হ্যাটট্রিক জয় তৃণমূলের

নন্দীগ্রামে হারলেন মমতা

সুপ্রভাত ডেস্ক <<
বুথফেরত জরিপ বা জনমত জরিপ সবক্ষেত্রেই আভাস মিলছিল পশ্চিমবঙ্গে ফের সরকার গড়তে যাচ্ছে মমতার তৃণমূল। অপেক্ষা ছিল রোববার ভোট গণনার দিনের। যদিও বিজেপি বারবার বলে যাচ্ছিল, দিদিকে তারা হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া পতাকা উড়াবে তারা। কিন্তু দলটির সে স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিল না। রোববার সকাল থেকে ভোট গণনার ফল আসতে শুরু করে। এতে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে নিরঙ্কুশ জয়ের পথে রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল। যদিও তিনি নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর কাছে হেরে গেছেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, পশ্চিমবঙ্গে ২৯২ আসনের মমতার তৃণমূল ২১৫ আসনে এগিয়ে আছে। বিজেপি এগিয়ে আছে ৭৬ আসনে।
আসন প্রাপ্তির নিরিখে তো বটেই বিধানসভা নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখেও সেরা ফল করল তৃণমূল। বস্তুত, ভোট শতাংশের হিসেবে এটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত দলের সবচেয়ে ভাল ফল। ভোটগণনার গতিপ্রকৃতির ইঙ্গিত, মোটের উপর ৪৮ শতাংশ ভোট পেতে চলেছে তৃণমূল। অতীতে কোনও বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে এত আসন পায়নি তারা। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোট ৬টি লোকসভা এবং ৫টি বিধানসভা ভোটে লড়েছে তৃণমূল। বিধানসভা ভোটের এ পর্যন্ত সেরা ফল হয়েছিল ২০১৬ সালে। ৪৪.৯১ শতাংশ ভোট পেয়ে ২১১টি আসনে জিতেছিল জোড়াফুল। ভোট শতাংশের পাশাপাশি আসন প্রাপ্তির হিসেবেও এ বারে সেই সংখ্যাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে তারা। ২০১১-র বিধানসভা ভোটে ৩৮.৯৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮৪টি আসন দখল করেছিল তৃণমূল। তবে সে বার তারা লড়েছিল ২২৬টি আসনে। কংগ্রেস-সহ অন্য সহযোগীদের বাকি আসনগুলি ছেড়েছিল। খবর বিডি, বাংলা ও আনন্দবাজার।
এদিকে বাম পায়ে আঘাত লাগার কারণে গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে হুইলচেয়ারে বসেই প্রচার চালিয়েছিলেন তিনি। চষে বেড়িয়েছেন গোটা পশ্চিমবাংলা। বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম থেকেই জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।
ভোটের ফল প্রকাশিত হতেই রাজ্যের একাধিক জায়গা থেকে কালীঘাটসহ কলকাতার সর্বত্রই সবুজ আবির খেলায় মেতেছিল। তখনও কর্মী-সমর্থকেরা জানতেন না নন্দীগ্রামে ফল নিয়ে টালমাটাল অবস্থা। ১৯৫৩ ভোটে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে পরাজিত হয়েছেন মমতা- এমন খবর সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, এখনও যে ফল প্রকাশ হয়েছে শুভেন্দু জয়ী হয়েছেন।
ভোটগণনা শুরু পর থেকেই নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন মমতা। ফল নিজের কোর্টে আসার পরই স্বমহিমায় হেঁটে বের হন কালীঘাটের বাড়ি থেকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মমতা বলেন, এটা বাংলার জয়। কিন্তু উচ্ছ্বাস যেন বাঁধভাঙা না হয়। করোনা চলছে। এখন করোনা মোকাবিলা করাই প্রধান কাজ। এখনই বিজয় মিছিল নয়। সবাই বাড়ি যান। অভিনন্দন আপনাদের সবাইকে। আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিজয় উৎসব কবে হবে পরে জানবো।
এরপর স্থানীয় সময় ৬টার এক ভার্চুয়াল সভা থেকে মমতা বলেন, আমি ভেবেছিলাম ২২১ আসন পাবো। সেটাই টার্গেট করেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে ডাবল ইঞ্জিনের বিরুদ্ধে ডাবল সেঞ্চুরি করবো। সেটাই করেছি। বাংলার এই জয় আসলে ভারতের জয়। ভারতকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও খারাপ ব্যবহার করেছে। মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়েছে এই জয়। বিজেপির স্লোগান ছিল রাজ্যে এবার ডাবল ইঞ্জিন। অর্থাৎ কেন্দ্রে বিজেপি রাজ্যেও বিজেপি। এরপর মমতা বলেন, বাংলায় খেলা হবে। বাংলার গ্রামের ক্লাবগুলোকে ৫০ হাজার ফুটবল আমি দেবো। খেলা হয়েছে, আমরা জিতেছি। বড় আকারে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান করবো না কোভিড পরিস্থিতিতে। এবার মানুষের কথা শুনবো। অন্য কারো কথা নয়। বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন সবাইকে দেবো। কেন্দ্রকে বলবো ১৪০ কোটি লোককে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দিতে। না করলে গান্ধী মূর্তির নিচে প্রতিবাদ শুরু করবো। আজ আমার খুব আনন্দের দিন। আমার চেয়ে বড় খুশি আর কেউ হয়নি। বিজয় মিছিল না করলেই ভালো এখন। পরে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিজয় মিছিল করবো।
‘এখন সবচেয়ে বড় কাজ মানুষের পাশে দাঁড়াবো। সবার পাশে থাকবো। বাংলার মানুষকে আমার স্যালুট। আমি গর্বিত যে বাংলার মানুষ এই কাজ করে দেখিয়েছে দেশকে। যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি পালন করবো। ’
দুপুরে আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের শিরোনাম ছিল- ‘দিদিই ফিরছেন’। আর এনডিটিভি’র শিরোনাম- ‘সুপার ভিক্টরি ফর তৃণমূল’। ১০ বছর আগে বাম রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের শাসন কায়েম করেছিলেন মমতা। ২০১৬ সালেও সেই ধারায় ছেদ পড়েনি। কিন্তু ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরই রাজ্যে বিজেপির শক্তিশালী অবস্থান ধরা পড়ে। সেবার এ রাজ্যে ১৮টি আসন পায় নরেন্দ্র মোদির দল। এবারের বিধানসভা নির্বাচন ছিল বিজেপির জন্য বাংলা দখলের লড়াই; আর সেই চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে বেশ কয়েকটি জনসভা করেন করোনাভাইরাসের এই মহামারীর মধ্যে।
এদিকে মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন পায়ে চোট পেয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। কয়েক দিন হাসপাতালে থেকে ভোটের প্রচারের পুরোটা সময় তিনি হুইলচেয়ারে ছুটে বেরিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের এ মাথা-ওমাথা।

 

শুভেন্দুর কাছে মমতার হার
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে আলোচিত নন্দীগ্রাম আসনে ভোটের ফল নিয়ে কয়েক ঘণ্টার চরম নাটকীয়তা শেষে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।
অথচ গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রথম খবর এসেছিল এই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে এক হাজার ২০১ ভোটে জিতেছেন তৃণমূল নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ওই খবর প্রকাশের কিছুক্ষণের মধ্যেই আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে ফোনে নন্দীগ্রামে নিজেকে বিজয়ী দাবি করেন এক সময় মমতার ‘লেফটেনেন্ট’ হিসেবে পরিচিত শুভেন্দু। যিনি তৃণমূল ছেড়ে এবারই প্রথম পদ্মফুল (বিজেপি) নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন।
দুই ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীর জয় দাবির প্রেক্ষিতে সন্ধ্যা থেকেই নন্দীগ্রাম আসনের ফল নিয়ে নাটকীয়তা শুরু হয়।
একদিকে নির্বাচন কমিশন ভোট পুনগণনা করবেন কিনা তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মমতা সাফ জানিয়ে দেন, নন্দীগ্রামের মানুষ যে রায়ই দিক তিনি তা মেনে নেবেন। একই সঙ্গে তিনি নন্দীগ্রামে ‘ভোট লুটের’ অভিযোগ তুলে আদালতে যাওয়ার হুমকি দেন।
এ নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েনের পর স্থানীয় সময় রাত ৮টার পরে নির্বাচন কমিশন নন্দীগ্রামে ভোট পুনগণনা না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ওই আসনে শুভেন্দুকে বিজয়ী ঘোষণা করেন বলে জানায় কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার।
‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড’ নন্দীগ্রামের ভোটের ফল নিয়ে অবশ্য দিনভর উত্তেজনা ছিল। গতকাল রোববার সকাল থেকে ষষ্ঠ রাউন্ডের ভোট গণনা শেষে শুভেন্দু অধিকারী ৭ হাজার ২৬২ ভোটে মমতার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মমতা ব্যবধান কমাতে শুরু করেন। এ আসনে মোট ১৭ রাউন্ডে ভোট গণনা শেষে প্রথম মমতা জিতেছেন বলে খবর বের হয়।
২০১৬ সালে মমতার দল তৃণমূলের হয়ে নন্দীগ্রাম আসনে জিতেছিলেন শুভেন্দু। গতবছর ডিসেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন।
মমতার সরকারে পরিবহন ও পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লোকসভায় তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব করা শুভেন্দু ১৯৯৫ সালে কংগ্রেসের হয়ে কাউন্সিলর নির্বাচনে জেতেন। নন্দীগ্রামে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রভাব সুবিদিত।
এবার ভোটের আগে মমতাকে হারানোর ‘চ্যালেঞ্জ’ দিয়েছিলেন শুভেন্দু। তৃণমূলনেত্রী কলকাতায় নিজের আসন ছেড়ে নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণও করেন।
মমতাকে অভিনন্দন নরেন্দ্র মোদির
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মত জিততে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস। আনুষ্ঠানিক ফলাফল এখনো ঘোষণা না হলেও এরই মধ্যে এক টুইটে মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এবার পশ্চিমবঙ্গের দখল নিতে উঠেপড়ে লেগেছিল মোদির দল বিজেপি। মোদি নিজে সেখানে দলের নির্বাচনী প্রচারে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। দলীয় প্রচারের জন্য কয়েকবার তিনি পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণও করেছেন।
মোদি-মমতার কথার লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের প্রচার বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল। দুই নেতা পরষ্পরকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি। পশ্চিমবঙ্গের সমাবেশগুলোতে ‘দিদি’ ‘ও দিদি’ বলে মমতাকে বহুবার ব্যঙ্গ করেছেন মোদি।
এবারও সেই ‘দিদি’ ডেকে মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি।
মোদি টুইটে লেখেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের জয়ের জন্য মমতা দিদিকে অভিনন্দন। জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে এবং কোভিড-১৯ মহামারী থেকে পরিত্রাণে কেন্দ্র থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হবে এবং বাড়ানো হবে।’
পশ্চিমবঙ্গে মমতার দলের সম্ভাব্য বিজয়ে ভারতের আরো বেশ কয়েকজন নেতা অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন। তাদের একজন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরভিন্দ কেজরিওয়াল।
কেজরিওয়াল লেখেন, ‘মমতা দিদি, আপনাকে বড় বিজয়ের জন্য অভিনন্দন। একেই বলে লড়াই।’