল কিংবা নদী কোথাও ভাসমান অবস্থায় লাশ নেই।
খালের মাটির নিচেই চাপা পড়েছে ছালেহ আহমেদ
প্রথম ও দ্বিতীয় পরিণতি যখন ছালেহ আহমেদের ক্ষেত্রে হতে পারে না তাহলে কি হয়েছে। সরেজমিনে খালপাড় ঘুরে এবং উদ্ধারকারী দলের সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে খালের মাটির নিচেই চাপা পড়ে আছে ছালেহ আহমেদ। চশমা খাল, মির্জা খাল ও নোয়া খালপাড় ঘুরে দেখা যায়, যেখানে ছালেহ আহমেদ পড়েছে সেই স্থান থেকে মির্জা খালের সংযোগ (এন মোহাম্মদের বিপরীত পাশে) পর্যন্ত নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। তাই এখানে তা বাধা প্রাপ্ত হতে পারতো। যেহেতু এস্থানে নেই তাহলে পানির প্রবল স্রোতে তিনি আরো নিচের দিকে চলে গেছেন।

মির্জা খালটি কালারপুল হয়ে খতিবের হাট, হাদু মাঝি পাড়া হয়ে শমসের পাড়া রেল গেইটের কাছে গিয়ে নোয়া খালের সাথে মিলিত হয়েছে। এই স্থানে এমন কোনো স্থান নেই যে এখানে ছালেহ আহমেদ আটকে থাকতে পারে।
তবে নোয়াখালের কোনো না কোনো পয়েন্টে হয়তো মাটি চাপা পড়ে থাকতে পারে ছালেহ আহমেদ। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন শিকদার বলেন, নোয়াখালের অনেক স্থানে আবর্জনার স্তূপ রয়েছে। এছাড়া গভীরতাও বেশি। সেখানে মাটি চাপা থাকলেও থাকতে পারে ছালেহ আহমেদের মৃতদেহ।
তিনি আরো বলেন, বৃষ্টির সময় উজান থেকে প্রচুর বালি আসে। এসব বালির চাপায় হয়তো ছালেহ আহমেদ চাপা পড়তেও পারে। আর এজন্যই আমাদের ডুবুরি টিম হয়তো খুঁজে পাচ্ছে না।
এই মতের সাথে একমত পোষণ করেছেন নোয়াখালে রিটেনিং দেয়াল নির্মাণকারী ঠিকাদারি সংস্থা ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কর্মচারী মোহাম্মদ রাজুও। তিনি খালপাড়ের আবর্জনা দেখিয়ে বলেন, বৃষ্টির সময় খাল উপচে পানি প্রবাহিত হয়। উজান থেকে প্রচুর বালি আসে। সেসব বালি ও আবর্জনার কারণে কেউ না কেউ মাটির নিচে চাপা পড়ে গেলে তা পাওয়ার কথা নয়।
একই মন্তব্য করেন জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ্ আলীও। তিনি বলেন, ‘যেহেতু খাল বা নদীতে ভাসমান অবস্থায় নেই। তাই মাটি চাপা অবস্থায় থাকতে পারে। এক্ষেত্রে প্রকল্পের আওতায় পরবর্তীতে খাল খনন কর্মসূচি শুরু হলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বৃষ্টি হলেই পানি জমে। সেদিন ভোর রাত থেকে প্রবল বৃষ্টিতে নগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাট প্রভৃতি এলাকায় পানি জমে যায়। আর চশমা পাহাড়ের উজানে পাহাড়ি এলাকা থাকায় খাল দিয়ে প্রচুর বালি নেমে আসে। চশমা খাল যুক্ত হয়েছে মির্জা খালের সাথে। শমসের পাড়া এলাকায় মির্জা খালের সাথে যুক্ত হয়েছে ত্রিপুরা খাল ও বামনশাহী খাল। তিন খালের পানি একত্রিত হয়ে শমসের পাড়া রেল গেইটের কাছে নোয়াখাল নামে গিয়ে পতিত হয়েছে কর্ণফুলীতে। নোয়াখালের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার।