ওয়েলস

সঞ্জয় দাশ »

আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে তাদের বাসায় যাওয়া হতো। সে সুবাদে আলাপ, ক্রমে মুগ্ধতা। অকস্মাৎ সেই মুগ্ধতায় যবনিকা। যবনিকা ঠিক বলা যাবে না, পোড়খাওয়া বাস্তবতায় এক লহমায় সব ছিটকে গেল আরকি। দিন-রাতের কোনো বালাই নেই, যখনই মন চায় বন্ধুর সাথে দেখা করার ছুঁতোয় মুহূর্তের মধ্যে তাকে দেখে আসা … সে কি উন্মাদনা।
কোভিডের সময়কালে অকস্মাৎ মেসেনজারে তাকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে ছিল অপার বিস্ময়। দুজনই চমকে গিয়েছিল সেদিন অপ্রত্যাশিত অথচ কী অদ্ভুত নিয়তির খেলায়। এও বুঝি সম্ভব! অনেক খুঁজেও তাকে নেট দুনিয়ার কোথাও মেলেনি। অতঃপর বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল শরীরে। কোভিডকালে ঘরবন্দি সময়ে যখনই ও প্রান্ত থেকে ফোন আসতো, তখনই সব ভুলে শুধু রাজ্যের কথার ফুলঝুরি। ক্রমে তা কমতে থাকে। এ কমতে থাকার ফাঁকটা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। এক সপ্তাহের মধ্যে ওর ফোন না আসলে সে কি উন্মাদনা আর ছেলেমানুষী। এসবের মধ্যে একধরনের তৃপ্তিকর অনুবর্তন থাকে। তাই হয়তোবা ছেলেমানুষীগুলোও মুগ্ধতার প্রলেপ বুলিয়ে রাখে গহিনে কোথাও।
সে নিজেও বলতো, রোহিত, ওসব ছাড়ো, যা হওয়ার নয় তা নিয়ে অযথা কেন উল্লম্ফন করো। ম্যাসেনজারে যখন মিস্ড কল দেখতে পাই, তখনই শুরু হয় অন্যরকম এক দ্যোতনার। এ দ্যোতনার দ্যুতি তাকে হয়তোবা বাঁচিয়ে রেখেছে এ মর্তে। সত্যমিথ্যার এ দুনিয়ায় একটু অন্য বাস্তবে ঘুরে এসে যদি অপার্থিব মুগ্ধতার সাক্ষাৎ মেলে তাহলে যন্ত্রণাময় অনুবর্তনের ইতি ঘটবে, এতে সন্দেহ নেই। রোহিত তাকে ডাকতো ‘ওয়েলস’। কোনো এক আবেগময় বিকেলে তার মুখোমুখি বসে চা খেতে খেতে তার মুখ থেকে এ নামটা শুনলেই এক অনাবিল মুগ্ধতায় চোখ বুজতো ওয়েলস। সেই রোশনাই যখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন মন চলে যায় অপার্থিব কাননের চৌহদ্দিতে। রাজ্যের বিবমিষা থেকে মুক্তি পেলে ওয়েলস-এর চোখ বোজা সেই চাহনি ভেসে ওঠে। পোড়া চোখে ঘুম আসে না … কিছুতেই মন বসে না … ঠিক তখনই ভেসে ওঠে কবেকার বিস্মৃতির অতলে ডুবে থাকা জাদুকরি সম্ভাষণ।
‘শুন, তুমি রাতে দেরি করে বাসায় ফিরবে না। দশটার মধ্যেই ফিরবে। আজ দুপুরে এখানে খেয়ে যাবে।’ এখনো কথাগুলো যখনই ভেসে আসে গহিনে কে যেন হাতুড়ি পেটাতে থাকে। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। সেদিন তার বাসায় এসে হাজির ওয়েলস। রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে যখন তাকে দেখছিল রোহিত, তখন বাসার বারান্দায় ছিল বেলিফুল। থোকা থোকা বেলিফুলের নির্যাস রুমজুড়ে সুগন্ধির মেলা বসিয়েছিল যেন। এখন তেরো নদী সাত সমুদ্র দূরে থাকা সেই ওয়েলসকে যখনই মনে পড়ে শেষ বিকেলে তখন ভর করে মায়াবী লোলুপতা।
আজ বিকেলটা সেজেছে অন্য আলোয়। দিন শেষে কম্পমান আলোয় থেকে থেকে বাতাসের দুলুনি তার চুলগুলো উড়িয়ে নিচ্ছে কবেকার জীর্ণ প্রাসাদের সামনে থাকা অশ্বথ গাছের মগডালের মতো। পাশাপাশি বসে থাকা রোহিত-ওয়েলস এর মাঝখানে দূরত্ব নেই। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গাইতে আপন মনে খেই হারিয়ে ফেলছিল ওয়েলস। গান গাওয়া শেষে সে কিছু না বললেও ‘অসাধারণ’ বলে তার মাথায় হাত রাখে রোহিত।
‘এক সময় শিল্পকলায় গাইতাম। সবাই আমার খুব প্রশংসা করতো।’ এ কথা বলে আড়চোখে তাকায় রোহিতের দিকে। খেই হারানো রোহিতও খানিক আনমনে তাকিয়ে থাকে। সেই তাকিয়ে থাকায় ছিল বিস্ময়। রিকশায় যেতে যেতেও কথা হয় টুকটাক।
ঘুমটা ভেঙে গেল সেই সাত সকালে। আজ হঠাৎ ২২ বছর পর এসব স্বপ্ন দেখার মানে কি। প্রচ্ছন্ন অতীতকে ভুলতে পারে না রোহিত। অথচ দিব্যি সংসার নিয়ে মহাব্যস্ত ওয়েলসের এখন সময়ই নেই তাকে ফোন করার। তার ভাষায় জীবনকে উপভোগ্য করে নিতে হয়। না হলে থমকে যাওয়া জীবনে রিদম বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু তার এসব কথায় যুক্তি খুঁজে পায় না রোহিত। কিভাবে সম্ভব একটা কৃত্রিম জীবনকে গোছানোর। এ প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে গহিনে। রোহিত জানে, মানুষ বেঁচে থাকে তার মুগ্ধতা নিয়ে। বাটালি হিলের সুউচ্চ চূড়ায় রাতের শহরকে মনে হচ্ছিল তারার মেলা। সেই তারার মেলায় ওঠে আসে নিষ্কলুষ অতীত। দূর বাতির আবছা আলোয় ভেসে ওঠে কবেকার ছাইভস্ম। নিকষ অন্ধকার ঘুপচিতে ওয়েলস ও সত্তারা ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসে। ওখান থেকে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। সারা শরীরে লেপ্টে ছিল মধুরেণুর মতো প্রচ্ছন্ন অতীত। এই অতীত শরীরে বিদ্যুৎ চমকের মতো শিহরন জাগানিয়া দ্যোতনা ছড়ায়। দূর অতীতকে মনে হয় সোনালি রোদ্দুর। এ রোদ্দুরের ছোঁয়া গায়ে মেখে অনেক দূর যাওয়া যায়।
সময়টা বিকেল। কোনো এক বৃহস্পতিবার মেহেদীবাগের রাস্তা ধরে এক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন রোহিত। ওদিকটায় একটা গলির দিকে চোখ পড়তেই আর একদফা দূর অতীতের ভাবালুতা তাকে জাপটে ধরে অকস্মাৎ। যেই ভাবা সেই কাজ। অগত্যা অনুষ্ঠানে না গিয়ে সোজা হাঁটা ধরলেন রোহিত সেই গলির দিকে। একেবারে শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটা চারতলা কি পাঁচতলা ভবন। রোহিত থমকে পড়লেন। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাড়িটির দিকে। সেই নব্বই দশকের শেষের দিকে যখন খুশি তখন একবার ঢুঁ না মারলে যেন কিছুই ভালো লাগত না। চারতলায় ওঠে কলিংবেল টেপে কেউ একজনের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে থাকতো সে। যিনি দরজা খুলতেন তার চোখে থাকতো মুগ্ধতার হাতছানি। চোখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে সে বলতো ‘কেমন আছো ওয়েলস’। মিষ্টি একটা সম্ভাষণে তাকে ডেকে রাজ্যের কথা শুরু হতো। এর মধ্যে কেউ অহেতুক প্রবেশ করতে চাইলেও সেসবের থোড়াই কেয়ার করতো ওয়েলস। দু’জনের এই গল্প চলতো রাত অব্দি। রোহিতের যেন ফেরার তাগিদ নেই। তাকে রাতে না খাইয়ে কিছুতেই যেতে দিতে চাইতো না। অনেক সময় উপদেশও দিতো ‘শোন রাত দশটার মধ্যেই বাসায় ফিরবা। বাবা-মাকে চিন্তায় রাখবা না।’ মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব কথা শুনে যখন তার বাসায় ফেরা হতো তখন চন্দনপুরার গলিটা হয়ে যেত কোনো এক নিঝুমপুরী। বাসায় ফিরে আলগোছে লনে গিয়ে মাটিতে বসেই একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকতেন রোহিত। ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজতো ৯০ দশকের বহুল আলোচিত একটা ব্যান্ডের গান। একেবারে শেষ রাতের দিকে ঘুমুতে যাওয়া রোহিত সফেদ বিছানায় গা এলিয়ে দিতো।
ডাইনিং টেবিলে বসে দেয়ালের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকা রোহিতের যেন বোধশক্তি লোপ পাচ্ছে ক্রমশ। কোনো ভাবলেশ নেই। গত ক’দিন ধরে নিজের এই অদ্ভুত আচরণটা খেয়াল করলেও কিছুতেই সম্বিৎ ফেরাতে পারছিলেন না। ওয়েলস-এর সঙ্গে যোগাযোগ আগের চেয়ে কমেছে। এক সময় ওষুধের মতো কাজ দিতো, যখন তার ফোন আসতো। সব কাজের মধ্যেই একটা গতিময় নির্যাস থাকতো। বছর দুয়েক থেকে এর ব্যতয় ঘটছে। বিষয়টা নিয়ে যখন তার সাথে কথা হয়, সে কেবলই বলে ‘তোমাকে কিছু না কিছু একটা কাজ নিয়ে থাকতে হবে। নিজের গতি নিজেকেই ফিরিয়ে আনতে হবে।’ অথচ এসব করেও কোনো ফল পায়নি সে। ভিন্ন এক দেশে থাকেন ওয়েলস। ওদের দেশে রাত তো এখানে দিন। আর রাতদিনের এই ব্যবধান দূরত্বটাকে প্রকট থেকে প্রকটতর করেছে। কী এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে তার। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত যখন রোহিত শুনত তন্ময় হয়ে যেতো। জাদুকরি কণ্ঠের সেই রেশের অনুরণন নিয়ে অনায়াসেই দিন চলে যেতো। আর এখন অনেক-অনেক বিষণ্নতা তাকে ঘিরে ধরেছে। গতানুগতিকতার ধারাবিরোধী রোহিতের কাছে অহেতুক কাজ নিয়ে মেতে ওঠার কোনো তাগিদ নেই। ওয়েলস-এর গাওয়া সেই সম্মোহনী সঙ্গীতও এখন উবে গেছে কর্পূরের মতো। সে কি বদলে গেছে!
একটা কবিতা পড়ার পর থেকেই মূক-বধিরতা তাকে পেয়ে বসে। এ কবিতার প্রতি ছত্রেই নিরালম্ব শূন্যতাকে ধরে স্তব্ধতা আকীর্ণ সময়ের বেড়াজালে বন্দি হয়ে আছে রোহিত। বন্ধ্যা সময়ের পদাবলি পেরিয়ে ফের হয়তো সুরের মূর্ছনায় তাকে মাতিয়ে তুলবে ওয়েলস। মুগ্ধতাবঞ্চিত রোহিতের এখন গ্রহণ চলছে।
না শীত না গরম। এমন একটা সময় কিছু ভালো লাগার কথা নয়। এরপরও বাইরে রোদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে অনেক আগে থেকেই নিজেকে গোছানো উচিত ছিল। অথচ কি আশ্চর্য নির্লিপ্ততায় এত্তগুলো সময়ের অপচয়ের যন্ত্রণা এখন। জীবনের প্রান্তিক এ সময়ে এসে নতুন করে কিছু করাও সম্ভব হয়ে উঠছে না। মাথার ভেতর কিছু কাজ করছে বলে মনে হয় না। এলোমেলো চিন্তাভাবন উঁকি দিচ্ছে। গালভর্তি আধপাকা দাড়ি-গোঁফ স্থূলকায় এক শরীর এলিয়ে দেয়া রোহিতের কিছুই মনে ধরছে না। কত কথা জমে যায়, বলা হয় না কিছুই। দিনের পর দিন জমতে থাকা কথামালার বহর নিয়ে অপেক্ষায় থাকা ্েরাহিতের এখন চলছে মধ্যবয়সের অঘ্রান। জীবনের নানা ঘটনা পরম্পার উপলব্ধিগুলো কখনো বাক্সময়, কখনো বা ভোঁতা হয়ে ধরা দেয়। ইদানিং গান শোনাও ঠিকমতো হচ্ছে না। তাহলে কি সময়ের চিড় ধরেছে মনে।
অনেকদিন ধরে সময়টা ভালো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দীর্ঘ একটা কথোপকতন প্রয়োজন ছিল। এ কথোপকতন মনকে প্রফুল্ল রাখে। কাজে গতির সঞ্চার করে। ওয়েলস-এর কাছ থেকে এমন আশা করাটা রোহিতের জন্য কোনো ব্যাপার না হলেও বিপরীতজনের কাছে তা ভিন্ন। মাঝে-মধ্যে মুডটা অকারণে তেতে ওঠে। কী নিদারুণ সঙ্গবিবর্জিত রোহিত আজ ক্ষণে-ক্ষণে ভাবান্তরিত হতে লাগলো। এই ভাবান্তর তার একান্ত নিজস্ব। আসলে মানুষের কাছে আশা করাটা এক ধরনের পাগলামি, আবার বোকামিও বটে। এদিকে পোড়া চোখে রাতের ঘুমও হারাম হয়েছে। সহজে ঘুমটা আসে না। অথচ তার প্রেসার। এসব কিছু মাথায় না রেখেই অগোছালো রোহিত দিন দিন কেমন নিষ্প্রভ থেকে নিষ্প্রভতর হচ্ছে। এটার জন্য কি ওয়েলস দায়ী? এমন অন্তহীন প্রশ্নে কিছুটা হকচকিয়ে যাওয়া রোহিত আসলে ভেবে পায় না আসলে কি দায়ী? যে বিবমিষা মনকে ক্ষরণ করতে থাকে তাকে বিদেয় দেয়া সমীচীন নয় কী? এমন আত্মবিশ্লেষণে ক্রমে খাবি খেতে থাকে রোহিত। ওয়েলস তো কবেই বলেছিল, ‘তোমার রিদম তোমাকেই ক্রিয়েট করতে হবে। তুমি আসলে দুঃখ নিয়ে বিলাস করো। এমন কিছু মানুষ থাকে যারা কেবলই দুঃখবিলাসিতায় লিপ্ত থাকে।’ সেদিন তার ওই কথাটা তেমন ভালো লাগেনি রোহিতের। সে কেন দুঃখবিলাস করবে? এটা আবার কেমন কথা!
কিছু ছবি জৌলুশ হয়ে ধরা দেয় সংগোপনে। আবার কিছু বিরক্তির উদ্রেক করে। জৌলুশ হয়ে ধরা দেয়া ছবিগুলো এক লহমায় মনে গেঁথে যায়। মনকে সাজাতে ইচ্ছে করে। কিছু মুখশ্রী আছে যেসব দেখলে থুতু ছিটাতে মন চায়। মনের গহিনে প্রলেপ ফেলে দেয়া সেই জৌলুশময় ছবিগুলোই অবচেতনে কল্পফানুসের জাল বুনতে থাকে। ক্রমে একটা জগত তৈরি হয়ে যায়। এ জগতের প্রতি তৈরি হয় মায়া। আর মায়ার বিভ্রমেই বাড়তে থাকে ইল্যুশন। এক সময় সেই ইল্যুশন ছোবল দিতে থাকে বিষধর সর্পের মতো। আর বেরুনোর কোনো পথ খোলা থাকে না। তেমনি ওয়েলস এক কাল্পনিক ফল্গুধারা সৃষ্টি করে রেখেছে মনে। তার প্রতীতি থেকে বের হওয়া যায় না বা বিষয়টি এত সহজও নয়। অবসেশন ও পরাবাস্তব জাদু নিয়ে শিল্পের কারবার যখন আবর্তিত হতে থাকে, তখন থাকে শুধু ঘোরলাগা বিস্ময়।