মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত »
চলমান করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশিরা নানান সংকটের আবর্তে দিন কাটাচ্ছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে বিশ্বের ১৬৯টি দেশে বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখের মতো শ্রমিক রয়েছে। তবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি’র হিসেব মতে এই সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্ত করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক মন্দাভাবের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিকেও থমকে দিয়েছে। তেলনির্ভর এই দেশগুলোর অর্থনীতি অনেকাংশে তেলের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। তাই তেলের দাম কমে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব পড়ে। তার উপর করোনার কারণে বছরব্যাপী আংশিক বা পূর্ণ লক ডাউন এবং বিভিন্নমুখি বাণিজ্য সীমিতকরণ করার কারণে চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। স্বাভাবিকভাবেই এই দেশগুলোতে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিকরাও নানান রকম সমস্যায় জর্জরিত। যদিও এই বছরে এসে অবস্থার সামান্য পরিবর্তন হয়েছে তথাপি হাজারো বাংলাদেশি শ্রমিক চাকুরিহারা হয়ে দেশে চলে গেছেন এবং অনেকের বিভিন্ন অসুবিধার কারণে দেশে যেতে পারছে না এবং নতুন কোন কাজেও যোগদান করতে পারছে না । অনেকেই আবার গত বছর ছুটিতে গিয়ে নানান নিয়ম-কানুনের জালে আটকে গিয়ে কর্মস্থলে যোগদান করা সম্ভব হয়নি এবং দেশের মাটিতে তারা এক ধরনের মানবেতর জীবনযাপন করছে।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার, বাহারাইন ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করে। তারমধ্যে শুধু সৌদি আরবেই বসবাস করে প্রায় ২০ লক্ষ। বিশ্বব্যাপী করোনার তৃতীয় ঢেউ চলছে এবং এই করোনা অতি সহজে যে শেষ হবে না তা ইতিমধ্যেই বুঝা যাচ্ছে। তৃতীয় ঢেউয়ের পর যদি চতুর্থ ঢেউ আসে তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই এই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদি তাই হয় তাহলে কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনীতি আরো খারাপের দিকে যাবে। এমতাবস্থায় প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা আরো বেশি চাকুরিহারা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসী আয়ের মতো শক্তিশালী বিকল্প খাত এখনও সৃষ্টি হয়নি। করোনাকালীন সময়েও বাংলাদেশি প্রবাসীরা দেশের জন্য যে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয় ও উৎসাহব্যঞ্জক। সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমান ২ লাখ ১০ হাজার ১১৪ কেটি টাকা। যা দেশের অর্থনীতির ভিতকে এখনো মজবুত করে ধরে রেখেছে। কিন্তু এই করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিজস্ব নতুন শ্রম আইনের কারণে দিন-দিন বাংলাদেশি প্রবাসীরা চাকরি হারাচ্ছে। বিশেষ করে সৌদি আরবের নতুন শ্রম আইন এবং সৌদিকরণসহ বিভিন্ন কারণে সৌদি আরবে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিরাট একটি অংশ চাকরিচ্যুত হয়েছে এবং ছোট-খাট ব্যবসায়িরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।
সৌদি আরবের ইংরেজি দৈনিক সৌদি গেজেটে প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে দেশটিতে ১২ লাখ কর্মী চাকরি হারিয়েছে। এখন এই সংখ্যা যে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলা বাহুল্য। আমাদের দেশ থেকে আসা শ্রমিকদের মাত্র দুই শতাংশ চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা পেশাদার বা দক্ষ শ্রমিক বাকিরা অদক্ষ শ্রমিক।
বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপকভাবে তাই বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকের আধিক্য কমে আসছে স্বাভাবিক ভাবেই। এ ক্ষেত্রে অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন নেই বললেই চলে। অপরদিকে আমাদের রয়েছে ভাষাগত সমস্যা এবং ভিসাগত বিভিন্ন জটিলতাÑসবমিলিয়ে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের আগামীর দিনগুলো যে অধিকতর কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সময় থাকতে এসব নিয়ে ভাবতে হবে এবং দ্রুত ফলপ্রসু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে রেমিটেন্স প্রবাহ যাতে মজবুত থাকে প্রবাসী শ্রমিকরা যাতে দেশে এবং প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার ও দূতাবাসগুলোর দ্রুত ও কার্যকর সহযোগিতা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে গিয়ে বর্তমানে প্রবাসীরা ফিরতি ফ্লাইটের বিড়ম্বনা, করোনার টিকা বিড়ম্বনা, প্রবাসে এসে কোয়ারেন্টাইনের জন্য বিরাট অংকের অর্থ জমা করাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। এমন কি নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে ফেরার জন্য প্রবাসীদের রাস্তায় নেমে আন্দোলনও করতে হয়েছে যা সত্যিই দুঃখজনক! প্রবাসীরা আজ সবদিক দিয়েই অবহেলিত। সদ্যসমাপ্ত বাজেট প্রস্তাবেও প্রবাসীদের জন্য তেমন কোন সুখবর বা আশার আলো নেই। যদিও প্রবাসী আয়ে সরকার দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী অথচ প্রবাসীরা আশা করেছিল এই প্রণোদনা চার শতাংশে উন্নীত করা হবে কিন্তু সোয়া কোটি প্রবাসীর সেই স্বপ্নে গুড়ে বালি। করোনার কারণে প্রবাস ফেরৎ শ্রমিকদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অনুকূলে ৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করেছে সরকার। কিন্তু এই ঋণ সত্যিকার অর্থে প্রবাসীদের হাতে যায় কিনা এবং প্রবাসীদের ঘুরে দাঁড়াতে তা কতটুক সহায়ক হবে তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়! করোনা একদিন শেষ হবে কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্ট হয়তো আমৃত্যু সঙ্গী হয়েই থাকবে। প্রবাসীরা যা আয় রোজগার করে তা পরিবার-পরিজনের জন্য পাঠিয়ে দেয় যাতে করে দেশে অবস্থানরত আপন মানুষগুলো একটু সুখে দিনাতিপাত করে। কিন্তু এই প্রবাসীরাই যখন দেশফেরত হয় তখন তাদের আর কোন মূল্যায়ন থাকে না। কেননা তখন তারা আয় রোজগারহীন বেকার বোঝা হয়ে যায়।
যে মানুষটি সারাজীবন প্রবাসের মাটিতে নিজের স্বর্ণালী সময়টুকু পরিবার পরিজনের জন্য, দেশের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে সেই মানুষটি তখন হয়ে যায় অথর্ব, অপাংক্তেয়। প্রবাসীদের এই দুর্দশা লাঘবে প্রবাসে থাকাকালীন ও প্রবাস থেকে স্থায়ী ভাবে ফেরত আসার পর যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করতে পারে তার জন্য সরকারের যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যিক। প্রবাসীদের জন্য সরকারের কিছু বিষয়ে গভীর মনযোগী হওয়া আবশ্যক। যেমন- অসৎ ও প্রতারক ভিসা ব্যবসায়ীদের হাত থেকে শ্রমবাজার রক্ষা করা, ভিসার চুক্তি মোতাবেক কাজ ও পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি’র সেবা প্রবাসীদের জন্যে আরো সহজ ও ব্যাপক করা, বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকদের সহজ শর্তে ঋন প্রদান করা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া আর সে জন্য আধুনিক ও উন্নত সুবিধা সংবলিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া প্রবাসের মাটিতে আহত ও চাকুরিচ্যুত শ্রমিকদের আইনি সহায়তা প্রদান করা, মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের সরকারি খরচে দেশে আনার ব্যবস্থা সহজীকরণ করা এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, প্রবাস ফেরৎ কর্মীদের সরকারি পেনশন চালু করা সহ প্রবাসীদর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলির প্রতি সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া জরুরি। প্রবাসীদের শ্রম, ত্যাগ ও সেবার বিপরীতে তাদের চাহিদা নিতান্তই সীমিত। সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের এই দুর্দিনে পাশে থাকতে হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম-বাজার পর্যালোচনা পূর্বক করোনা পরবর্তী শ্রমবাজার ধরে রাখতে এখন থেকেই যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
সৌদি আরব
ংযধফধঃথযঁংংবরহ@ুধযড়ড়.পড়স