স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অগ্রযাত্রা অনিবার্য

রুশো মাহমুদ  »

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ। অনেক মানুষের দেশ, আয়তনেও ছোট। অভ্যুদয়ের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে হিসেব আর নিকেশের পালা। দেশটা কতটা এগিয়ে গেল, কী তার অর্জন এই সুবর্ণজয়ন্তীতে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি পুনর্গঠনের সূচনাতেই দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে। দেশটি তার জনককে হারায় বিজয়ের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে। এক ট্র্যাজেডি! দেশবিরোধী হায়েনার হিং¯্র থাবায় জনকের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ হতবাক! লজ্জায় বিমূঢ় গোটা জাতি, গুটিকয় পরাজিত শক্তি ছাড়া।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অভিন্ন সত্তা। বস্তুত ১৯৪৮ সাল থেকেই জাতীয়তাবাদী সব আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু জড়িত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একজন অনমনীয় নেতা হিসেবে জনমনে স্থান করে নেন। ১৯৬০-এর দশকে যখন তিনি ছয় দফা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তখন থেকেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে বাঙালির আলাদা রাষ্ট্র ও জাতিসত্তা গঠনের প্রত্যয় গড়ে ওঠে। তাঁর নেতৃত্বে জনগণের আস্থা ছিল বলেই আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্ববাচনে অভূতপূর্ব ম্যান্ডেট পায়।

১৯৭১ সালে লাখ লাখ বাঙালি তাঁর আদেশের অপেক্ষায় ছিল এবং একমাত্র তাঁর নির্দেশই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর নামেই ঘোষিত হয়েছিল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধও হয়েছিল তাঁর নামেই। দেশ-বিদেশে সবাই মাত্র একজন নেতাকেই চিনতেন-তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী বিজয় ও অপার জনসমর্থন তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বৈধতা দিয়েছিল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন,  ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এগুলো এক একটি আমাদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের ঐতিহাসিক পর্ব। এইসব সংগ্রামের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছি ১৯৭১ সালে। লাখ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছিল। তারপরও জাতি স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছিল অবিচল। এই ঐক্য সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়েই অনেকের সংশয় ছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক সময় ব্যঙ্গ করে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি। আশির দশকেও বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য ছিল দাতাদেশ ও সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া। প্রতিবছর নিয়ম করে প্যারিসে দাতাগোষ্ঠীর সভায় হাত পাততে হতো দেশের অর্থমন্ত্রীকে। এখন সেই বাংলাদেশ একটু একটু করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ সাহায্য নয়, তার পরিবর্তে বাণিজ্য সুবিধা চাওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর হতে পারা একটি বড় অর্জন। আর এর বড় কৃতিত্ব পোশাক খাতের। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। আবার বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় চাল উৎপাদক। এটাও একটি বড় অর্জন। বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশ। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কৃষি ও অকৃষি পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আছে।

স্বাধীন হওয়ার পরও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে তখন অনেকেরই সংশয়। সেই বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে। আর বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ পেল ২০২১ সালে ৪৫ বছর পরে। আরও একটি অর্জন আছে। তা হচ্ছে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংকের তালিকায় স্বল্প আয়ের দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে নি¤œমধ্যম আয়ের দেশ হয়।

দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার নাটকীয়ভাবে কমেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্যের এখন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রা অনিবার্য।