শিল্প ও সংগ্রামের সমন্বয় : গণসঙ্গীত শিল্পী রবীন দে

বিশ্বনাথ চৌধুরী বিশু :

শিল্পের  জন্য শিল্প নয়, মানুষের  জন্য শিল্প। এ চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে শিল্প সাধনায় জীবনকে নিবেদন করার কাজ  সমাজে খুব বেশি শিল্পী করেন না। উপরন্তু, সে মানুষ যদি হন, সাধারণ মানুষ, যাদের রক্ত, শ্রম এবং ঘামে আমাদের সমাজ, সভ্যতা গড়ে ওঠে। সমাজ-সভ্যতার রূপকার এই সকল সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ  নিয়ে কাহিনী বানানো, গান বানানো, নাটক ইত্যাদি বানানো এবং তার সহজ সরল উপস্থাপনই হচ্ছে গণ-সংস্কৃতি। আমাদের চট্টগ্রামে শ্রমজীবী এই সকল মানুষদের জীবন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করার অন্যতম কারিগর হিসেবে সুদীর্ঘ চার দশকেরও অধিক সময় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন গণসঙ্গীত শিল্পী রবীন দে। শোষণ, বঞ্চনা এবং নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার শানিত কণ্টের গান, এ সকল শ্রমজীবী মানুষের  যাত্রাপথে এক নব প্রেরণা সঞ্চার করেছিলো।

‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতিয়তাবাদী চেতনার যে উন্মোচন সাধিত হয়েছিলো এদেশে, তার ধারাবাহিকতায় একে, একে স্বৈরাচার এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সংগঠিত হচ্ছিলো তদানীন্তন পূর্ব বাংলায়। ষাটের দশক ছিলো এই আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপূর্ণ জোয়ারের সময়। এর আগেই সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটতে শুরু করলেও এই দশকে এসে তা’ পূর্ণতা লাভ করতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে সমাজতন্ত্রের ব্যাপক প্রসার, আমাদের দেশের ত্যাগী এবং মানবমুক্তির স্বপ্নে বিভোর কিছু তরুণের মধ্যেও দানা বাঁধতে থাকে।  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে,কলে-কারখানায় কিংবা মাঠে ময়দানে এইসব তরুণ সম্প্রদায় রাজনীতির এক নতুন দর্শন গ্রহণে ব্যাপৃত করে নিজেদের। এই নতুন দর্শন হলো মার্কসবাদ। আমাদের সমাজ জীবন,রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক পরিম-লেও এর এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে থাকে। স্বৈরাচারী শাসন, শোষণ, নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক এবং শোষণ মুক্ত মানবিক সমাজ নির্মাণে তারা নিজেদের নিয়োজিত করতে থাকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতি মুক্তির প্রাথমিক স্বাদ গ্রহণে সক্ষম হয়। এই সক্ষমতার পেছনে অন্য সকলের সাথে শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীদের ভূমিকা ছিলো প্রণিধানযোগ্য। চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনে এর অন্যতম অংশীদার ছিলেন রবীন দে। মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণায় দীক্ষিত রবীন দে, জীবনের  শুরুতে ছ্ত্রারাজনীতিতে য্ক্তু হয়ে রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে নিজেকে নিয়োজিত করতে থাকেন সাংস্কৃতিক কর্ম যজ্ঞে এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই কর্ম যজ্ঞ থেকে বিচ্যুত হননি তিনি। ১৯৭২ সনে চট্টগ্রামে, সাংস্কৃতিক সংগঠক, শিল্প-সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ মানুষ মৃদুল সেনের নেতৃত্ব, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর শাখাগঠন করা হয়। শিল্পী-সংগ্রামী  রবীন দে অন্যান্যদের সাথে মৃদুল সেনের সহযোদ্ধা হিসেবে তাতেই যুক্ত হয়ে পড়েন এবং নিজের শ্রম, মেধা এবং ঘামে সংগঠনকে গড়ে তুলতে থাকেন। উদীচী’র মতো গণ সংগঠনে কাজ করা, সংস্কৃতি কর্মীদের জন্যে সহজ-সরল বিষয় ছিলো না। বিশেষত ৭৫’ এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুনরুত্থানে, শুভ চিন্তা-চেতনা সম্পন্ন যেকোনো কাজই প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলো। ভাষাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার ভিত্তিতে শোষণ মুক্ত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার সমস্ত স্বপ্নই তছনছ হয়ে পড়েছিলো। অব্যাহত সামরিক শাসন, হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ট জাতিকে, নবতর সাংস্কৃতিক  চেতনায় উজ্জীবিত করার সংগ্রামে উদীচী, চট্টগ্রামের প্রধান কণ্ঠ-সৈনিক হয়ে উঠেছিলেন রবীন দে। একক গণসঙ্গীত করেছেন, পঞ্চাশ জনেরও অধিক শিল্পী নিয়ে সমবেত সঙ্গীতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চট্টগ্রামে প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী অচিন্ত্য চক্রবর্তী, তেজেন সেন, হরিপ্রসন্ন পাল প্রমুখের উত্তরাধিকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন রবীন দে। গণসঙ্গীতে, সমবেত দলের নেতা হিসেবে রবীন দে’র বিকল্প কোনো নাম উচ্চারিত হয় কি-না আমার জানা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান হিসেবে রবীন দে’র নামটি চট্টগ্রামের মানুষ অনেক,অনেক দিন মনে রাখবে। উদীচী’র শিল্পী কর্মীদের নিয়ে, গণসঙ্গীত ছাড়াও, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ও লোকগান উপস্থাপনায় তিনি সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে উদীচী, চট্টগ্রাম জেলা সংসদসহ, পাঁচটি সংগঠন মিলে বছরব্যাপী পঁচিশটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম চট্টগ্রাম শহরসহ, প্রতন্ত অঞ্চলে। প্রতি অনুষ্ঠানে রবীন দে উপস্থিত থেকে সঙ্গীত দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সম্ভবত, ১৯৮৫ সনে উদীচী, চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাংস্কৃতিক উৎসবে ড. মাহবুবুল হক গ্রন্থিত গীতি-নৃত্য-আলেখ্য ‘জ্বলছে বুকে ক্রোধের আগুন’ উপস্থাপনায় অন্তত ষাটজন কণ্ঠশিল্পীর সমন্বয়ে গঠিত গণসঙ্গীত দলে নেতৃত্ব দিয়ে রবীন দে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখেছিলেন। ১৯৯৯ সনের ৬ মার্চ, যশোরে উদীচী’র দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা হওয়ার পর আমরা ৭ মার্চ বিকালে চট্টগ্রামের প্রতিনিধিরা, চট্টগ্রামে ফিরে আসি। বাসায় পৌঁছেই আমি রবীনদাকে ফোন করে সন্ধ্যার আগেই উদীচী, অফিস আসতে অনুরোধ করি এবং ফোন করে আরো শিল্পী-কর্মীদের আসতে অনুরোধ করতে বলি। প্রায় বিশ জনের মতো শিল্পী-কর্মী  মিলিত হয়ে, ধর্মান্ধ এই সন্ত্রাসী বোমাহামলাকারী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করি। আমি বক্তৃতা করার পর, রবীনদাসহ সঙ্গীতদল একটি গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। তারপর প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করি।  ৬ মার্চ, বোমা হামলার পর, চট্টগ্রামেই আমরা প্রথম এই প্রতিবাদী মিছিলের আয়োজন করি।

উদীচী’র গণসঙ্গীতের দল নিয়ে, দক্ষিণে সাতকানিয়া, উত্তরে ফটিকছড়ি, মিরসরাই,রাঙামাটি জেলায় এবং চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে আমরা অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছি, যার প্রত্যেকটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন রবীন দে। উদীচী’র কর্মকা-ে রবীন দে ছিলেন ক্লান্তিহীন। ৭৪’সনে উদীচী’র সাংস্কৃতিক উৎসব হয় চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের মাঠে। রবীন দে স্কুলের মাঠে, রিক্সা করে কাঠের ভারী চেয়ারগুলো একা টানতে দেখেছি। সেই চেয়ার টানায় সহযোগিতা করতে গিয়ে, তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয়, যদিও ৭৩’ সন থেকেই তাঁকে আমি চিনি। ৭৬’ সনে আমি বন্ধুবর গোলাম কিবরিয়ার হাত ধরে  উদীচী’তে যুক্ত হই। ৭৫’ সনে বঙ্গবন্ধু  হত্যার পর,৭৭’ উদীচী, চট্টগ্রাম জেলা শাখার সম্মেলন হয়। ফুলকি, স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ড. রাজীব হুমায়ুন সভাপতি, সুভাষ দে সাধারণ সম্পাদক, ডা. চন্দন দাশ সহসাধারণ সম্পাদক, রবীন দে’কে সঙ্গীত সম্পাদক নির্বাচন করা হয় এবং আমাকে বানানো হয় সাংঠনিক সম্পাদক। সেই থেকে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উদীচী, চট্টগ্রাম জেলা শাখার উত্তোরোত্তর সমৃদ্ধির সূত্রপাত। এই সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় সকলের  সাথে রবীন দেও ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়।

রবীন দে শুধুমাত্র, উদীচী’র সমবেত সঙ্গীত দলের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠকও। উদীচী’র সাথে, সাথে, তাঁর কাজের ক্ষেত্র পতেঙ্গার, জি, ইম, প্ল্যান্ট শিল্পাঞ্চলে ‘সূর্যোদয়’ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। স্টীল মিল,ইস্টার্ন ক্যাবলস এলাকায় ‘পূর্বাচল’ পাঠাগারের সাথেও তিন ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রবর্ত্তক সংঘের অনাথ শিশু-কিশোরদের গান শিখিয়েছেন, আলাউদ্দীন ললিত কলা কেন্দ্রে গানে শিক্ষকতা করেছেন এবং খেলাঘর, চট্টগ্রাম মহানগরীর সঙ্গীত বিদ্যালয় ‘শৈশব’ এর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।  মার্কসবাদী দর্শনে দীক্ষিত রবীন দে কমিউনিস্ট পার্টিতে কাজ করেছেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে দীপ্তপদে মিছিল করেছেন, সমবেত জনতাকে গানে,গানে সেই আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বেলিত করেছেন। সংগঠনে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন, বয়োকনিষ্ঠদের ভ্রাতৃ সুলভ স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। কখনো কারো সাথে রূঢ় আচরণ করেছেন কিংবা উচ্চ স্বরে কথা বলেছেন বলে মনে পড়ে না। বিনয়, সারল্য এবং সততাকে অন্তরে ধারণ করেছেন সবসময় তিনি। এই গুণগুলো যদি একজন মানুষের মধ্যে না থাকে, সে তো মানুষ নয়,শিল্পীতো নয়ই। কূটচাল, দ্বিচারিতা, মিথ্যাচার, রঙের প্রলেপ দিয়ে কথা বলা ছিলো তাঁর নীতি বিরুদ্ধ কাজ। উদীচী’র ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়কে আমরা সবাই মিলে শান্ত মাথায় সামাল দিয়েছি এবং সংগঠনকে সংকটমুক্ত রেখেছি সবসময়।

স্থিতধী, মিতভাষী রবীন দে আত্মপ্রচারণা বিমুখ এক মানুষ ছিলেন সবসময়। রেডিও, টেলিভিশনে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কিংবা একজন সেলিব্রেটি হিসেবে নাম-যশ অর্জন করা তাঁর পক্ষে কোনো কঠিন কাজ ছিলো না। অথচ সে পথের যাত্রী ছিলেন না রবীন দে। শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অঙ্গীকারাবদ্ধ একজন শিল্পীর  মগ্নতাই থাকে শুধু শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। বিনিময় বা প্রাপ্তির অন্য কোনো নেশা তাকে আকর্ষিত করতে পারে না। চট্টগ্রামকে বলা হয়ে থাকে মফস্বল শহর। সংস্কৃতি কর্মীরা কতো কাজই করছেন প্রতিনিয়ত এখানে। অথচ মিডিয়াগুলোর কৃপণতার কারণে তা’ কখনো প্রচারেই আসে না।

যে কারণে, রবীন দে’র মতো একজন নিবেদিত প্রাণ গণসঙ্গীত শিল্পীর কথা, চট্টগ্রামের মানুষ জানলেও দেশের আপামর সাধারণ জনগণের কাছে তা’ হয়তো অনুন্মোচ্চিতই থেকে যাবে। হয়তো এইভাবেই রবীন দে’র মতো মফস্বল শহরের নিবেদিত প্রাণ শিল্পী-কর্মীরা  জাতীয়ভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত হয়েই থাকবেন।

দুর্ভাগ্য তাঁদেরই যাঁরা, এ ধরণের মানুষকে চিনতে চান না বা চিনতে পারে না। মানুষের জন্যে শিল্পকে আমৃত্যু অন্তরে লালন করেছেন, রবীন দে। চারদশকেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের অবহেলিত নির্যাতিত আর শোষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যেই সঙ্গীতকে ভয়হীন চিত্তে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন তিনি। তাঁর বিদায়ে, সেই পদ আজ শূন্য। একমাত্র তাঁর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণাকে অন্তরে লালন করে গণসঙ্গীতে নিবেদিত প্রাণ উদীচী’র শিল্পী-কর্মীরাই তা’ এগিয়ে নিতে পারেন। তাঁদেরকে সংকীর্ণতা, পঙ্কিলতা, কূপম-ূকতা এবং বিভক্তির উর্ধ্বে উঠে ঐক্যের জয়গানে দীপ্ত শপথ নিতে হবে। তবেই রবীন দে মৃত্যুবরণ করেও সবার মনে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। সে দায় উদীচী’র শিল্পী-কর্মীদেরই।