কাজির দেউড়ির জমজমাট স্ট্রিট ফুড

হুমাইরা তাজরিন »

‘এখানে আমার প্রিয় হলো মোমোটা। তারপর ডোসা খাই মাঝে মাঝে। আমার পরিবারের সদস্যরা পিঠাগুলো খেতে ভালোবাসে। মাঝে মধ্যে পার্সেল করে নিয়ে যাই। বান্ধবীদের সঙ্গে পানিপুরী , মিক্স র্ভতা এগুলো খাওয়া হয়। পাশে খোলা মাঠ থাকার কারণে বাতাস থাকে। বিকেলে বসলে ভালো লাগে। খাবারের দাম অন্যান্য জায়গার তুলনায় খুব একটা বেশি না। তাই এখানে চলে আসি।’ নুসরাত জাহান নামের একজন ক্রেতা নগরীর কাজির দেউড়ি মোড়ের ভ্রাম্যমাণ দোকানের তিব্বতীয় খাবার ‘মোমো’ প্রসঙ্গে এ কথাগুলো বললেন। গত শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনের বিকেলে এ কথাগুলো বলেন তিনি।

মোমো বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘মোমো’ এখন ছেলে বুড়ো সবাই পছন্দ করে। এটার স্বাদের কারণে চাহিদা বাড়ছে। সকালে কম বেশি চাহিদা থাকলেও বিকেল থেকে চাপ বাড়ে। স্টিম করা মোমোর চাইতে এখন ফ্রাইড মোমোটার চাহিদা বেশি দেখতে পাচ্ছি। এমন অনেকে আছেন রেগুলার খান। একবার খেলে বার বার আসেন।’

ভোজন রসিক বাঙালির খাবারের তালিকায় রোজই থাকে মুখরোচক খাবার। তবে কর্মব্যস্ত নগরবাসীর জীবনে পুরোনো দিনের মতো রোজ রোজ নিত্যনতুন মুখরোচক খাবার বানিয়ে খাওয়া আর হয়না। তাই সময় পেলেই নামি-দামি রেঁস্তোরাগুলোতে নগরবাসী কেউ কেউ ছুটে যান। তবে এই দামি রেঁস্তোরাগুলোর খাবারের দাম সবার হাতের নাগালের মধ্যে থাকেনা।

নগরীর বিভিন্ন মোড়ে রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসেছে ভ্রাম্যমাণ স্ট্রিট ফুডের দোকান। এর মধ্যে অন্যতম কাজির দেউড়ির স্ট্রিট ফুডগুলো। এই বাহারি স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলোকে ঘিরে দৈনিক হাজার হাজার ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাজির দেউড়ি মোড় থেকে লালখানবাজারগামী রাস্তা ধরে আউটার স্টেডিয়ামের পাশে সারি সারি বসেছে এসব দোকান। প্রতিটি দোকানেই রয়েছে আলাদা আলাদা খাবার। কোনোটি ঝাল আবার কোনোটি মিষ্টি। কোনোটি টক তো আবার কোনোটি মশলাদার।
ভোজন রসিক বাঙালি ক্রেতার পছন্দ এড়ানোর যেন অবকাশই রাখেননি বিক্রেতারা। দামও থাকছে হাতের নাগালে। মূলত রোজকার ক্রেতাদের চাহিদার তুঙ্গে থাকায় কিছুটা সহনীয় দাম রাখছেন বলে জানান বিক্রেতারা।

কাজির দেউড়ি মোড় থেকে আউটার স্টেডিয়াম ঘেঁষা ফুটপাতে উঠতেই চোখে পড়বে, মুরগির মাংসের ভাজা বাহারি খাবারের ফুড কার্ট। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে চিকেন অন্থন (১০টাকা), ক্রিসপি ফ্রাইড চিকেন (৫০ টাকা), চিকেন বল (১০টাকা) , চিকেন থাই স্যুপ ( ৪০টাকা), চিকেন বার্গার ( ৫০ টাকা), ক্রিসপি ফ্রাইড চিকেন (২০টাকা), চিকেন স্প্রিং রোল (২০ টাকা), চিকেন পাস্তা (৫০ টাকা)। এছাড়া মুরগির মাংসের বিভিন্ন পরিমাণের মোমোও পাওয়া যায় এই ফুড কার্টে। যেখানে ৩ পিস মোমোর দাম ৬০ টাকা, ৫ পিস ৯০ টাকা এবং ১৪০ টাকা।

একটু এগুলেই দেখা যাবে, নানা উপকরণের সালাদের সঙ্গে পরিবেশন করা হচ্ছে মশলাদার মটর ভুনা। প্রতি ঠোঙ্গার দাম রাখা হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকা।

এরপর রয়েছে তরুণীদের বিশেষ প্রিয় পানিপুরীর কার্ট। যেখানে নানান পদের তরল পুর সহকারে পরিবেশন করা হচ্ছে খাবারটি। দিল্লির পানিপুরীর ধাঁচে বানানো এই খাবারে পুর হিসেবে পরিবেশন করা হচ্ছে তেঁতুলের টক, তেতুল মিষ্টি টক, পুদিনার টক, পাঁচ মিশালী, বোম্বাই মরিচের টক ও দই টক। প্রতি প্লেট পানিপুরীর দাম রাখা হচ্ছে ৩০ টাকা।

সামনের দিকে এগুলেই দেখা মিলবে আলু স্প্রিং রোলের। একটি স্প্রিং কাটার মেশিন দিয়ে প্রতিবার একটি আলুকে প্যাঁচিয়ে কাটা হয়। তারপর সেটিতে বিভিন্ন রকমের মশলা মিশিয়ে ডুবো তেলে ভাজা হয় প্যাঁচানো আলুকে। প্রতি স্টিক ৩০ টাকা দামের এই খাবার বর্তমানে বেশ সাড়া ফেলেছে।

শরতের শেষে টানা বৃষ্টিতে ইতোমধ্যে শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। তাই গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় পিঠাসমূহের দেখা মিলছে সেখানে। এর মধ্যে রয়েছে ভাঁপা পিঠা ( প্রতি পিস ১০ টাকা) , চিতই পিঠা ( প্রতি পিস ১০টাকা), লাড্ডু পুলি ( ২০টাকা), ডালের মুক পাক্বন (২০টাকা), মালপোয়া (২০টাকা) ইত্যাদি।

দেশীয় পিঠার পাশাপাশি সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে খাবারটি সেটি হলো মোমো। তিব্বতী এই খাবারটির জন্য কাজির দেউড়িতে রোজ ছুটে আসেন ভোজন রসিক নগরবাসী। মাংসের পুর দিয়ে বানানো কাঁচা ময়দার পুরীকে ভাঁপে রেখে বানানো হয় মোমো। বিভিনড়ব রকম কেচাপ সহকারে পরিবেশন করা হয় এটি। এটির রন্ধন কৌশলের কারণে বেশ স্বাস্থ্যসম্মত এই খাবারটি। যেকোনো বয়সের মানুষের কাছেই ইতোমধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এই খাবারটি। তবে তিব্বতী মোমোতে এসেছে কিছুটা বাঙালিয়ানা। সেদ্ধ কিংবা ভাঁপে রাখা খাবার যেহেতু বাঙালির ধরণ নয়। বাঙালির খাদ্যাভাসকে মাথায় রেখে বিক্রেতারা পরিবেশন করছেন ফ্রাইড মোমো। ভাঁপের বদলে তেলে ভেজেও এই মোমো পরিবেশন করা হচ্ছে। ৫ পিসের প্রতি প্লেট মোমোর দাম রাখা হচ্ছে ১০০ -১৫০টাকা। ৮ পিসের প্রতি প্লেট ২০০ টাকা।

মোমোর পাশাপাশি কেউ কেউ বিক্রি করছে ভারতীয় ডোসা। ডাল এবং চালের মিশ্রণকে পাতলা রুটির আকারে নামমাত্র তেলে মচমচে করে ভাজা হয়। পরে বাঁশের আকারে ভাঁজ করে নানা রকম চাট্নি দিয়ে পরিবেশন করা হয় খাবারটি। প্রতি প্লেট ডোসার দাম রাখা হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা।
ডোসার পাশাপাশি যেই ভারতীয় খাবারটির বেশ জনপ্রিয় হয়েছে সেটি হলো ছোলা মাসালা। এই খাবারের যে প্রধান উপকরণ সেটিকে বলা হয় কাবুলি ছোলা। নামে ছোলা হলেও দেশীয় ছোলার চাইতে আকারে কয়েকগুণ বড় এই ছোলাটির স্বাদও কিছুটা ভিন্ন। তবে সুস্বাদু।

বিকেলের ক্ষুধা মেটাতে লুচি দিয়ে এই ছোলা মাসালা খাওয়া হয়। প্রতি প্লেট ছোলা মাসালার দাম রাখা হয় ৪০ টাকা , এর সাথে লুচি প্রতি পিসের দাম ৫টাকা, ছোলা মাসালার সাথে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মিক্স ছোলা আঁচারী ( ৬০ টাকা) ও চিকেন আঁচারী গোস (৪০ টাকা)।

ভর্তা, চাটনি কিংবা আঁচারের জন্য বাঙালির উন্মাদনা যেন অন্য মাত্রার। প্রায় ১০ রকমের কাঁচা ফলও সবজি উপাদানকে হামান দিস্তায় ভর্তা বানিয়ে লবণ তেঁতুল হালকা চিনি বা গুঁড় মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে মি´ ভর্তা। এই ভর্তা মুখে পুরেই বাঙালি যে কেউ হবেন স্মৃতিকাতর। প্রতি কাপ ভর্তার দাম থাকছে ২০ টাকা।

ঝাল মুড়ির পাশাপাশি কাজির দেউড়িতে এখন পাওয়া যাচ্ছে কড়ই মাখা। সেদ্ধ চালকে ভেজে সেই ভাজা চালকে মুড়ির মতো নানা পদের সালাদ, আঁচারের তেল ইত্যাদি সহকারে মিশিয়ে পরিবেশন করা এই খাবারটির দাম ২০ থেকে ৩০টাকা।

এতো এতো ঝাল, তেলে ভাজা ও মশলাদার খাবার খেয়ে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে সুস্বাদু ফলের রসে তৃষ্ণা মেটানোরও সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লেবুর জুস (৩০ টাকা), লেবু পুদিনার জুস ( ৩০ টাকা), লেমন দধি জুস ( ৫০ টাকা) ,প্লেইন লাচ্ছি ( ৫০ টাকা), চকলেট লাচ্ছি ( ৬০ টাকা), পেঁপে জুস ( ৪০ টাকা), পেঁপে লাচ্ছি ( ৫০ টাকা) , অরেঞ্জ লাচ্ছি ( ৭০ টাকা), মাল্টা জুস ( ৮০ টাকা, বেল জুস ( ৫০ টাকা), ম্যাংগো জুস ( ৫০ টাকা ), কাঁচা আমের জুস ( ৪০ টাকা), বেনানা জুস ( ৪০ টাকা), স্ট্রবেরি জুস ( ৬০ টাকা)। এছাড়া রয়েছে বাংলার চিরাচরিত আঁখের রস, যা প্রতি গ্লাস ১০ থেকে ২০ টাকা দামে মিলছে।

ফলের রস খাওয়ার বেশ আগ্রহ না থাকলে এক কাপ চা তো সকলে লুফেই নেন। তবে তা কেবল সাদাসিধে দুধ চা বা রং চা নয়। কাজির দেউড়িতে মিলছে মালাই চা (২০টাকা), বাদাম চা ( ৪০ টাকা) , কাজু বাদাম চা ( ৫০ টাকা) , ক্ষীর মালাই চা ( ৬০ টাকা), পেস্তা বাদাম চা ( ৬০ টাকা), জাফরান স্পেশাল চা (৬০ টাকা), চকোলেট চা ( ৮০ টাকা) ও হট কফি ( ৪০ টাকা)।

খুব বেশি চা প্রেমী না হলেও শখ করে পান খাওয়ার ইচ্ছা হয়-ই। সেই পানেরও রয়েছে বাহারি আয়োজন। এর মধ্যে নরমাল শাহী পান ১০ টাকা , স্পেশাল শাহী পান ২০ টাকা, লাহোরি শাহী পান ৪০ টাকা ,ফায়ার শাহী পান ৮০ টাকা, বেনারস শাহী পান ১৫০ টাকা।

এছাড়া বাঙালির প্রিয় বাদাম, বুট, ছোলা তো থাকছেই। এসব বাহারি খাবারের কারণে কাজির দেউড়ি হয়ে উঠেছে ভোজন রসিকদের প্রিয় স্থান। সপ্তাহের সাত দিনই বেশ জনবহুল থাকলেও ছুটির দিনগুলোতে থাকে বাড়তি চাপ।