করোনাকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতি

অমল বড়–য়া»

বৈশ্বিক মহামারি করোনা কেবল মানুষের স্বাস্থ্যের উপর থাবা বসায়নি একইসাথে মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপরও অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্খিত ছাপ রেখে চলেছে। করোনার প্রভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেমন টালমাটাল হয়ে পড়েছে তেমনি ভাবে অর্থনীতিও তার গতি ও ধারাবাহিকতা হারিয়ে হয়েছে অনিশ্চিত ও ভঙ্গুর। ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় দেশে। রোগের ত্বরিৎ সংক্রমণের বিস্তার রোধে ২৬ মার্চ ২০২০ সাল থেকে সরকার লকডাউন ঘোষণা করে। লকডাউনে কার্যত মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা। ব্যাহত হয় আমদানি রপ্তানি। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। লাখো মানুষ চাকরি হারায়। দেশের মানুষের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। থমকে যায় অর্থনৈতিক কর্মকা-। ফলে এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিও স্থবির হয়ে পড়ে। স্থবির হয়ে পড়ে দেশের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ অর্থনৈতিক খাতসমূহ। যথা কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত।
কৃষিখাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শস্য উৎপাদন, প্রাণী সম্পদ ও মৎস্য সম্পদ। গবেষণা বলছে, এই সকল কৃষিখাতে স্বল্পমেয়াদে উৎপাদন হ্রাস না পেলেও দেশি ও বিদেশি অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকার কারণে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের উপর নি¤œমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করে। এর ফলে অর্থনীতিতে প্রতি দিন প্রায় দুইশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। শিল্পখাতে বিশেষ করে উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে প্রতিদিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সেবাখাতে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বেচা- কেনা এবং জরুরি সেবা ব্যতিত এই খাত মূলত অবরুদ্ধ। পর্যটন, হোটেল, মোটেল, রেষ্টুরেন্ট, যোগাযোগ (সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান), রিয়েল ইষ্টেট সকল প্রকার সেবা স্থবির হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি সেবায় একপ্রকার অচলাবস্থা বিরাজ করেছে। সব মিলিয়ে সেবা খাতে ক্ষতির পরিমাণ দিনে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতে গড়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
করোনা মহামারিতে অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে। সংকৃচিত হয়ে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য। করোনার এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারকে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও খাদ্য সুরক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার এক লক্ষ বিশ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। যা বিশ্বের অপরাপর দেশে ঘোষিত প্রণোদনার মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তায় সরকার ঘোষিত এই ঋণের সুদের হার অনেক কম। কম সুদের এই প্রণোদনা হলো দেশের সংকটকালে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার ক্ষেত্রে সরকারের একটি সাহসী পদক্ষেপ।
সংকটকালে বাংলাদেশেকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছে কৃষি ও রেমিট্যান্স। কৃষকরা তাদের খাদ্য-শস উৎপাদন অব্যাহত রেখে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করেছে। এই সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্সের প্রবাহে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতি হয়েছে গতিশীল। তাই বলা যায় করোনাকালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনন্য। করোনা মহামারির মধ্যে প্রবাসী আয়ের নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। যা গত বছরের পুরো সময়ের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের মার্চে গত বছরের মার্চের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স বেড়েছে। গত বছর দেশে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ১৮ লাখ (২১.৭৪ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে প্রবাসীরা। যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩৪০ কোটি ৯৬ লাখ ডলার বেশি। রেমিট্যান্সের উপর ভর করেই বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
মহামারির কারণে দেশের রপ্তানি আয় কমেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করে ২ হাজার ৮৯৩ কোটি ৮৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ০.১২ শতাংশ কম। মার্চ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩০৭ কোটি ডলারের পণ্য। যা গতবছরের মার্চ মাসের তুলনায় ১২.৫৯ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ থেকে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫৩ কোটি ডলার বা ১৩ হাজার ৫ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১৬৭ কোটি ডলারের পোশাক। সেই হিসাবে রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি ১ দশমিক ৭০ শতাংশ কমেছে। এই সময়ে ৭৯৪ কোটি ২২ লাখ ডলারেরর পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি-মার্চে রপ্তানি হয়েছিল ৮০৭ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের পোশাক। যদিও চলতি বছরের চার মাস শেষে রপ্তানি প্রায় ২৩ শতাংশ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম ৯ মাসে দেশ রফতানি খাতে আয় করেছে ২ হাজার ৮৭২ কোটি ডলার। গত ৯ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৪৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ সময়ের মধ্যে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় ০.০৬ শতাংশ বেশি আয় করেছে। গত বছর এপ্রিলে কারখানা বন্ধ ছিল। এ বছর লকডাউনেও পোশাককর্মীরা রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক কারখানা সচল রেখে রপ্তানিতে ধাক্কা লাগতে দেয়নি।
তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সরকারের লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। গত লকডাউনে মার্কেট, শপিংমল, দোকানপাট বন্ধ থাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তখন প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৭৪ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। অনেকে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ঈদ উপলক্ষে দোকানপাট ও মার্কেট খুলে দেয়ায় ক্ষতি কিছুটা লাঘব হয়েছে। ঔষধ শিল্পে উৎপাদন ও বিপণন স্বাভাবিক আছে। করোনার এই সংকটকালেও শেয়ারবাজার ছিল উর্ধ্বমুখী। চলতি বছরের মে মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ডিএসই’র মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। লকডাউনের ছয় সপ্তাহে ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
কৃষি খাতে ধান, গম ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন অব্যাহত আছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৩.৩৫ শতাংশ। কৃষিখাতে মোট কর্মসংস্থান প্রায় ৩৮ শতাংশ। কৃষিখাত ক্ষুদ্র হলেও তা হচ্ছে খোরাকি অর্থনীতি। মোট জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশ সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি দ্বারা উপকৃত হয়। তাছাড়া কৃষির মতো স্থায়ী সম্পদ থাকায় মানুষ আর্থিকভাবে অনেক বেশি নিরাপদ মনে করে। খাদ্য উৎপাদন, প্রণোদনা, রেমিট্যান্স, রপ্তানি বৃদ্ধি, আভ্যন্তরিণ চাহিদা ও পুনরায় খোলা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
করোনা মহামারিতে বৈশ্বিক নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে চলতি হিসাবে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল প্রায় ২৬৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। ১৭ মে ২০২১ মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে ব্রিফিং এ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। আগের মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৪ ডলার। মাথাপিছু আয় ৯ শতাংশ বেড়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) ছিল ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। তা এখন হয়েছে ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তাই জিডিপিও বেড়েছে।’ আইএমএফের তথ্য মতে, মহামারি সত্ত্বেও বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বে তৃতীয় ও এশিয়ায় প্রথম স্থানে থাকবে। করোনার কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৩০ শতাংশ। বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৪০ শতাংশ। দেশের মানুষ অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব কাটিয়ে আগের অবস্থানে ফিরতে সচেষ্ট। ব্যবসা ও চাকরি হারানোর কারণে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে চেষ্টা করছে জনগণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার কর্তৃক ঘোষিত বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতিকে সহায়তা করেছে। আবার অনেকে বলেন, ‘করোনা সংকট মোকাবেলায় সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজটি যথাযথ ব্যবহার হয়নি। বেশি বিপাকে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উদ্যোক্তরা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) ব্যবসায় প্রণোদনা প্যাকেজ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরো সক্রিয় ও উদ্ভাবনী ভূমিকা থাকতে হবে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ যে বড় ধরণের চাপে পড়েছিল, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে তা হবে না। আমরা একটি সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করেছি এবং আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সেটি অনুসরণ করছি। আমি মনে করি না যে আমরা কোথাও আটকে যাব।’ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে সঠিক পথে রাখার জন্য সরকারের উচিত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, দরিদ্র মানুষদের সামাজিক সুরক্ষার বলয়ে নিয়ে আসা, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রাজস্ব ও বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।