সিন্ডিকেট ভাঙতে চট্টগ্রামের ‘মিট বাজার’

সুপ্রভাত ডেস্ক »

সপ্তাহে দুই দিন ভোরের আলো ফুটতেই চট্টগ্রাম নগরীর বালুছরা বাজারে সড়কের পাশ ঘেঁষে দেখা যায় দুটি দীর্ঘ লাইন। অনলাইনে দেওয়া বুকিং অনুযায়ী এক লাইনে দেওয়া হচ্ছে স্লিপ। সেই স্লিপ নিয়ে আরেকটি লাইনে দাঁড়িয়ে গরুর মাংস সংগ্রহ করছেন ক্রেতারা। অনলাইনভিত্তিক উদ্ভাবনী মাংসের হাট ‘মিট বাজারের’ মাংস বেচাকেনার চিত্র এটি।
চট্টগ্রাম নগরীর বাজারভেদে গরুর মাংসের কেজি যেখানে প্রায় ৮০০ টাকা, সেখানে ৬৭৫ টাকায় গরু ও মহিষের মাংস বিক্রি করছে মিট বাজার। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থীর উদ্যোগটি অল্প সময়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার এখানে মাংস কিনতে আসেন ক্রেতারা। খবর টিবিএস।
নির্ধারিত দিনে ৫ থেকে ৮টি গরু জবাই ও প্রক্রিয়াজাত করে মাংস বিক্রি করে মিট বাজার। ৭০০ গ্রাম সলিড মাংস এবং ৩০০ গ্রাম হাড় ও চর্বিসহ প্রতি কেজি মাংস বিক্রি করা হচ্ছে ৬৭৫ টাকায়। ৫০০ গ্রাম থেকে শুরু করে ৫০ কেজি পর্যন্ত মাংস কিনতে পারেন ক্রেতারা।
একদিনে ৫০০ থেকে ৭০০ জন ক্রেতার কাছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কেজি পর্যন্ত মাংস বিক্রি করছে মিট বাজার। শুক্রবার সবচেয়ে বেশি গরু জবাই ও বিক্রি হয়। কম দামে মানসম্পন্ন মাংস কিনতে পারায় দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও ক্রেতাদের প্রশংসা পাচ্ছে মিট বাজার।
নিয়ম মেনে, সুশৃঙ্খলভাবে বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে মিট বাজারে। অনলাইনে দেওয়া অর্ডার অনুযায়ী ডিজিটাল মেশিনে ওজন করে ক্রেতাকে মাংস বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শত শত ক্রেতার উপস্থিতিতেও নেই কোনো বিশৃঙ্খলা। সকাল সাড়ে ৬টায় শুরু হয়ে সকাল ৯টার মধ্যে শেষ হয়ে যায় বিক্রি প্রক্রিয়া।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফিউল হাসনাত রাহাত এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুর রহমান সাকিব ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট থেকে অনলাইনে মাংস বিক্রির এই উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী সাইফুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন যুক্ত হন এই উদ্যোগের সঙ্গে।
সাজ্জাদুর বলেন, ‘আমরা কম দামে মাংস বিক্রির এই উদ্যোগ নিই। সর্বোচ্চ বিক্রি, ন্যূনতম মুনাফা-এই ব্রত নিয়ে আমাদের পথচলা। মিট বাজার ৩০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অন্য খাতে ব্যবসা রয়েছে। গরুর মাংস বিক্রির এই উদ্যোগটিকে আমরা মুনাফা লাভের জন্য নয়, সামাজিক উদ্যোগ হিসেবেই চালু রাখতে চাই।’
মিট বাজারের উদ্যোক্তারা বলেন, বাজারে মাংস ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে ক্রেতারা বেশি দামে মাংস কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পাশাপাশি ওজনের কারচুপির ঘটনাও নিত্যদিনের। এসব সিন্ডিকেট ভেঙে ন্যায্যমূল্যে মাংস বিক্রি করতেই মূলত তাদের এই উদ্যোগ। এই উদ্যোগ অনেকের মধ্যেই আগ্রহ তৈরি করেছে। হাটহাজারী উপজেলাসহ চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি, অক্সিজেন, বহদ্দারহাট এলাকায় এই উদ্যোগ চালু করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তরুণ উদ্যোক্তারা।
চান্দগাঁও থেকে আসা মোহাম্মদ হান্নান নামের একজন ক্রেতা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের জন্য ৩০ কেজি মাংসের প্রয়োজন ছিলো। অনলাইনে অগ্রিম বুকিং দিয়ে এখান থেকে ৬৭৫ টাকা কেজিতে কিনেছি। বাইরে থেকে কিনতে হলে এগুলো ৮০০ টাকা কেজি দরে কিনতে হতো। এছাড়া ওজনের কারচুপির ঘটনাও ঘটত। এখান থেকে মাংস কেনায় আমার ৩ হাজার ৭৫০ টাকা সাশ্রয়ের পাশাপাশি মান এবং সঠিক ওজন নিশ্চিত হতে পেরেছি।’
চট্টগ্রাম জেলার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদ কাদের বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে বিভিন্ন বাজারভেদে হাড়সহ গরু ও মহিষের মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। হাড়ছাড়া মাংস বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৯০০ টাকায়। এদিকে কয়েকজন ক্রেতা মিট বাজারের স্বচ্ছতা ন্যায্যমূল্যে বিক্রির প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেছেন। একজন ক্রেতা বলেন, ‘বাজারে মাংসের দোকান থেকে কিনতে গেলে তাদের ইচ্ছামতো এবং প্রতি কেজিতে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন কম দিয়ে দেয় বিক্রেতারা। এখানে সিরিয়াল মেনে সবাইকে একই মানের মাংস দিচ্ছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরমান হোসাইন বলেন, ‘৫০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে আমি চার কেজি গরুর মাংসের বুকিং দিই। ভোরে এসেই দেখি ক্রেতাদের লাইন। কিছুটা সময় লাগলেও আমি সন্তুষ্ট। কারণ বাজারে গরুর মাংস কিনতে গেলে সঠিক পরিমাণ মাংস পেতে বিক্রেতার সাথে রীতিমতো ঝগড়া করতে হয়। এখানে নিয়ম মেনেই বিক্রি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।’
শুধু মাংস বিক্রিতেই থেমে নেই মিট বাজারের অনন্য উদ্যোগ। মিট বাজার টিমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নিজেরাই উত্তরবঙ্গ থেকে গরু, মহিষ সংগ্রহ করেন। নিজস্ব শেডে এসব গরু নিয়ে আনা হয়।
গরু সংগ্রহের পর গরুর সংখ্যা, মাংসের সম্ভাব্য ওজন উল্লেখ করে মিট বাজার ফেসবুক পেইজে পোস্ট করা হয়। ক্রেতারা ফোন করে ৫০০ টাকা বুকিং মানি দিয়ে মাংসের বুকিং দেন। রাত ১২টা থেকে শুরু হয় জবাই ও প্রসেস। ভোর ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে বুকিং দেওয়া ক্রেতারা এসে মাংস সংগ্রহ করেন।
উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মিট বাজারের কার্যক্রমকে আমরা সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। লাভের অংশ থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের চিকিৎসা, দাফন-কাফন, দরিদ্র মেয়েদের বিয়ের আয়োজনসহ আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।’
সম্প্রতি ‘মিট বাজার মেজবান’ নামে একটি নতুন উদ্যোগ চালু করেছে। ১৬৫ টাকায় মেজবানি খাবার বিক্রি করছে তারা. বাজারে যা ২৫০ টাকা। প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার মানুষের জন্য মেজবানি খাওয়ার আয়োজন করা হচ্ছে এই উদ্যোগের আওতায়।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন এ উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, ‘ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কারণে ভোক্তারা প্রতিনয়ত প্রতারিত হয়। এমন বাস্তবতায় মিট বাজারের এই উদ্যোগ সময়োপযোগী। আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এমন উদ্যোগে আরও তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।’