২৩ শিশু নিয়ে বিপাকে ‘ছোটমণি নিবাস’

‘প্রতিষ্ঠানটি সুস্থ শিশুদের জন্য হলেও সেখানে বেশিরভাগই প্রতিবন্ধী’

নিলা চাকমা

যে শিশুর কোনো ঠিকানা নেই, তাদের জন্য করা হয়েছে ছোটমণি নিবাস। সমাজসেবা অধিদফতরের এই ‘ছোটমণি নিবাস’ রয়েছে সারাদেশের কেবল ছয়টি বিভাগে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের নিবাসটিতে রয়েছে ৩৩ জন শিশু। এর মধ্যে ২৩ শিশুই শারীরিক প্রতিবন্ধী। যাদের ১০ জনের বয়স সীমা অতিক্রম করলেও তাদের নিচ্ছে না কেউ। অন্যদিকে লোকবল সংকটসহ নানা সমস্যা নিয়ে বিপাকে পড়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

জানা গেছে, সমাজ অধিদপ্তরের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ৬টি বিভাগে রয়েছে ছোটমণি নিবাস। পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন ০-৭ বছর বয়সী পরিত্যক্ত/পাচার হতে উদ্ধারকৃত শিশুদের ‘ছোটমণি নিবাসে’ লালনপালন করা হয়। এছাড়া আট থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুদের সরকারি শিশু পরিবার (বালক) ও সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানে রাখা হয়। চট্টগ্রাম ‘ছোটমণি নিবাসে’ বর্তমানে ৩৩ জন শিশু রয়েছেন। তারমধ্যে ২৩ জনই প্রতিবন্ধী, ১১ জন সুস্থ শিশু রয়েছেন। এদের ১০ জনের বয়সই সাত বছরের ঊর্ধ্বে।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রয়ারি) দুপুরে দেখা যায়, দুই পাশ ভবনের মাঝে ছোট একটি খোলা মাঠ। রয়েছে রাইড, দোলনা। সেখানে সুস্থ শিশরা খেলছে। মাঠে দুটো খাটও রয়েছে। সেখানে একটিতে ২ জন সুস্থ বাচ্চা, আরেকটিতে ৬ প্রতিবন্ধী শিশুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আয়ারা এসব শিশুদের খাইয়ে দিচ্ছেন। সবচেয়ে ছোট দুই মাসের বাচ্চাটিকে ফিডারে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে।
‘ছোটমণি নিবাসে’র নার্স আফসানা ইসলাম বলেন, ‘ প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিবার থাকা সত্ত্বেও উপরের বিভিন্ন মহলের রেফারেন্স নিয়ে এখানে রেখে যাওয়া হয়। বিভিন্ন থানা এবং হাসপাতাল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদের এখানে আনা হয়। বেশির ভাগ শিশু সাত বছরের ঊর্ধ্বে। তদের বয়স কমিয়ে রেখে যান তারা। কিন্ত এ প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র শুন্য থেকে ৭ বছর বয়সীদের রাখা হয়। এভাবে করতে করতে এক প্রতিবন্ধী শিশুর বয়স এখন ২২ বছর। বিশেষ এই শিশুরা সুস্থ শিশুদের শারীরিকভাবে আঘাত করছে। সুস্থ বাচ্চারা নিজের প্রয়োজনীয় সব কাজ করতে পারলেও প্রতিবন্ধী বাচ্চারা তা পারে না। তাদের সব কাজ দেখভাল করতে হচ্ছে শুধুমাত্র অস্থায়ীভাবে ৬ জন আয়া দিয়ে।

তিনি আরও বলেন, ‘যাদের সাত বছর বয়স পেরিয়ে গেছে তাদের মানসিক প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। তারা কোনোভাবেই এসব শিশুদের নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অথচ বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আসা বিশেষ শিশুদের রাখছে। শুধু আমাদেরগুলো নিতে নারাজ। আয়াদের বেতন মাত্র ৪ হাজার। তাও সরকারিভাবে নয়। একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান তাদের বেতন দিয়ে যাচ্ছেন। তারা বেতন বন্ধ করে দিলে একটা আয়াও থাকবে না।’
নাফিসা (ছদ্মনাম) নামে এক আয়া বলেন, ‘এটা সুস্থ শিশুদের প্রতিষ্ঠান। সেখানে প্রতিবন্ধীদের শিশু দিয়ে ভরিয়ে রাখা হয়েছে। যার কারণে বাড়তি সময় দিতে হয়। নিজের পরিবারেও সময় দিতে পারি না। মানবিক কারণটাও টানে আমাকে। তাই সময় দিই, পরিচর্যা করি। আমাদের বেতন মাত্র ৪ হাজার টাকা। বর্তমান বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে চলাটা খ্বু কঠিন হয়েছে। আমাদের বেতন বাড়ানো হোক। সেই সাথে প্রতিবন্ধী শিশুকে প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানেই রাখার ব্যবস্থা করা হোক’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানে’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাবা-মায়েদের মধ্যে এখন মানবিক মূল্যবোধটা উঠে গেছে। আমাকে প্রায় সময় প্রতিবন্ধী শিশুদের বাবা-মায়েরা ফোন দেয় তাদের বাচ্চাকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে রাখার জন্য। তারা নাকি সেই শিশুর জন্য সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। অন্য সন্তানদের বিয়ে দিতে সমস্যা হয়। অনেকেতো শুধু মাত্র বিয়ের সময়টাতে রাখার আবদার জানায়। অনেকে অতিষ্ঠ হয়ে এসব বাচ্চাদের পথে-ঘাটে চিঠি লিখে ফেলে যাচ্ছে। এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯১ শিশু রয়েছেন। অথচ মাত্র ৭৫ জনের জন্য অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানটি। ‘ছোটমণি নিবাসে’ শিশুদের জায়গা সংকুলানের ব্যবস্থা হয় ১০০ জনের। যেসব প্রতিবন্ধী বাচ্চা ‘ছোটমণি নিবাসে’ রয়েছে, তারা অনেক ভালো আছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাদের বয়স বেশি তাদের নিয়ে আসতে।’

প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.ফরিদুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগে এখন সর্বমোট প্রতিবন্ধী রয়েছেন ৮৫ হাজার ৩৬৮ জনের মতো। তাদের উন্নয়নে সরকার ৭৭ কোটি টাকারও বেশি বছরে ভাতা প্রদান করেন। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মমুখী করতে নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। অর্থাৎ সরকারের পক্ষে যা যা করার সবই করা হচ্ছে। কিন্ত বাবা-মায়েরা সেটা বুঝেন না। প্রতিবন্ধী হলেই তাদের বোঝা মনে করা হয়। শিক্ষা অর্জন থেকেও বঞ্চিত করা হয়। আবার অনেক বাবা-মা পথে ঘাটে চিঠি লিখে ফেলে যাচ্ছে। কোনোভাবেই তা থামানো যাচ্ছে না। বাবা-মায়ের নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে। তাদের কাউন্সিলিংয়ের দরকার। বাবা-মায়েদের বোঝানো দরকার প্রতিবন্ধীরা পরিবার- সমাজের বোঝা নয়। তাদের সুযোগ- সুবিধা দিলে তারাও বিশ্ব জয় করতে পারে।’

‘ছোটমণি নিবাস’ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানটি সুস্থ শিশুদের। কিন্ত সেখানে বেশিরভাগ শিশুই প্রতিবন্ধী। সুস্থ শিশুদের সরকারের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন পরিবারে দত্তক দেওয়া যায়। কিন্ত প্রতিবন্ধী শিশুদের বেলায় বিষয়টি খাটেনা। আমরণ সরকারকে সব খরচ দিয়ে যেতে হয়। মা-বাবাদের সচেতন হওয়া ছাড়া এ সমস্যা দূর হওয়ার নয়।’