‘হাঙরের মা’ ক্রিস্টিনা জেনাতোর

সুপ্রভাত ডেস্ক :
পানির নিচে সংসার ক্রিস্টিনা জেনাতোর। তার অনেকগুলো সন্তান। তারা অবশ্য কেউই মানুষ নন। তারা সবাই শার্ক বা হাঙর প্রজাতির। একজন মধ্যবয়সী নারীকে ঘিরে সেই হাঙরদের আবেগ আর উচ্ছ্বাস দেখলে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এক্কেবারে সত্যি। দীর্ঘ অনেকগুলো বছর ধরেই এই শ্বেতাঙ্গ নারী কাজ করে চলেছেন হাঙরদের স্বাস্থ্য ও সংরক্ষণ নিয়ে।
হাঙর শিকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্যও শুরু করেছেন লড়াই। কাজে ডুবে নিজের নামটাও প্রায় ভুলতে বসেছেন এতদিনে। বিশ্বের মানুষের কাছে ক্রিস্টিনা জেনাতোর এখন একটাই পরিচয়, তিনি মাদার অফ শার্কস বা হাঙরদের মা। আফ্রিকার গভীর রেন ফরেস্ট অঞ্চলে বড় হওয়ার সুবাদেই হয়তো ছোটবেলা থেকে প্রকৃতি আর পশুপাখিদের নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই ক্রিস্টিনার।
সমুদ্রের ওই নীলাভ-সবুজ জলের প্রতি আশ্চর্য টান ছিল তার। ছোটবেলায় তো পানি দেখলেই তাকে আটকানো মুশকিল হত। ঝাঁপিয়ে পড়তেন সাঁতার কাটবেন বলে। পানির প্রতি শুধু টানই নয়, তাকে টানত পানির নীচের আশ্চর্য প্রাণিরাও। সেই ভালোবাসা থেকেই খুব কম বয়সেই স্কুবা ডাইভিং কোর্সে যোগ দেন ক্রিস্টিনা। তারপর থেকে স্কুবাই তার ধ্যানজ্ঞান।
প্যাডি কোর্স ডিরেক্টর ক্রিস্টিনা বর্তমানে ইংরাজি ছাড়াও ইটালিয়ান, জার্মান, ফ্রেঞ্চ আর স্প্যানিশের মতো পাঁচটি ভাষায় সড়গড়। লোকজন যদিও আড়ালে বলে পাঁচটা নয়, তিনি আসলে ছ’টি ভাষায় দক্ষ। বলাই বাহুল্য, এই ৬ নম্বর ভাষাটি হাঙরের ভাষা। সত্যিই যেন হাঙরের ভাষা বুঝতে পারেন ক্রিস্টিনা। বুঝতে পারেন তাদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্টও।
শার্ক ডাইভিং আর শার্ক বিহেভিয়ার নামের দুটো অভিনব বিষয়ে স্পেশালাইজেশনও রয়েছে। তার এমনিতে হাঙরদের সমঝে চলে পানির নিচে প্রাণিরা। বড় বড় রাক্ষুসে দাঁত আর মাংশাসী স্বভাবের জন্য এমনকি মানুষও ভয় পায় হাঙরদের। আর এখানেই ব্যতিক্রমী ক্রিস্টিনা। তিনি বিশ্বাস করেন, নিঃশর্ত ভালোবাসায়। বিশ্বাস করেন স্নেহ-মমতার ম্যাজিকাল ক্ষমতায়, যা পানির হিংগ্রতম প্রাণিটাকেও করে তোলে শিশুর মতই আদুরে।
হাঙরের প্রায় কয়েক ডজন প্রজাতিকে নিয়ে কাজ করেছেন ক্রিস্টিনা। বিভিন্ন জাতের হাঙর আর তাদের স্বভাববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করার জন্য ঘুরেছেন রোড আইল্যান্ড, ফিজি, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চিন, জাপান, মেক্সিকো অব্দি বিশ্বের নানা প্রান্তে। কথা বলেছেন সেখানকার মানুষের সঙ্গে, ক্যাম্পে হাঙর শিকারের বিরুদ্ধে। ক্রিস্টিনার স্পর্শের ভাষা খুব ভালোভাবে চেনে এই পানির নিচের প্রাণিরা।
তিনিও জানেন, ঠিক কোন স্পর্শে শান্ত হবে তারা। শুধুমাত্র স্পর্শের মধ্যে দিয়ে হাঙরদের সঙ্গে এক আশ্চর্য সেতু বানাতে পেরেছেন তিনি। তার আঙুলের ছোঁয়ায় ক্যারিবিয়ান রিফ শার্কের মতো ভয়ানক প্রজাতির হাঙরগুলোও এমন শান্ত হয়ে যায়, দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন ক্রিস্টিনার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে তারা। হাঙরদের নিয়ে, তাদের জৈবচরিত্র এখনও বিশ্বে খুব বেশি গবেষণা হয়নি।
সেখানে ক্রিস্টিনা জেনাতোর কাজ নিঃসন্দেহে উল্লেখের দাবি রাখে। হাঙরদের নিয়ে নানারকম গবেষণার পাশাপাশি হাঙর শিকারের বিরুদ্ধেও বেশ কিছু বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। আবাধে হাঙরপাচার, হারপুন থেকে আধুনিক অস্ত্রের আঘাতে একের পর এক হাঙর শিকারের ফলে পানির নীচে প্রাণিজগতের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকটাই, ভেঙে পড়েছে স্বাভাবিক খাদ্যশৃঙ্খল।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মায়ের মতোই রুখে দাঁড়িয়েছেন। হাঙর সংরক্ষণ বিষয়ে শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলার চেষ্টায় বিভিন্ন দেশে একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে বেরিয়েছেন, করেছেন অসংখ্য টিভি শো। মানুষ নামক সবচেয়ে হিংগ্র প্রাণিটির সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে সন্তানদের বাঁচাতে একাই লড়ে যাচ্ছেন হাঙরদের মা। খবর : ডেইলিবাংলাদেশ’র।