করোনা : বাঙালির মূল্যবোধের এসিড টেস্ট

শংকর প্রসাদ দে »

দীর্ঘদিন আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল পারিবারিক মূল্যবোধ প্রশ্নে ভারতবর্ষ বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের অবস্থা উত্তম। ইউরোপে বৃদ্ধাশ্রম এসেছে প্রায় আটশতাব্দী আগে। বাংলাদেশে এটি বড়জোর বিশ বছরের সংস্কৃতি। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এদেশের গ্রামগঞ্জে একান্নবর্তী পরিবার এখনো দেখা মেলে। গ্রাম বাংলার লক্ষ শিশু বড় হয় দাদা-দাদীর নিরাপদ আশ্রয়ে। শেষ বয়সে মা মাবাকে যত্ন নেয় না এমন মানুষের সংখ্যা এদেশে এখনো কম। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর এই মূল্যবোধের ওপর আঘাত এসেছে। বেশ কিছু খবর সংবাদপত্র ও ফেসবুকে দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে।
করোনার আঘাতে উন্নত বিশ্বের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে মরে পড়ে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ। এদের সৎকারে সরকারগুলো হিমশিম খেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদায় দিয়েছে ন্যূনতম সহানুভূতি দিয়ে।
এদেশের পুলিশ বাহিনী নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিল না। এবার একেবারে ভিন্ন চিত্র। পুলিশ বাহিনীকে দেখলাম স্তব্ধ চোখে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লেগেছে। জুনিয়র ভাই, অ্যাডভোকেট ফজলুর, বাড়ী ফেনী, আক্রান্ত হবার কয়েকদিন পর ফৌজদারহাট বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তির পরও বাঁচানো যায়নি। তাঁর লাশ বাড়ি পৌঁছাতেই গ্রামের সব পুরুষ উধাও। কবর খোঁড়ার লোক পর্যন্ত পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে কোনমতে শেষ বিদায় জানালো। আমাদের পাড়ার ডা. সাধন মল্লিকের অসুস্থতা দীর্ঘদিনের। চট্টগ্রাম মেডিকেলে এনে লাভ হয়নি। তার মৃতদেহ পাড়ায় পৌঁছার পর দেখা গেল কেউ শ্মশানে যেতে চায় না। সবার ভয় মেডিকেল থেকে যেহেতু এসেছে, হয়তো বা করোনা ভাইরাস নিয়ে এসেছে। প্রফেসর শফিউল আলম (অ্যাডভোকেট) সাহেবের শাশুড়ি ও সম্বন্ধী দু’দিনের ব্যবধানে মারা গেলেন। তাঁরা মাহাবুবুল আলম চৌধুরীর বিখ্যাত পরিবারের সদস্য হবার পরও গ্রামের কবরস্থানে জায়গা হচ্ছিল না।
উমা রানী দাস ময়মনসিংহের সহকারী জজ। স্বামী ডা. দেবাশীষ দাস করোনায় মারা গেল। গ্রামে শ্মশান দূরের কথা, আড়াই বছরের ছেলের হাত থেকে পাটকাঠি এনে শহরের শ্মশানে মুখাগ্নি করলেন উমা নিজে। ছবিতে দেখলাম পাশে দুজন অপরিচিত স্বেচ্ছাসেবী। ধর্ম, পরিচয়হীন। নেই কোন বাল্যবন্ধু, পাড়াপড়শি, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন। কুমিল্লা হোমনার মাথাভাঙা ইউনিয়নের বিজয়নগর গ্রামে করোনা সন্দেহে এক শিশুর মৃত্যু হলো। গ্রামের মুর্দার ঘাটটি তার জন্য বরাদ্দ হলো না। স্বেচ্ছাসেবীরা জানাজা পড়লেন মুর্দাকে মাটিতে রেখে। বুক কেঁপে উঠল। মাটি ছাড়া এই জগৎ সংসারে আর সব ঠগ, জোচ্চুরি আর ফাঁকিবাজি। ইউএসটিসি হাসপাতালে মদন কুমার সুশীল মৃত্যুবরণ করে ২৪ জুন। মানাজিল ফাউন্ডেশন লাশ নিয়ে ছুটল মদনের গ্রাম বাঁশখালীর পুঁইছড়ি। সংবাদ পেয়ে গ্রামবাসীর এক কথা, এই লাশ যেন গ্রামে না ঢুকে। শ্মশান দেয়া যাবে না। দিতে গেলে মদনের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে। কি আর করা। আল মানাজিলের স্বেচ্ছাসেবীরা গেল বলুয়ার দিঘি শ্মশানে। সেখানেও জায়গা হলো না। অবশেষে কাট্টলী সাগর তীরে দাহ করল মুসলিম যুবকরা। আঙুল দিয়ে বঙ্গবাসীকে দেখিয়ে দিল, মানুষ আগে, হিন্দু কি মুসলিম পরের কথা। এরপরও মন্দির মসজিদ নিয়ে মানুষ মারামারি করে, খুনোখুনি করে। বুঝলাম গত অর্ধশতকে বাঙলার সমাজ জীবনে মুল্যবোধের ধস নেমেছে।
মানুষের আত্মপরিচয় দিন দিন হয়ে উঠেছে সংকীর্ণ। বৃদ্ধ মা-বাবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে নিজের স্ত্রী বা সন্তান-সন্ততি। বাল্যবন্ধু? সে যে ছিল ক্ষণিকের উচ্ছ্বাস। নিকট আত্মীয়? সে কোন ছার। নিতান্ত জীবিকার নৈকট্য অথবা বড়জোর রক্তের হিসেবি সংখ্যা। সহকর্মী? সে তো আরও ঠুনকো। জীবিকার প্রয়োজনে কিছুটা সময় এক সাথে কাটানোর বেশি কিছু নয়। এই আত্মকেন্দ্রিকতা ব্যক্তির নয়, ব্যবস্থার। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এর জন্য দায়ী। আমি টিকে থাকার প্রয়োজনে নিকট আত্মীয় হলেও ঠকাব। এই সমাজে সম্পত্তির হিস্যায় যে তুমুল বিপদ, এতো বেশি আগে ছিল না। আগে অর্থাৎ সামন্তবাদী যৌথ পরিবারে ছিল না। শিক্ষিত ভদ্রলোক নামের অমানুষগুলো গরিব পেলেই ঘুষ খায়। ব্যবসায়ী হলে দামে ঠকায়। গ্রামের আপনজন বা সহজ সরল হলে তো কথা নেই। নীতিবোধটাই এমন যে না ঠকালে কামাই হবে না। আগে শুনতাম যুদ্ধে আর রতিকর্মে নীতির দরকার নেই। সেটি সামন্তবাদী কথা। পুঁজিবাদের কথা হল, কামাই করতে হলে ঠকানোর নীতিতে চলো। যাকে ইচ্ছে তাকে ঠকান-এ সমাজে জায়েজ।
আজ যারা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন, তারা বহু আশা করে এক ঝাঁক তরুণের হাতে মেম্বার, মেয়র আর চেয়ারম্যানি তুলে দিয়েছেন। হঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বুনিয়াদি মুরব্বিদের। এই নব্যনেতারা রাতারাতি হয়ে উঠেছিল করোনা দানব। সরকার গুদাম খুলে দিয়ে বলেছে, জনপ্রতিনিধিরা, যা আছে সব নিয়ে গিয়ে গ্রামের অভুক্ত মানুষদের বাঁচাও। হারামজাদারা নিজেরাই অর্ধেক মেরে দিয়েছে। কিছু দেওয়ার পর যা ছিল তা লুকিয়ে রেখেছে ঘরের মেঝের নিচে। লজ্জা রাখার জায়গা নেই। করোনা সাধারণ মানুষ, মেম্বার, চেয়ারম্যান চিনে না। মৃত্যু প্রত্যেকের পায়ে পায়ে ঘুরছে। তারপরও চুরি, দুর্নীতি আর লোকঠকানোর মানসিকতা প্রমাণ করে গত অর্ধশতকে এমন এক সমাজ গড়েছি, এটাকে সভ্য সমাজ বলা যাবে না। এটা অসভ্যের সমাজ, ঠগবাজের সমাজ, বর্বরের সমাজ।
পাল্টা কথা হলো, এর মাঝেও জীবনের জয়গান আছে। আজ অবধি মৃত্যু সংখ্যায় পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বাগ্রে। এর অর্থ দাঁড়ায় করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে বেশির ভাগ ডাক্তার, নার্স ও আয়ারা আক্রান্ত হয়েছেন। এদের এই জাতি ভুলবে না। অন্যদিকে মনটা একেবারে ছোট হয়ে গেছে, কিছু ডাক্তারের কান্ড দেখে। গত কয়েক মাসে ডাক্তারদের মোবাইল ফোন বন্ধ, প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ। বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালে সেবা প্রায় বন্ধের উপক্রম। চাপাচাপিতে যারা দরজা খুলেছে, বিল নিয়েছে দশগুণ। যারা হাসপাতাল খুলেছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন বেসরকারী হাসপাতালে মানবতার চেয়ে ব্যবসা বড়। আগে মুনাফা, পরে সেবা। অগ্রজপ্রতিম রানা দাশ গুপ্ত সিকদার মেডিকেলে দিন দশেকের বিল দিয়েছেন ১১ লাখ টাকা। তাঁর মতো মানুষকেও ধারকর্জ করে মিটাতে হয়েছে। এতো টাকা দিয়ে কয়জনের চিকিৎসার সামর্থ এদেশে আছে? দেখলাম, গত অর্ধশতকে এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বারোটা বেজেছে, বেসরকারিকরণ আর বিদেশ গমনের ঠেলায়। যে দেশের কর্তাব্যক্তিরা দেশে চিকিৎসা করতে ভয় পায়, সেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা গোল্লায় যাবে। আশ্চর্য হবার তেমন কিছু নেই।
এর মাঝেও মানবতার জয়ধ্বনি আছে। নারায়ণগঞ্জের কমিশনার মাকসুদুল আলম খন্দকার সিনিয়র বন্ধু তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই। ৮৮ টি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে লাশের দাফন/সৎকার করে জয়ধ্বনি করেছেন মানবতার, মূল্যবোধের। জজকোর্ট হাসপাতালে মায়ের মৃত্যুশয্যার পাশে হাসপাতাল চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বললেন, দাদা সামনে লাশ দাফনের মানুষ পাওয়া যাবে না। গড়ে তুলল ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’। যতদূর জানি এই যুবকরা চাঁদা তুলে কবরের জায়গা কিনেছেন, অ্যাম্বুলেন্স কিনেছেন সবই চাঁদার টাকায়। শ’য়ের কাছাকাছি তাদের শেষ মহাযাত্রার পদধ্বনি। আল মানাজিলের তিন ভাই মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করল, হাসপাতাল করবে, অ্যাম্বুলেন্স কিনবে, জাতি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে লাশ নিয়ে ছুটবে কবরস্থান বা শ্মশানে। মায়ের মন ভরে গেল। চট্টগ্রামে এটি শীর্ষ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বিদ্যানন্দসহ করোনা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংখ্যা এখন ডজনের উপরে। ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেককে ফোন করলে পাওয়া যায় শ্মশান বা কবরস্থানে। অথচ আমরা-আপনারা এখন বহালতবিয়তে নিজ নিজ গৃহে থরথর কাঁপছি।
বাঁধভাঙা এইসব আবেগী মনগুলোকে দেখে ভাবি, ‘আশার ছলনে ভুলি’ লাইন বঙ্গভূমে মিথ্যে হতে চলেছে। বরং কবিকে লিখতে হবে, ‘আশার আশায় জেগে থাকি’। আমার প্রিয় একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অনেক পরামর্শ দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এমনটা করবেন না, অমনটা করবেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেছিলাম, এই দেশে শিক্ষিত বলে সার্টিফিকেট পেয়ে গেলেই হলো। এবার তার উপদেশ বণ্টনের পালা। শূন্য থেকে বড়লোক ব্যবসায়ী হলেই হলো। এবার তার বকাঝকার পালা। গ্রামের মানুষ দেখলেই বলে, এটা কর, ওটা কর। বড় আমলার কাছে দেশের মানুষ দেশের জন্য কিছু চাইতে গেলেই কথার ফুলঝুরি। একবারও ভেবে দেখে না এই মানুষগুলোর টাকায় আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যারিস্টার, আমলা বা জজ সাহেব। এদের হরহামেশাই ঠকাই বলে আমি শিল্পপতি, ব্যবসায়ী অথবা আন্তর্জাতিক ঠিকাদার। এই দুর্যোগের মুহূর্তে এবার এদের জন্য কিছু করার পালা। বেঁচে থাকলে উপদেশ ভবিষ্যতে বহু দেয়া যাবে। এখন বাঁচিয়ে রাখার জন্য সচ্ছল ও সুবিধাভোগীরা কে কতটুকু করছি সেটি বড় কথা। বিচারপতি মহোদয় আমার মন্তব্যের জবাব দেননি। কোথায় দু’এক বস্তা খাদ্যবিলি করেছেন এমনও শুনিনি। এরই নাম বাঙালির মূল্যবোধ। আমি নিশ্চিত করোনা সংকটে বাঙালির মূল্যবোধের এসিড টেস্ট হয়ে গেছে।

লেখক : আইনজীবী
ই-মেইল : [email protected]