কার স্বার্থে এই ‘সৌন্দর্যবর্ধন’

শহরে কি খালি জায়গা থাকবে না? শহরে কি সবুজ কিংবা উন্মুক্ত জায়গা বলতে কিছুই থাকবে না? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শহরে যত্রতত্র ও যথেচ্ছ বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরির যেন প্রতিযোগিতা চলছে। বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি নিয়ে ব্যাপক গণ-অসন্তোষের মধ্যেই পাঁচলাইশে সড়ক সংলগ্ন খোলা জায়গায় বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। জনস্বার্থ বিরোধী এমন অপতৎপরতা নিয়ে গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদন আর এলাকাবাসীর প্রতিবাদকে থোড়াই কেয়ার করে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সৌন্দর্যবর্ধনের দোহাই দিয়ে কার স্বার্থে একের পর এক এমন জঞ্জাল গড়ে তোলা হচ্ছে, এটাই প্রশ্ন নগরবাসীর। ছবি: মিয়া আলতাফ

মিজানুর রহমান, অভিন্ন প্রতিবেদন, সিএনএ »

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সঙ্গে চুক্তিপত্র সম্পাদন ছাড়াই নগরীর পাঁচলাইশ সড়ক সংলগ্ন জায়গায় ‘সৌন্দর্যবর্ধনের’ কাজ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিরাক্যাল মাইলস ইন্টারন্যাশনাল। পাঁচলাইশ সড়কের খাল পাড় থেকে শ্রম আদালত পর্যন্ত অংশে ‘সৌন্দর্যবর্ধনের’ নাম দিয়ে একাধিক বাণিজ্যিক স্থাপনাও নির্মাণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ‘স্ব-উদ্যোগে’ যার তদারকি করছেন চসিকের স্থানীয় দুই কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু ও রুমকি সেন গুপ্ত।

জানা গেছে, কোন নীতিমালা না থাকলেও নির্দিষ্ট শর্তে চুক্তি করেই সড়ক-ফুটপাতে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করায় চসিক। নাগরিক সুবিধার চেয়ে বাণিজ্যিক সুবিধা বেশি থাকায় এসব প্রকল্প নিয়ে সমালোচনাও অনেক। এখন পাঁচলাইশ সড়কে চুক্তি ছাড়াই কাজ শুরু এবং ঢালাওভাবে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করায় চসিকের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের উদ্দেশ্য নিয়েই বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার বলেন, কোন ধরনের চুক্তি ছাড়া সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কেউ কাজ করতে পারে না। যদি চুক্তির শর্ত নির্ধারিত হয়ে যায় তাহলে মৌখিক অনুমতি নিয়ে কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে কেবল জনস্বার্থের অংশটুকুই করতে পারবে। বাণিজ্যিক অংশটুকু চুক্তির পরে করতে হবে। তবে এ ধরনের কাজ না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

প্রস্তাবনা দিয়েই নির্মাণকাজ শুরু:

সূত্র জানায়, গত সেপ্টেম্বরে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন সড়কটিতে সৌন্দর্যবর্ধন করার একটি প্রস্তাব সিটি মেয়রের কাছে জমা দেয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মিরাক্যাল। মেয়র প্রস্তাবটি মতামতের জন্য সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠিয়ে দেন। আইন শাখাসহ অন্য শাখাগুলোর মতামত গ্রহণের পর প্রস্তাবটি সম্প্রতি মেয়রের দপ্তরে জমা দিয়েছে নগর পরিকল্পনা শাখা। গত রবিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।

তবে চুক্তি স্বাক্ষর পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই সৌন্দর্যবর্ধনের অবকাঠামোগত কাজ শুরু করে দিয়েছে মিরাক্যাল। কাজ শুরুর আগে গত ৩ অক্টোবর সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সেই থেকে আড়াই মাস ধরে পাঁচলাইশ খাল পাড় থেকে শ্রম আদালত পর্যন্ত দুইশ মিটারের বেশি জায়গায় স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। গত ১৬ ডিসেম্বর সেখানের একাংশে নির্মিত কিডস জোন ও জিম সেন্টারের উদ্বোধন করেন কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু।

মিরাক্যাল’র সঙ্গে চুক্তি না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চসিকের সিইও শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। চুক্তি সম্পাদনের আগেই কাজ করা বৈধ কিনা- এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে ‘চুক্তির আগে কাজ করা ঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। অন্যদিকে, মিরাক্যাল’র কর্মকর্তা ওমর ফারুক দাবি করেছেন, চসিকের সঙ্গে তাদের এক ধরনের ‘লিখিত’ কথা হয়েছে। চুক্তি হয়নি সেটা সরাসরি বলা যাবে না। লিখিত কথা কী সে ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি মিরাক্যালের এই কর্মকর্তা।

২০ বছরের বরাদ্দে বাণিজ্যিক স্থাপনা!

প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী কাতালগঞ্জ খাল পাড়ে একটি ময়লার সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস), এর পাশে স্মৃতিতে বায়ান্ন, স্মৃতিতে একাত্তর, বীর শ্রেষ্ঠদের ম্যুরাল, বসার স্থান, ফিশ এক্যুরিয়াম, জিম সেন্টার এবং কিডস জোন করার কথা রয়েছে। পরবর্তী ধাপে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, সরকারের উন্নয়ন চিত্রের ডিসপ্লে বোর্ড, সাবেক মেয়রদের ম্যুরাল বসানো হবে। মাঝে স্থাপন করা হবে ফার্মেসি ও কফিশপের মতো বাণিজ্যিক স্থাপনা।

তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্প প্রস্তাবনার বাইরেও বেশকিছু বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিপরীতে টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে বিশাল এলাকা। সেখানে প্রিমিয়াম কিডস জোন নামে একটি বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া ম্যুরাল, জিম সেন্টার, কিডস জোনের ফাঁকে জুসবার, কফিশপ, ফুড জোনের মতো বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরির কাজ করছেন শ্রমিকরা।

সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে মিরাক্যাল’র কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, প্রকল্পে ১ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে কিডস জোন, কফিশপ, ফার্মেসি হবে। ২০ বছরের জন্য বরাদ্দ নিচ্ছি। ধাপে ধাপে টাকা তুলবো। তবে চসিকের সিইও শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এমন কিছু করা ঠিক হবে না যেটা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। নাগরিকদের বঞ্চিত করে। কারণ জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে।

প্রকল্পের জায়গাটি আসলে কার?

পাঁচলাইশ সড়কের যে অংশে মিরাক্যাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেই জায়গার মালিকানা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ষাটের দশকে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার সময় গণপূর্ত অধিদপ্তর পুরো জমি অধিগ্রহণ করে। এ সময় সড়কঘেঁষা প্লটের পাশের কিছু জমি ভবিষ্যতে সড়ক সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহারের জন্য খালি রাখে তারা। ১৯৮৮ সালে জমিটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চসিককে হস্তান্তর করা হয়।

জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ জানান, চসিককে হস্তান্তরের পর দীর্ঘদিন জমিটি বেদখলে ছিল। সেখানে মাইক্রো স্ট্যান্ড, দোকান গড়ে তোলা হয়। সম্প্রতি এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে চসিক আমাদের জানায়- সেখানে নাগরিক সুবিধা বাড়িয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের কিছু কাজ, অস্থায়ী জিম, বাচ্চাদের খেলার জায়গা করবে তারা। তবে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি আমাদের জানা নেই।

স্থানীয় দুই কাউন্সিলর যা বললেন:

পাঁচলাইশ সড়ক সংলগ্ন জায়গায় ‘সৌন্দর্যবর্ধনের’ কাজ তদারকির বিষয়টি স্বীকার করেছেন চসিকের চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু ও সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুমকি সেন গুপ্ত। টিনু বলেন, মেয়র মহোদয়ের অনুরোধে নির্মাণকাজ তদারকি করছি। এটা ভালো কাজ। এ ধরনের কাজে উৎসাহ দেয়া উচিত। অন্যদিকে, রুমকি বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবেই এ কাজের তদারকি করছেন তিনি। চসিকের সঙ্গে মিরাক্যাল’র চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

‘লুটেপুটে’ খাওয়ার আরেকটি আয়োজন নয়তো?

সড়ক সম্প্রসারণের জন্য রাখা জায়গায় সৌন্দর্যবর্ধনের নামে স্থাপনা নির্মাণ জনগণের সম্পদ লুটেপুটে খাওয়ার আরেকটি আয়োজন বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি আখতার কবীর চৌধুরী। তিনি বলেন, নাগরিকের জায়গা নয়-ছয় করে লুটপাটের অধিকার কারও নেই। এ কাজ এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন। কালক্ষেপণ না করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।