‘শাহ আমানত সেতু ঝুঁকিতে’

সুপ্রভাত ডেস্ক »
শাহ আমানত সেতুর দুই পিলারের নিচ বরাবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশ থেকে ক্রমাগত মাটি সরে গিয়ে গভীরতা স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে পিলারগুলো দেবে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ঝুঁকি তৈরি হয়েছে সেতুর জন্যও।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিতের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি জরিপের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তবে সেতু নির্মাণকারী সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই পিলারের নিচ থেকে মাটি কিছুটা সরলেও এখনও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশের বাস্তব পরিস্থিতি জানতে ‘চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে মার্চ ও এপ্রিল মাসজুড়ে এ জরিপ চালানো হয়। অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিতের নেতৃত্বে রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, জাইকা ও ডিএফআইডি’র সাবেক কর্মকর্তা অধ্যাপক নোমান আহমদ ছিদ্দিকী, পরিবেশ গবেষক ও সাংবাদিক আলীউর রহমান জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শাহ আমানত সেতুর উত্তরে এক ও দুই নম্বর পিলারের মাঝখানে নদীর গভীরতা মাত্র ৭ দশমিক ৭ ফুট, অথচ সেখানে ২৫ ফুট গভীরতা থাকার কথা। দুই ও তিন নম্বর পিলারের মাঝখানে গভীরতা থাকার কথা ৩৮ ফুট, কিন্তু সেখানে চর জেগে উঠেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, তিনটি পিলারের নিচে নদীর গভীরতা কমেছে। কিন্তু পরের পিলারগুলোর চিত্র ভিন্ন, সেখানে গভীরতা বেড়েছে। তিন ও চার নম্বর পিলারের মাঝে গভীরতা ৩৮ ফুট থাকার কথা। সেখানে জরিপকারী দল গভীরতা পেয়েছে ৬৪ দশমিক ৭ ফুট। চার ও পাঁচ নম্বর পিলারের মাঝে গভীরতা থাকার কথা ২৮ ফুট। অথচ চার নম্বর পিলারের পাশে নদীর গভীরতা ৭৮ দশমিক ৬ ফুট। সেতুর আশপাশের এলাকা কর্ণফুলী নদীর ফিরিঙ্গিবাজার থেকে শিকলবাহা খালের মুখ পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটারে এটি সবচেয়ে গভীরতম স্থান।

ফ্যাদোমিটার (ইকো সাউন্ড) দিয়ে পরিচালিত জরিপে চার ও পাঁচ নম্বর পিলারের মাঝে নদীর তলদেশে মাটিতে ছোট-বড় ফাটল দেখা গেছে। একে শাহ আমানত সেতুর জন্য উদ্বেগজনক বলছেন জরিপকারীরা। সেতুর দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি নদীর তলদেশে গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় তীরের মাটি ধসে সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত  বলেন, ‘শাহ আমানত সেতুর চার ও পাঁচ নম্বর পিলার ঝুঁকির মধ্যে আছে। মাটি সরে যাচ্ছে। পিলারের নিচ থেকে পানির তোড়ে মাটি ভেসে যাচ্ছে, কারণ সেখানে গভীরতা বেশি। এর কারণ হচ্ছে, উত্তর দিক থেকে অর্থাৎ শহরের দিক থেকে নদী ভরাট হয়ে গেছে। চাক্তাই খাল ও রাজাখালী খাল দিয়ে আসা বর্জ্য ও পলি জমে নদী ভরাট হয়ে গেছে। শাহ আমানত সেতুর প্রায় অর্ধেক অংশে চর পড়ে গেছে। এই চর পড়ার ফলে নদীর উজান থেকে আসা স্রোত দক্ষিণে বেশি হয়ে গেছে। ফলে মাটি ক্ষয় হচ্ছে, মাটি সরে যাচ্ছে।’
‘এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে শিকলবাহা খালের স্রোত। এই স্রোতে মাটির ক্ষমতা কমে গিয়ে মাটি ভেসে যাচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে চার ও পাঁচ নম্বর পিলারের ধারণশক্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকবে। পিলার দু’টি আস্তে আস্তে দেবে যেতে থাকবে। এজন্যই সেতুটা ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। তবে এটা আরও ডিটেইলস ইনভেস্টিগেশনের প্রয়োজন আছে,’ বলেন অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহ আমানত সেতু থেকে ৫০০ মিটার উজানে চাক্তাই খালের মোহনার উত্তর পাশে কর্ণফুলী নদীর প্রকৃত সীমানা থেকে ৩০০ ফুট অংশে নদীর গভীরতা পাওয়া গেছে মাত্র দুই ফুট। একই স্থান থেকে মাঝ নদী বরাবর পাওয়া গেছে ১৩ দশমিক ৬ ফুট। নদীর দক্ষিণ তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৪৮ ফুট।  খবর সারাবাংলা।
আবার এর প্রায় ৫০০ মিটার উজানে রাজাখালী খালের মোহনায় মাঝ নদীতে গভীরতা মাত্র চার ফুট। শাহ আমানত সেতুর তিন নম্বর পিলার বরাবর নদীর পশ্চিম অংশে গভীরতা ৬০ দশমিক ৯ ফুট। একই স্থান থেকে সোজা নদীর দক্ষিণ তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৫৫ ফুট।
শাহ আমানত সেতু ঝুঁকিতে এ দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘পিলারের নিচ থেকে ৬০-৭০ ফুট, এমনকি ১০০ ফুট মাটিও যদি সরে যায়, তবু সেতু ঝুঁকির মধ্যে পড়বে না। পানির তলদেশ থেকে সেতুর পিলারের ভিত্তি ২৫০ ফুট গভীরে। সুতরাং মাটি সরে যাওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরির যে বিষয় বলা হচ্ছে, সেটি সঠিক নয়। আমি জানি না, যারা জরিপ করেছেন উনারা সেতুর নকশাটা দেখেছেন কি না। উনাদের উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে কথা বলা। কোনো বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন না হলে তো শুধু আতঙ্ক ছড়াবে, আর কিছু হবে না।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগের চট্টগ্রামের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (সেতু) জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ব্রিজ এক্সপার্টরা আছেন। আমরা উনাদের মতামত নেব। যদি সত্যিই কোনো সমস্যা হয়, তাহলে সেটা সমাধান করা হবে।’
একদিকে নদী ভরাট, আবার তলদেশ থেকে মাটি সরে যাওয়া এর সমাধানে দ্রুত খননের ওপরই সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন গবেষক স্বপন কুমার পালিত। তিনি বলেন, ‘নদী দ্রুত ড্রেজিং করে পলিথিন ও পলি তুলে ফেলতে হবে। এতে নাব্য বাড়বে। স্রোত ডাইভার্ট হয়ে যাবে। যেখানে গভীরতা বেশি, সেখানে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাবে। তাহলে সেতু নিয়ে ঝুঁকি আর থাকবে না।’
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে রোববার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেছে। অথচ বাস্তবে তিন কিলোমিটার এলাকায় নতুন করে চর জেগেছে। চর পড়ার কারণে আরেকদিকে নদীর তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে সেতুর জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আমরা বারবার বলছি, কর্ণফুলী নদী দখল ও দূষণমুক্ত করুন। কিন্তু প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব আছে।’
এদিকে, খনন কাজে নিয়োজিতদের দূষছেন রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ কর্ণফুলী নদী নিয়ে ব্যবসা চলছে।’