ওই মহামানব আসে

প্রফেসর ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী »

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে/আজি হতে শতবর্ষ পরে…’। কবি স¤্রাটের ‘১৪০০ সাল’ কবিতা পড়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন ‘আজি হতে শতবর্ষ আগে/ কে কবি স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদের শত অনুরাগে/আজি হতে শতবর্ষ আগে’। কবিগুরু কবিতার শেষের অংশে লিখেছেন ‘এখন করিয়াছে গান নতুন কবি/তোমাদের ঘরে…’
কবিগুরু সভ্যতার সংকটে লিখলেনÑ “আজ আশা করে আছি পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে আসবে। মানুষের চরম-আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্ব-দিগন্ত থেকেই” [সভ্যতার সংকট, কালান্তর,২০৮]। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আরেকটি কবিতায় লিখেছেনÑ ওই মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে../ উদয় শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়…[সূত্র: কালান্তর,পৃষ্ঠা নং ২০৯]।
কাজী নজরুল ‘বাঙ্গালীর বাঙ্গালা’ প্রবন্ধে লিখেছেনÑ‘বাঙালিকে বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এক মন্ত্র শোনায়। এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির- আমাদের’ আর ‘এই আমার মা ’ কবিতায় উল্লেখ করেছেনÑ ‘পদ্মা-মেঘনা বিধৌত পূর্ব দিগন্তে তরুণ অরুণ বীণা বাজে তিমির বিভাবরী অন্তে’ [সূত্র:রবীন্দ্র-নজরুল , ২১৯]। প্রসঙ্গত কবি আলাওল’র উদ্ধৃতি উল্লেখ্যÑ ‘কদাচিৎ নহে কবি সাধারণ মনুষ্য/শাস্ত্রে কহে কবিগণ ঈশ্বরের শিষ্য’ [সূত্র: সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী]।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের শত কৌতূহল ও শত অনুরাগের মতো আজ হতে শতবর্ষ আগে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাঙালির নতুন কবি মুক্তিদাতাই যেন জন্ম নিলো পূর্ব বঙ্গের গোপালগঞ্জে। রবীন্দ্র-নজরুলের সেই অভয়বাণী, পদ্মা-মেঘনা বুড়িগঙ্গা বিধৌত পূর্ব দিগন্তে সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের চরম আশ্বাসের কথা শোনাতে ওই মহামানব জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলায়’, জসীম উদ্দীনের ‘নকশী কাথায়’ বাংলার মহাকাশে ধ্রুবতারার মত জন্ম নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা। এক অকুতোভয় সংগ্রামী মহানায়ক বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নসাধনাকে স্বাধীনতার মুক্তির ঠিকানায় পৌঁছে দেন। আজ তাঁরই ১০১তম জন্মদিন। বাঙালির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দোরগোড়ায় যার জীবনপুঁজি থেকেই বাঙালি রচনা করেছিল স্বাধীনতার মহাকাব্য, একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও চূড়ান্ত বিজয়। একটি লাল সবুজের পতাকা। রক্ত দিয়েছিল ৩০ লক্ষ শহিদ। সম্ভ্রম হারায় লক্ষ লক্ষ মা-বোন। গৃহহারা হয় কোটি নিরস্ত্র মুক্তিকামী বাঙালি।
বাঙালির আরাধ্য রবীন্দ্রনাথের অভয়বাণী, নজরুলের বিদ্রোহ লালিত, গান্ধীর অহিংস অসহযোগিতা উদ্বেলিত, শৈশবে পিতার (শেখ লুৎফর রহমান) সততা ও নিষ্ঠার উপদেশ বাণী “ঝরহপবৎরঃু ড়ভ চঁৎঢ়ড়ংব্ ঐড়হবংঃু ড়ভ চঁৎঢ়ড়ংব” যা থেকে জীবনে কখনো বি”্যুত হননি। সংগ্রাম ও অসাম্প্রদায়িকতা শিখেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু থেকে, শিখেছেন ঈসাঁখাঁ, তিতুমীর, শরীয়তউল্লাহ, সূর্য সেন ও প্রীতিলতা থেকে। ¯েœহধন্য হয়েছেনÑশেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও মৌলানা ভাসানীর সাহচর্যে থেকে। আবির্ভূত হলেন ভাষা সংগ্রামে; নেতৃত্ব দিলেন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। প্রতিষ্ঠা করলেন মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ।
ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্ব থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধু তৈরি করলেন ভাষা ও সাংস্কৃতিক জাতীয় চেতনা। রাজনৈতিক জীবনের অনেকটাই জেল-জুলুম ও হুলিয়া মাথায় নিয়ে বাংলার প্রকৃতি, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি কখনো আব্বাসউদ্দীনের প্রেরণা ও আশীর্বাদে পুষ্ট হয়েছেন। পেয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ভালোবাসা ও অকুণ্ঠ সহযোগিতা।
স্বাধিকারের স্বপ্নে বাঙালির বাঁচার দাবি ‘৬ দফা’ ১৯৬৬Ñতে; বাঙালির মুক্তি আরো একটু আগেই চাইলেন এবং ফেঁসে গেলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। হাজার বছরের বাঙালির সংগ্রামী স্বপ্নপুরুষকে মুক্ত করতে জনতার ৬৯’র গণ-আন্দোলন; অবশেষে জাতীয় বীরের বেশে মুক্তি। উপাধি পেলেন “বঙ্গবন্ধু”। তখনো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বাকি, তথাপি অন্নদাশঙ্কর রায় রচনা করলেন শেখ মুজিবকে নিয়ে অমর ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতা Ñ দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা, রক্ত গঙ্গা বহমান/ তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান [সূত্র: অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা সমগ্র]।
ভারত ব্রিটিশ পরাধীন যুগে বিশ্বকবির মহাপ্রয়াণ ১৯৪১ সালে আর ১৯৪২ সালেই কবি নজরুল চিরদিনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তাঁদের অনবদ্য সৃষ্টি সাহিত্য, প্রবন্ধ, নাটক ও সংগীতে স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হলেও জীবদ্দশায় শুধু ত্রাণকর্তার আগমনী ও কিছু প্রাণ উৎসর্গকারীদের কথা স্বাধীনতা সংগ্রামের বার্তায় দিয়ে গেলেন। ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে/কত প্রাণ হলো বলিদান,/লেখা আছে অশ্রুজলে/ কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা/বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙা/তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে/যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে’ [সূত্র: মুক্তির মন্দির সোপান তলে : মোহিনী চৌধুরী]। জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগও ব্রিটিশদের ফয়সালায় ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলো কিন্তু তাঁর অসারতা সহসাই প্রতীয়মান হয়।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম শুধু একটি মানবজন্ম নয়, একইসঙ্গে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা , বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই হয়েছে। একটি নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ করলেন, যেটি হাজার বছরেও কোনো বাঙালি পারেনি। শুধু রাজনীতি নয়, ৭ই মার্চ রচনা করেন এক কালজয়ী রাজনীতির কবিতা; যেন উদাত্ত দীপ্তিময় আহবান (ঈষধৎরড়হ ঈধষষ)। এই অনবদ্য কথামালায় তিনি শুধু বাঙালির জন্য নয়, বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের স্মারক হয়ে রইলেন।
প্রকৃত অর্থে বাংলা ও বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন ছিল না। প্রাচীন বা মধ্যযুগে কিংবা সুবাহ বাংলায় কেন্দ্র থেকে প্রাদেশিক স্বাধীনতা ছিল, যেটি ক্ষণস্থায়ী। বস্তুত ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন হওয়ার পরেই এদেশের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সংগ্রামের প্রত্যয় দৃষ্ট হলেও ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ জাতীয় চেতনায় না গিয়ে সম্প্রদায় চিন্তায় পথ চলল। লক্ষেèৗ চুক্তি-১৯১৬ , ১৯১৯-১৯২৩ খেলাফতÑঅসহযোগ, স্বরাজ পার্টি ও বঙ্গীয় চুক্তিতে (১৯২৩) ও কৃষক প্রজা পার্টি’র মধ্যেই হিন্দু-মুসলিম সুসম্পর্ক কিছুটা দৃষ্ট হয়।
অন্যদিকে ভারতীয় স্বাধীনতায় কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ (ছঁরঃ রহফরধ) -মুসলিম লীগের ‘ভাগ কর, ভারত ছাড়’ (উরারফব ধহফ য়ঁরঃ ওহফরধ) দুই মেরুতে অনড় অবস্থানে ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তিতেই স্বাধীন হলো। গান্ধী, জিন্নাহ্, নেহেরু, প্যাটেল, মৌলানা আজাদ, সুভাষ বসু, সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, আবুল হাশিমও সমর্থ হলেন কিন্তু একক বাংলা-বাংলাদেশ গঠন করতে পারেননি। দেশভাগে বাংলা ভাগ হলো, সীমানা ভাগ হলো, মানুষ ভাগ হলো। কালজয়ী কবিতায় অন্নদাশঙ্কর রায় লিখলেনÑ ‘তোমরা যারা বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো;…..’।
ধর্মের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা,যা পূর্ব-পশ্চিমে হাজারো মাইলের ব্যবধান। ভাষা, সংস্কৃতি ও গড়নেও পার্থক্য। শুরুতেই শোষণ, বঞ্চনা, ভাষা, অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বৈরাচারী মনোভাব, পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পাকিস্তান উপ-উপনিবেশে পরিণত হলো। পাকিস্তানিদের শোষণ, অত্যাচার ও বঞ্চনার প্রতীয়মান হয় যাত্রার প্রথম প্রহরে মাতৃভাষার ওপরে আঘাত।পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ বাংলা ভাষা ও মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতেও প্রতিবাদ কর্মসূচি, আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্বে আসলেন তরুণ ছাত্রনেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান। সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হকদের নেতৃত্বের সকল গুণাবলি, এবং গ্রাম-মফস্বল, শহর ও নগরের জীবনের অভিজ্ঞতায় শেখ মুজিবুর রহমান সহসা জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে আসীন হলেন। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন বলেই ফেললেন “মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা ভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্য়াদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।” শেখ মুজিবুর রহমান বলেনÑ“আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম” [সুত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্টা নং-১১১]।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয় জেল, জুলুম ও অত্যাচার। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১- অর্ধেক সময় কারাজীবন। নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তফ্রন্টকে, হাল ধরেছেন আওয়ামী লীগের। যুগ্ম সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। ক্ষমতা ও মন্ত্রিত্বের চেয়ে নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আপোষ ও মাথা নত না করে কীভাবে দেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করা যায় সেই পথেই চলেছেন। ৫২, ৫৪, ৬২’র হাত ধরেই ৬৬Ñতে রচনা করেন বাঙালির বাঁচার দাবি ‘৬ দফা’। আগরতলা রাষ্ট্রদোহ মামলায় জীবন-মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে বীরের বেশে মুক্ত হলেন। শেখ মুজিব থেকে হয়ে ওঠলেন ‘বঙ্গবন্ধু’(ঋৎরবহফং ড়ভ ইবহমধষ)। এর পরে আর মাত্র দুবছর। ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে ধস নামানো বিজয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি পেয়েছে দেশ শাসনের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট। পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ ও ষড়যন্ত্র শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।
ওই ভাষণে একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতার মত মুক্তিযুদ্ধের সকল প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে নির্দেশ দেন। বাঙালিকে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে আহবান জানান। ২৫শে মার্চ স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সমারিক জান্তা গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করলে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হলেন। বন্দি হওয়ার আগে প্রথম সারির নেতাদের আত্মরক্ষা করতে নির্দেশ দিলেন। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে অধিকাংশ বাঙালির জীবনকে রক্ষায় ব্রত হলেন। কেননা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে না পারলে সেদিন কত মুক্তিকামী বাঙালি নিহত হতেন সেটি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। প্রজ্ঞাবান বঙ্গবন্ধু নিজে আত্মগোপন না করে বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করলেন।শুধু তাই নয়, ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, একদিকে দশ লক্ষ উপস্থিত জনতা, মাথার উপড়ে সামরিক হেলিকপ্টার। এতো মানুষের জীবনের ঝুঁকি যেমন নিতে চাননি তেমনি একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী (ঝবঢ়ধৎধঃরংঃ) নেতাও হতে চাননি।
ধানম-ির বাসা থেকে ২৬শে মার্চ ভোরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি প্রতিনিয়ত জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। বাঙালি আওয়াজ তুললেন “শেখ মুজিবের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। শুরু হলো যুদ্ধ-(গেরিলা যুদ্ধ)। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমর্থনে অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালির কাক্সিক্ষত বিজয় আসলো। স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন-দিল্লী হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন।
শুরু হলো বাঙালির নতুন অধ্যায়, দেশ পুনর্গঠনের কাজ। ব্যাংক নেই, বীমা নেই, কোনো রিজার্ভ নেই। সবকিছুই শূন্য। পুল, কালভার্ট, ব্রিজ সড়ক ও রেলপথ বিধ্বস্ত। সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর বিরান, দেশ যেন পোড়ামাটি। দরকার প্রয়োজনীয় অর্থ, দরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। মিত্রবাহিনীকে ভারতে ফিরিয়ে দেয়া ও প্রয়োজন দক্ষ প্রশাসন। পুনর্গঠন করতে হবে সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী। একটি বছরের মধ্যেই রচনা করলেন অভাবনীয় শাসনতন্ত্র। আর যার মধ্যে বাঙালিত্ব প্রতিভাত, সুস্পষ্ট হয়েছে মানবমুক্তি (ঢ়ঁৎংঁরঃ ড়ভ যধঢ়ঢ়রহবংং)। সদ্যস্বাধীন দেশ; কারো সাথে বৈরিতা নয় সবার সাথে বন্ধুত্ব (পররাষ্ট্র মূলনীতি)। প্রণয়ন করেন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন । ওআইসি এমনকি জাতিসংঘেও প্রমাণ করলেন এক অনন্য বাঙালি হিসেবে। হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু, রাজনীতির কবি, জাতির পিতা হয়ে মানুষের হিমালয়। অতঃপর বিশ্ববন্ধু (জুলিও কুরি) এখন জাতিসংঘের “বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য”ও ৭ মার্চের ভাষণ।
হঠাৎ যেন সব থমকে গেলো, বাঙালি জাতি প্রত্যক্ষ করলো, কিছু বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তা, দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পরিচালিত ইতিহাসের নির্মম ভয়াবহ হত্যাকা-। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। বাঙালির যে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল তা বঙ্গবন্ধু পেলেন না। দেশ, জাতি ও বিশ্ব বড় ধরনের প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হল। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা দেশ যেন উল্টো পথে পরিচালিত হল।
বাঙালির ভাগ্যাকাশে বাংলাদেশ নামক উজ্জ্বল প্রদীপ যখন প্রায় নিভু নিভু অবস্থায় ঠিক তখনি ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন সেদিনের ভয়াবহ হত্যাকা- থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। জননেত্রী শেখ হাসিনা হাল ধরলেন আওয়ামী লীগের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রীর। তিনি বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ করছেন এবং বঙ্গবন্ধুর যে মুক্তির দেশ, সে দেশের অনেক অর্জনে শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। অনেক সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত দেশ মুক্তির নোঙরে পৌঁছাতে সক্ষম। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসলে একে একে সম্পন্ন করেন বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, যার মধ্য দিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। বর্তমানে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছি। দেশের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী করা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছি। বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলাদেশ সুপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই হাজার বছরের সেই মহামানব, রাজনীতির কবি, রাজনৈতিক কর্মী, সংগ্রামী মানুষ, রাজনীতিবিদ, জননেতা সকল আশীর্বাদে বাঙালির কাক্সিক্ষত মহামানবের জন্ম সার্থক হবে। এই মহামানব রবীন্দ্র-নজরুলের আশার বাণীর মত সত্যি সত্যিই এসেছিলেন এবং অন্নদাশঙ্করের প্রত্যাশার মতই ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা গৌরি বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।
বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয় আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে থাকবেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক তরী যতদিন পরিচালিত হবে, এভাবেই বাংলাদেশ একদিন বিশ্ব দরবারে নিজের অবস্থান জানান দেবে এবং জাতির পিতার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে- সেটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক ডিন
কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়
প্রাবন্ধিক ও গবেষক