করোনার চতুর্থ ঢেউ আগেই চলে আসার আশঙ্কা!

দেশের কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না

সুপ্রভাত ডেস্ক »

করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ কোনোরকম সামলে উঠতে না উঠতেই দেশের পরিস্থিতি ফের ‘খারাপের’ দিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উঠেছে। গেল পাঁচ দিন ধরেই সংক্রমণ শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী মার্চ-এপ্রিল নাগাদ করোনার আরেকটি ঢেউয়ের পরিপূর্ণ আশঙ্কা রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে যে হারে জনসমাবেশ করা হচ্ছে তাতে আরও আগেই চতুর্থ ঢেউ চলে আসতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। শীতের মৌসুম হওয়ায় যতধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান হওয়া সম্ভব, সবই হচ্ছে। বিয়ে, পিকনিক, ঘোরাঘুরি, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে স্থানীয় নির্বাচনও। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ, মিছিলগুলোতে অনুপস্থিত থাকছে স্বাস্থ্যবিধি।

এদিকে, গত পাঁচদিন ধরেই করোনাতে শনাক্ত রোগী এবং শনাক্তের হার বাড়ছে। গত ১৮ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, তার আগের ২৪ ঘণ্টায় (১৮ ডিসেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত) করোনাভাইরাসে নতুন রোগী শনাক্ত হয় ১২২ জন আর শনাক্তের হার নেমে আসে এক শতাংশের নিচে। সেদিন শনাক্তের হার ছিল শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ। তবে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেটা বেড়েছে। পরদিন (১৯ ডিসেম্বর) অধিদফতর জানায়, শনাক্তের হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ আর রোগী শনাক্ত হয়েছে ২১১ জন। পরদিন (২০ ডিসেম্বর) ২৬০ জন শনাক্ত আর শনাক্তের হার এক দশমিক ৩০ শতাংশ বলে জানায় অধিদফতর।

এরপর দিন ( ২১ ডিসেম্বর) ২৯১ জন শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়ে অধিদফতর জানায়, সেদিন শনাক্তের হার ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ২২ ডিসেম্বর ৩৫২ জন নতুন শনাক্ত আর শনাক্তের হার এক দশমিক ৮৭ শতাংশ। ২৩ ডিসেম্বর নতুন শনাক্ত ৩৮৫ জন জানিয়ে অধিদফতর জানিয়েছে, শনাক্তের হার ছিল এক দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থ্যাৎ, গত পাঁচ দিন ধরেই করোনায় শনাক্তের হার ঊর্ধ্বগামী।

বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কাও করছেন।

গত ২১ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ওমিক্রন বিশ্বের ৯০টা দেশে ছড়িয়ে গেছে মন্তব্য করে জাহিদ মালেক বলেন, বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়েছে। আমাদের দেশে অনেক মানুষ কক্সাবাজার গেছে, কারও মুখে মাস্ক নেই। রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে, মিটিং মিছিল হচ্ছে, কিন্তু কেউ মাস্ক পরে না। যার কারণে আমরা আশঙ্কা করছি, যেন সংক্রমণ বেড়ে না যায়।

বেসামালভাবে চললে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, `আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। দেশে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নেই, কিন্তু করোনা তো আছে! ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট থেকেও যদি আমরা রক্ষা পেতে চাই, আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মানুষ যেন বেপরোয়াভাবে না ঘুরে বেড়ায় কিন্তু সেটা হচ্ছে। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানগুলো কীভাবে হয়! কক্সবাজারে লাখ লাখ মানুষ যাচ্ছে, কেউ মাস্ক পরছে না। বিয়ে হচ্ছে, কেউ মাস্ক পরছে না। তাহলে সংক্রমণ বাড়ার সুযোগ তো রয়েছে”।

এদিকে, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির সুপারিশে ইতোমধ্যে ১৫ নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সব ধরনের (সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য) জনসমাগম নিরুৎসাহিত করা; পর্যটন স্থান, বিনোদনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল/থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পিকনিক পার্টি ইত্যাদি) লোক সমাগম ধারণক্ষমতার অর্ধেকের মধ্যে রাখা এবং রেস্তোরাঁয় ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম আসনে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে সেখানে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারা করোনাতে আরেকটি ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন। মানুষ কথা শুনছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। কিন্তু করোনা তার কাজ ঠিকই করে যাবে মানুষ না করলেও। সংক্রমণ কমে গেছে, মানুষের ভেতরে ‘রিলাক্টেন্ট’ যে ভাব এসেছে, সেটাই আবার সর্বনাশের দিকে টেনে নিচ্ছে বাংলাদেশকে-বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোথাও স্বাস্থ্যবিধি নাই। এখনও মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে। শহর কিংবা গ্রাম কেউ মাস্ক পরছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতর নির্দেশিত ১৫ দফার মধ্যে রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহনের জন্য যেসব নির্দেশনা ছিল সেগুলোর বালাই নেই।‌’

স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়ি করতে কেবল নির্দেশনাই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন এই মহামারি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হবে। কাউকে একক দায় দিয়ে লাভ নেই। নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ, কমিউনিটি সেন্টার, রেস্টুরেন্টসহ যেসব জায়গায় ভিড় হচ্ছে; সেই কর্তৃপক্ষকে দায় নেওয়ার কাজটা করাতে হবে সরকারকে।

স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই করোনার আরেকটি ঢেউয়ের আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আরেকটি ঢেউয়ের পরিপূর্ণ আশঙ্কা রয়েছে, আগামী বছরের মার্চ এপ্রিল নাগাদ। সেটা আগামী বছরের মার্চ অথবা এপ্রিলের দিকেও হতে পারে বা তারও আগেও হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘গতবছর এপ্রিলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে হয়েছিল থার্ড ওয়েভ। এর আগে আলফা-বিটা দিয়ে হয়েছিল সেকেন্ড ওয়েভ। মাঝখানে কমে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা শূন্যে নামেনি। তাই আমি তৃতীয় নয়, চর্তুথ ওয়েভের আশঙ্কা করছি।’

আর কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘মানুষের এই গা ছাড়া ভাব দেশের জন্য আরেকটি বিপর্যয়ের কারণ হবে কয়েকদিন পর। মানুষের মাস্ক থাকার কথা নাক-মুখ ঢেকে। কিন্তু হয় থাকে থুতনিতে, নয়তো থাকে ব্যাগে। আর মাস্ক যদি মাস্কের জায়গায় না থাকে, তাহলে ভাইরাসতো ঢুকবেই- এটাই নিয়ম এবং এটাই হবে।’

অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘সংক্রমণের আরেকটি ঢেউ খুব শিগগিরই আমরা দেখতে পাবো, মানুষ যখন অবাধ্য হয়, তখন প্রকৃতি সেটা বুঝিয়ে দেয়।’

বাংলা ট্রিবিউন